Friday, 13 July 2012

বখশিশ


সারোয়ার কবীর দক্ষিণ খানের জমিটা বিক্রি করবার পারলে তোরে আমি পাক্কা এক লাখ টাকা বখশিশ দিমু। : কী যে কচ্ছেন বস! : আচ্ছা, টাকাটা পাইলে তুই কী করবি? এবার চট করে জবাব দিতে পারে না ফালান। পরক্ষণে অবশ্য বলে_ স্যার, অত টাকা পালি ডেইলি দুইবারে জায়গায় তিনবার আপনার হাত-পা টিপবো। সারা বডি ম্যাসেজ করে দিব। কথাটা শোনার পর বস শুধু উচ্চারণ করেন_ হুঁ। বেলা আটটা-সাড়ে আটটা হবে বড়জোর। একটু আগে বস মর্নিংওয়ার্ক করে ফিরেছেন লেডিসপার্ক থেকে। নিচতলার বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। ট্রাকস্যুট ছাড়ার পর কেবল হাফপ্যান্ট পরা, থলথলে শরীর। মাথা ম্যাসেজ শেষে ফালান ঘাড়টা ম্যাসেজ করচে, তারপর দুই হাত, পিঠ-কোমড়, শেষে দুই পা। আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আরেক দফা হাল্কা ম্যাসেজ। এ বাড়িতে তার প্রধান কাজটাই হলো বসের শরীর বানানো, তার বাদে অন্যান্য ফুটফরমায়েশ। বাজার বা সুপার মার্কেটের দোকান থেকে এটা ওটা আনা। বারান্দার সামনে ফেরারি করা বাগান। ডান পাশে গ্যারেজের ওপর সার্ভেন্ট কোয়ার্টার। দারোয়ান ও ড্রাইভারের পাশাপাশি ফালানও থাকে সেখানে। আলাদা আলাদা চৌকি। আগে বসের ড্রাইভার ছিল রহিম, দুবাই চলে যাওয়ার আগে তাকে এ বাড়িতে চাকরিটা দিয়ে গেছে। শর্ত ছিল একটাই ম্যাসেজ জানতে হবে। ফালান সেই ছোট্টবেলায় সৎ মায়ের ঝাঁটাপেটা খেয়ে বাড়ি ছেড়ে ছিল। নগরবাড়ী ঘাটে তারই বয়সী দুলালের সঙ্গে দোস্তি পাতায়। ছেলেটা ফেরিতে ফেরিতে লোকজনের মাথা মালিশ, গা-হাতপা টিপে দিতো। তার কাছেই ম্যাসেজের তালিম নেয়। শেষে এখানে সেখানে ভাসতে ভাসতে এই ঢাকায় এসে ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালে ঠাঁই হওয়ার পর এক হরতালের আগের রাতে পুলিশ অনেকের সঙ্গে তাকেও লরিতে তুলে নেয়। বাকি রাত থানা হাজতে রেখে পরের দিন চালান করল কোর্ট-কাচারিতে। আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না যে ফালানকে ছাড়িয়ে আনবে। ফালতু হিসেবে কয়েক মাস কাটাতে হলো জেলখানায়। সেখানে কতজন তাকে দিয়ে শরীর টিপিয়েছে। শেষে রশিদ মিয়া জেলখানা থেকে বের করে আনে। তার সঙ্গে সেখানেই পরিচয়। জালিয়াতির মামলায় লাল দেয়ালের ভেতরে যাওয়া কালো মোটাসোটা লোকটার শরীরে কেমন বোকটা গন্ধ থাকলেও দিলটা ছিল দরিয়া। তাকে বেশ আদর সোহাগ করে বলতো_ ফালান, তুই পোলা না অইয়া মাইয়া অইলে তোরে আমার তিন নাম্বারের বিবি বানাইয়া ঘরে লইয়া যাইতাম। ঘরে না নিলেও রশিদ মিয়া তাকে এক রিকশা গ্যারেজে ম্যানেজার বানিয়ে দেয়। হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে লোকটা মারা না গেলে ফালানকে আজ বসের বাড়ি এ কাজ নেয়ার দরকার হতো না। : কি রে ফালান, কইলি না এক সঙ্গে এক লাখ টাকা পাইলে কী করবি? জবাবটা দিতে গিয়ে আবারও দ্বিধায় জড়িয়ে যায়। এক লাখ, একসঙ্গে! হিসাব মেলাতে না পেরে ফালান বলে_ কি যে কচ্ছেন বস, অত টাকা দিয়ে করমু কী? : ক্যান, টাকা পেলে দুই আগে বিয়া করবি। : কী যে কচ্ছেন বস, আমাকে কোনো মেয়ে বিয়া করবি! : ক্যান করবে না? : বস, যে কামাই আমার; বুঝলেন না, আজকাল মেয়েদের বেশি ডাটফাট। যে বেতন পাই, তাতে বউয়ের কী পোষাবি? : লাখ টাকা বখশিশ পাবি। অর্ধেক টাকা বিয়ায় খরচ করবি। বাকি টাকা দিয়ে কারবার করবি। ফুটপাত কিংবা বাজারে কাঁচামাল নিয়ে বসলেই তোর অনেক ইনকাম হবে। তোর সংসারের খরচ পুষিয়ে যাবে। : তা অবশ্য ঠিক বলেছেন, স্যার! খানিকটা উপুড় হয়ে পিঠ ম্যাসেজের সুখানুভূতিতে চোখ ভেজা বসের ঢোলা হাফপ্যান্টের ডান পকেটের ভেতর থেকে মোবাইল ফোন বেজে ওঠে আচমকা। ঝটপট সেট বের করে কানে ঠেকিয়ে বস কল রিসিভ করেন_ হ্যালো, কে_ ওহ হো খুররম! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। জাস্ট ওয়েট। আমি এখনই রওয়ানা হচ্ছি। বস আর বসলেন না। ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফালানের দিকে বসেন_ যা তোর আজ ছুটি। বিকেলে ঘুরে আসিস কোথাও থেকে। আমার ফিরতে রাত হবে। ফালানের বুঝতে বাকি থাকে না বসের মুড শুধু নয়, তার দিনটাও ভালো, আসমানের চাঁদ হাতে ধরা দিতে চাচ্ছে। ২. বস গোসল-টোসল সেরে জামকালো গাড়ির পেছনের সিটে গা এলিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ফালানের সত্যিই ছুটি। রাত পর্যন্ত তার ওপর খবরদারি করার কেউ নেই। বিবি সাহেব গেছেন সেই আমেরিকায় বোনের কাছে বেড়াতে। ফালান মন ঠিক করে, বিকেলে ঘুরতে যাবে। এ বাড়িতে চাকরি নেয়ার পর গুলশান থেকে বড় একটা বেরোয়নি। যাবেই বা কোথায়? আজ ফার্মগেটে গিয়ে সিনেমা দেখবে। সেটা না করলে চলে যাবে মালিবাগ মোড়। বাস থেকে নেমে শান্তিবাগে হেঁটে যাবে। এক লাখ টাকা বাপের জিন্দেগিতেও চোখে না দেখলেও বসের কথা শোনার পর থেকেই হিম্মতটা সত্যিই বেড়ে যাচ্ছে। যদিও বসের বখশিশ দেয়ার ব্যাপারটা কাউকে জানায়নি। সবাইকে বিশ্বাস করতে নেই। ব্যাপারটা জানতে পারলে কেউ না কেউ আবার কান ভাঙানি দিতে পারে। এক লাখ টাকা হাতে পাওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করতেই তার শরীরে সত্যিই শিহরণ খেলে যায়। একটা বাহাদুরি ভাব ভর করে মনের ভেতর। গুলশান দুই নাম্বারের সুপার মার্কেটের সামনে থেকে ৬ নাম্বার বাস মহাখালী ওয়ারলেস গেট আসতেই কন্ডাক্টর ভাড়া নিতে আসে। ফার্মগেটের ভাড়া দিতে গিয়ে জানতে পারে, বাস নাবিস্কো-তিব্বত হয়ে সোজা চলে যাবে মগবাজারের দিকে। ফার্মগেটে গেলে মহাখালী মোড়ে নামতে হবে। ওদিকে আর না গিয়ে মালিবাগ মোড়ের ভাড়া কাটে ফালান। সিনেমা না হয় আরেকদিন দেখা যাবে। বস তাকে এক লাখ টাকা দেবে দৃশ্যটা চোখের সামনে ঝুলতে থাকলে তার মনে হয়, দুনিয়ায় সত্যিই অনেক ভালো মানুষ আছে। মাস চার-পাঁচ হতে চললো, দু'বেলা করে বসের বডি ম্যাসেজ করে দিচ্ছে। আর তাতেই কেল্লাফতের মতো একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। কোটিপতি মানুষ, অর্থ-সম্পদের অভাব নেই। তার দিকে একটু নজর দিলেই ভেসে যায়। মালিবাগ মোড়ে নেমে ফালান শান্তিবাগের ভেতরে ঢোকার রাস্তায় পা রাখে। বাজারের কাছাকাছি গেলে বাঁদিকের গলির ভেতর এক বস্তিবাড়ি। বস তাকে এক লাখ টাকা দেবে। কথাটা এখন মর্জিনার মাকে বলবে না। গুলশানে কাজ পাওয়ার আগে তার কাছেই ছিল সে। মহিলা প্লাস্টিকের বক্সে খাবার ভরে সাপ্লাই দেয় পল্টন-মতিঝিলের অফিসে অফিসে। ফালান সে খাবার রিকশায় করে পেঁৗছে দিতো জায়গায় জায়গায়। মর্জিনা মায়ের এক ভাতিজি আছে। জ্যোৎস্না। গায়ের রঙ অবশ্য ফকফকে না হলেও চেহারাটা দারুণ। সিনেমার নায়িকাদের মতন। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর চাকরি করে মিরপুরের কোনো এক গার্মেন্ট কারখানায়। বোরখা পরে মাঝে মধ্যে ফুফুর কাছে আসতো। ওকে দেখলে ফালানের শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বসের টাকাটা হাতে পেলেই সাহস করে প্রস্তাবটা দিয়ে বসবে। শান্তিবাগের চিপা গলিতে পা রেখে ফালান অবাক। সেই বস্তিবাড়ির টিনশেডের লম্বা ঘরগুলো আর নেই, বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন উঠছে। গলির পরিচিতি মুদি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, মর্জিনার মা এখন খিলগাঁওয়ের ওদিকে থাকে। ঠিকানাটা জানা নেই। ৩. পরদিন যথারীতি বসের থলথলে বডি ম্যাসেজে ব্যস্ত ফালান। এক পর্যায়ে না বলে পারে না_ স্যার, সত্যিই আমারে এক লাখ টাকা দেবেন? : ক্যান তোর বিশ্বাস হচ্ছে না! তাইলে সামনে আয়। বখশিশটা নে। বসের কথামতো ফালান তার সামনে এসে দাঁড়ায়। : এবার ঘুরে দাঁড়া। ঘুরে দাঁড়ানো মাত্রই পাছায় আচমকা লাথি খেয়ে ফালান প্রায় ছিটকে পড়ে কেয়ারি করা দোলনচাঁপা ঝাড়ের পাশে। ঘাড় ফেরাতেই বসের উৎফুল্ল মুখটা ঠিক কসাইয়ের চাপাটি হয়ে কোপ বসায়_ বিয়া করবার খুব শখ জাগছে? (Ref: the daily Jaijai din)

No comments:

Post a Comment