Friday, 13 July 2012

ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

এভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য ভাষাবিজ্ঞানী তার আলোচনাকে উল্লিখিত কয়েক ভাগে ভাগ করে থাকেন। ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) শাখায় ভাষার ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ পদ্ধতি, তাদের ব্যবহার ও স্থানভেদে তাদের উচ্চারণে তারতম্য, উচ্চারণের ব্যবহার-সঙ্গতি, সন্ধি ও বণ্টন, যতি ও ছন্দোবিন্যাস, এমনকি লিখনপদ্ধতিতে তাদের রূপায়ণ ইত্যাদির যথাযথ আলোচনা হয়। উচ্চারণের স্থান ও রকম, এমনকি তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও বিশদ আলোচনা সাধারণ ধ্বনিতত্ত্বের পর্যায়ভুক্ত। ধ্বনিবিজ্ঞানের আলোচনায় বিশ্লিষ্ট বর্ণনাকে যখন গাণিতিক সংকেতে আবদ্ধ করা হয়, তখনই একে ধ্বনিতত্ত্ব নাম দেয়া হয়। অর্থাত্ ধ্বনিবিজ্ঞানে যা ছিল বস্তুসম্পৃক্ত (পড়হপত্বঃব), ধ্বনিতত্ত্বে তা হয়ে ওঠে নির্বস্তুক (ধনংঃত্ধপঃ)। বিজ্ঞানের আলোচনায় এই জগতের নানা পদার্থেরই স্বভাব, গতি, শক্তি ও গুণ নানা সংকেতে ধরা যায়। যেমন অংকশাস্ত্রে—১ (এক), ২ (দুই) অথবা (বর্গমূলক), . (দশমিক বিন্দু), + (যোগ চিহ্ন), - (বিয়োগ চিহ্ন), – (পূরণ চিহ্ন), % (ভাগ চিহ্ন) ইত্যাদি মাধ্যমে অনেক কিছু বোঝানো হয়। ধ্বনিবিজ্ঞানের (Phonetics) বিশিষ্ট রূপও সেইরূপ নানা সংকেত ও চিহ্নের সাহায্যের ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) বিধৃত হয়। এক কথায় ধ্বনিবিজ্ঞানে (Phonetics), যার বিশ্লেষণ, ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) তারই গাণিতিক প্রকাশ। তাই ধ্বনিবিজ্ঞানে যাকে নানা কথায় বিশ্লেষণ করা হয়, ধ্বনিতত্ত্বে তাই হয় সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত কতকগুলো সংকেত বা সূত্রের (Formula) সমষ্টি। বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের এই দুটি শাখাকে একই বিভাগের দুটি স্তর বা পর্যায় মনে করা যেতে পারে। রূপতত্ত্ব (Morhphology) বিভাগে পদ ও শব্দসাধন পদ্ধতি অর্থাত্ পদ ও শব্দগঠন সম্পর্কিত নিয়মাবলি আলোচিত হয়। এতে সাধিত শব্দ বা পদের ধাতু, প্রত্যয়, অনুসর্গ, বিভক্তি প্রভৃতি ক্ষুদ্রতম অংশ নির্ণীত হয়। সমাস, অব্যয়, নিপাত ইত্যাদির আলোচনাও রূপতত্ত্বের প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্র। পদক্রম ও বাক্যরীতি (Syntax) বিভাগে আলোচিত হয় বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ ও পদগুলোর ক্রম আর বাক্য-বিশ্লেষণ পদ্ধতি। মূলত রূপতত্ত্ব (Morphology) ও পদক্রম (Syntax) একই বিভাগের দু’টি স্তর বা পর্যায়। কেননা, শব্দ ও পদের অংশ নিরূপণ বাক্য মধ্যে শব্দের অবস্থান ও কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। তাই কেউ কেউ এই দু’টি শাখাকে মিলিতভাবে ব্যাকরণও বলে থাকেন। কিন্তু ব্যাকরণের কার্যবিধির ধারায় ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম—এই সমুদয়ের পর্যায়ক্রমে পৃথক পৃথক ও সম্মিলিত এবং সামগ্রিক আলোচনা ও বিশ্লেষণই বাঞ্ছনীয়; তাই একটিকে ছেড়ে অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। চারটি বিভাগের বিশ্লেষণই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারো কারো ধারণা এই যে, যেহেতু ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম যথাক্রমে পরপর আলোচিত হয়, তাই এদের আলোচনার ধারাক্রমে এদের স্থান নির্ণীত হবে; যেমন ধ্বনিবিজ্ঞান নিম্নস্তরের, ধ্বনিতত্ত্ব তার পরের, রূপতত্ত্ব তারও পরের এবং পদক্রম সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু এরূপ ধারণা ভুল। আসলে এটি আলোচনার সুবিধার্থে এক ধরনের বিভাগ মাত্র, এতে স্তরের উচ্চতা-নিম্নতার প্রশ্ন নেই। বাগর্থ বা শব্দার্থ-বিজ্ঞানে (Semantics) বাক্যমধ্যে ব্যবহৃত শব্দ, শব্দসমষ্টি, বাক্যাংশের ও বাক্যের অর্থ নির্ধারণ ও তার প্রক্রিয়া নিরূপণ করা হয়। কালের ও স্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দার্থ কীরূপ বিকৃত, পরিবর্তিত ও অভিযোজিত হয়, তার বিস্তারিত আলোচনাও এর অন্তর্ভুক্ত। অভিধান-বিজ্ঞান বা অভিধানতত্ত্ব (Lexicography) বিভাগে বিশেষ ভাষার শব্দসম্ভার আর তার বিভিন্ন রূপ ও আকৃতি অনুযায়ী শৃঙ্খলা ও তার সঙ্গে অর্থের বিভিন্নতা ও প্রয়োগবিধি ইত্যাদি আলোচিত হয়। দেশি ও বিদেশি শব্দবিভাগ এবং কথায় ও সাহিত্যে এদের ব্যবহারবিধি—এসব এ বিভাগের আলোচ্য। দ্বিভাষিক বা ত্রিভাষিক অভিধানে শব্দ ও বাক্যাংশের প্রতিশব্দ ও অনুবাদ উল্লিখিত হয়। কেউ কেউ মনে করে, ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) হলো ভাষা বিশ্লেষণের পূর্ববর্তী স্তর (Prelinguistics) আর বাগর্থ-বিজ্ঞান (Semantics)-এর পরবর্তী স্তর। তাদের মতে যে কোনো ভাষা বিশ্লেষণে ধ্বনিতত্ত্বও বাগর্থ-বিজ্ঞান ভাষা বিশ্লেষণের স্তরবহির্ভূত। কিন্তু এসব আলোচনার স্থান এটি নয়। যে কোনো ভাষার বর্ণনামূলক আলোচনায় এই নিয়মে বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়। এই আলোচনায় বিভিন্ন ভাষার আকৃতি ও প্রকৃতি এমন নিখুঁতভাবে বিবৃত হয় যে, প্রত্যেকটি ভাষার স্বাতন্ত্র্য কেবল ভাষাবিজ্ঞানী কেন, সাধারণের কাছেও স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। ভাষার এই আশ্চর্য ক্ষমতা ও সমাজ-জীবনে তার অদ্ভুত প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণই ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অন্যতম উদ্দেশ্য। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে একই ভাষার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কালের ধ্বনি, উচ্চারণ, শব্দরূপ, পদক্রম, শব্দসম্ভার ও অর্থ কী ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে, তার বর্ণনা থাকে। একই ভাষার বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাষার একই সময়ে অথবা বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন সময়ে যে মিল-গরমিল ধরা পড়ে, তারও বিশদ বর্ণনা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। আগে গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃতের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে তুলনা করাই ছিল ভাষাবিদদের কাজ। এখন একই ভাষার বিভিন্ন উপভাষাও তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষিত হতে দেখা যায়। ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের মাধ্যমে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের সহায়তায় বিশেষ কোনো ভাষার উচ্চারণ, ধ্বনি, শব্দ, পদক্রম ও বাক্যের ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করা হয়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব—এ দুই শাখার আলোচনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর নির্ভর করে। আর যেহেতু প্রাচীন ভাষাগুলোর ধ্বনি হুবহু রক্ষিত হয়নি, তাই সেসব ভাষার আলোচনাও বেশিরভাগই অনুমানভিত্তিক, কাজেই দুর্বল। সেই কারণে অধুনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর সবার নজর পড়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি যে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলি—এদের পরও কিছুদিন পর্যন্ত ভাষাতত্ত্বের আলোচনা এ উপমহাদেশে অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাস প্রায় শূন্য। বিংশ শতাব্দীতে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ইউরোপ ও আমেরিকা উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করে। এতে বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষা আলোচনা সেখানে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। আমাদের দেশেও বিগত শতাব্দীতে কিছু ভাষাবিদ ভাষা নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের প্রায় সব আলোচনাই প্রধানত তুলনামূলক ও ইতিহাসভিত্তিক। এদের মধ্যে বিমসের তত্ত্বের ÔComparative Grammar of Modern Indian Language’, রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকারের ÔWilson Phonological Lectures’, nibwji ÔComparative Grammar of the Indian Languages’, গ্রিয়ারসনের ‘Linguistic Survey of India’, কেলগের ‘Hindi Dialects’, Ges ট্রামপের ‘Sindhi Grammer’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষা সম্বন্ধে যেসব কাজ হয়েছে তার মধ্যে বিজয় চন্দ্র মজুমদারের The History of the Bengali Language, ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের Origin and Development of Bengali Language (vol. I & II)Õ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ এবং ডক্টর সুকুমার সেনের ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ই প্রধান। এছাড়া দেশি ও বিদেশি নানা পত্র-পত্রিকায় এদের এবং আরো অনেকের আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এদের প্রায় সব আলোচনাই ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের আওতায় পড়ে। আমাদের দেশের আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার সূচনা হয় এই শতাব্দীতে গ্রিয়ারসন সাহেবের খরহমঁরংঃরপ ঝঁত্াবু ড়ভ ওহফরধ-এর াড়ষ. ঠ-এ ‘শব্দকথা’ (১৭১০ খ্রি.), প্রবন্ধ সংগ্রহে সংকলিত এবং সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় (১০০৭-১৯০৭ খ্রি.) প্রকাশিত ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’, ‘বাঙ্গালা কৃত্ ও তদ্ধিত্’, ‘না’, ‘কারক প্রকরণ’ এবং ‘ধ্বনি বিচার’—এই বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য আলোচনা। এরপর ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'Bengali Phonetic Reader' (1928) Ges 'A Brief Sketch of Bengali Phonetics (1928), W. Sutton Page-Gi 'Introduction of Colloquial Bengali' (1934) প্রকাশিত হয়। এসবই বাংলা ভাষা সংক্রান্ত বর্ণনাত্মক আলোচনার এক রকম দিকদর্শন। আমরা মূল আলোচনা থেকে একটু দূরে চলে এসেছি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় কী কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা-ই আমাদের দ্রষ্টব্য। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে ভাষাতত্ত্বের মূলতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় যেসব মনীষী আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের কথা এসে পড়েছে। হ (সংক্ষেপিত)

No comments:

Post a Comment