Friday, 13 July 2012

বাংলা কবিতায় মনবর্ষা

ষ মাতিয়ার রাফায়েল দক্ষিণ এশিয়ার বর্ষা, ধ্রুপদ ভারতবর্ষের এক অনতিরম্য পরিচয়। আচম্বিতেই যে অপূর্ব নীলিমাজুড়ে কীসব মেঘের আবর্জনায় ভরে ওঠে মধ্যআকাশ, ঈষাণে-নৈর্ঋতে, সে যদি শুধুই কার্পাসমতো মেঘের আবর্জনা হতো কে ভালোবাসতো আকাশের ওই রূপকে! প্রচ- ঝড়ের কু-লী সৃষ্টির মধ্যদিয়ে যে বৃষ্টির পূর্বাভাস দমকে দমকে ওঠে আকাশের ওই রূপটিতে, তা-ই ঝমঝমিয়ে, রিমঝিমিয়ে বৃষ্টি হয়ে আসে। তাতে যে সৃষ্টির সকল প্রাণের স্বার্থ নিহিত। প্রাগ্জ্যোতিষপুর বা হিমালয়দূহিতা যতো নদী আছে, নদীশাখা আছে, মেঘমল্লার আছে, এগুলো ভারত উপমহাদেশকে এমন এক অনন্য ও অনবদ্য সুপ্তিসুষমা এনে দিয়েছে যে বর্ষা শেষেও প্রতিটি তনুকূপে প্রাণের কান্তি ধরে রাখে। জ্যৈষ্ঠের গরমঠাপে প্রাণ যখন তেলাপোকার মতো উল্টান ভাঁজামাছ বিশেষ, কাঁঠালের কাটা বেঁধা প্রাণের টানে তখনই ধেয়ে আসে আদিগন্তমাঠজুড়ে ঝিরিঝিরি রিমঝিম ঋতুবর্ষা। কী এক উদ্বেগমাখা বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুরে, বিলে ও নদীতে। আবার বৃষ্টি থামতেই সহসা বিবিধ ফড়িংগুলোও উড়ছে যদৃচ্ছাক্রমে এখানে ওখানে। কখনও বা গিয়ে বসছে কোনো বাঁশের মাথায়। খড়ের ঢিবির মাঝে যে বাঁশ, সে বাঁশের মাথায়। বা কোনো দিগ্বালিকার বেনীপাকানো চুলের গুচ্ছে। এই যে চিত্রকল্পগুলো, সে গন্ডগাঁয়ের। যারা ধরে রেখেছে এখনও বৃষ্টির তুমুল অধিকার। নগরের চিত্রদর্শন নিশ্চয় অন্যমতো ছিলো। যে নগরগুলো ছিলো দূরে অদূরে প্রাকার বেষ্টিত চকমিলান জাতীয় অবকাঠামো সৃষ্ট। তার দেখা বর্ষা নিশ্চয় অভিজাত। বর্ষা অনুভবে, উপলব্ধিতে যতোই মনোরম হোক, তাতে তবুও কতো যে বিড়ম্বনা, সে অজগাঁ হোক কি গন্ডগাঁ, সে সকল যাপিতজীবনের অধিবাসীরাই শুধু জানতেন। বৃষ্টি উদ্ভুত সে বিড়ম্বনার মধ্যেই যে সৌন্দর্যটুকু, সেটাই বর্ষার প্রকৃত সৌন্দর্য। এর সাথে কবেই তো চির বিচ্ছেদ ঘটেছে বাংলা কবি ও কবিতার। সো মহ কন্তা দূর দিগন্তা। পাউস আএ চেলু দুলাএ ওই যে আমার কান্ত, দূরে দিগন্তে। বর্ষা আইলো ফের আঁচল দুলায়ে কালের পাতায় ওই একটি মাত্র পঙ্ক্তিতে টিকে থাকা অন্তর্গত যে 'রসবস্তু', সে যেন দূর আকাশে হারিয়ে চিরস্থির এক চিলতে মেঘের রেখায় জিইয়ে রইছে এখনও এতটুকুন 'আশা' হয়ে। পঙ্ক্তিটি হয়তো কোনোও অবহট্ঠপ্রাণা কিশোরী বধূ'র, বা প্রাকৃতের চৌকাঠে সদ্য পা রাখা কোনো তরুণীবধূর। বা সে কোনও প্রাণচঞ্চল দিগ্বালিকারও হতে পারে। বাক্যটির রচয়িতা কে, কোনও 'গোষ্ঠীস্মৃতি'ও ধরে রাখলো না তাকে। কিন্তু যতোদিন বাংলার মাটি বর্ষণসিক্ত হতে থাকবে ততোদিন ওই পঙ্ক্তিটির আবেদন থাকবেই। কেননা, পঙ্ক্তিটি যে কালের অভ্ররঙা পৃষ্ঠায় দুটি চিরায়ত পঙ্ক্তি! পঙ্ক্তি দুটিতে হয়তো আরও দু'একটি পঙ্ক্তি ছিলো, কিন্তু সে পঙ্ক্তি চিরকালের জন্যই হারিয়ে গেছে! সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সংস্কৃত ভাষার বিপরীতে এতদ্দেশীয় বাংলারই পূর্বজ ভাষা অবহট্ঠ ভাষায় একরকম পেলব শ্বসাঘাতি উচ্চারণে তৎকালীন লোকজীবনে অনেক পঙ্ক্তি রচিত হয়ে থাকবে। উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিযুগল তারই নিবিড় আত্মীয় বিশেষ। ওই পঙ্ক্তি যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলার লোকজীবনে পরিপুষ্ট ছিলো, ফি বছর মেঘের বার্তায় তারই অনতিউচ্চ সাক্ষী হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'বর্ষা' কবিতায় পুনরায় ধরে রাখলেন : কোন মোহিনীর ওড়না সে আজ উড়িয়ে এনেছে, পূবে হাওয়ায় ঘুমিয়ে আমার অঙ্গে হেনেছে; চম্কে দেখি চক্ষে মুখে লেগেছে এক রাশ, ঘুম-ভাঙানো কেয়ার রেণু, কদম ফুলের বাস। সেই অবট্ঠের যুগরসে সিক্ত হতে হতে গড়ে ওঠা নতুন 'প্রাকৃত বাংলা' কবিতার ভাব প্রকাশেও একটা কাঠামো পেয়ে গেলো। গীতের আবহে প্রকাশিত এসব পঙ্ক্তিগুচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী গ্রামবাংলার লোকজীবনকে নিমগ্ন রেখে গেছে। কালপরিক্রমায় হাজার হাজার পঙ্ক্তি রচয়িতারা সহসা কবেই লুপ্ত। যেসব পঙ্ক্তি রচয়িতারা প্রধান পঙ্ক্তি রচয়িতাদের তুলনায় গৌণ হয়ে পড়েন, তাদের পঙ্ক্তি 'অজ্ঞাতনামা' পরিচয়ে লোকমুখে কিছুকাল প্রচলিত থাকলেও কালক্রমে একসময় লুপ্ত হয়ে যায়। তখন তো আর কবিদের 'কবরস্থান' বলে কোনো 'এন্থলজি'র সুযোগ ছিলো না। সেই লুপ্তি থেকে বেঁচে যাওয়া ওই পঙ্ক্তিদুটোতে যে সাক্ষ্য বহন করে সেটা সে পঙ্ক্তির ভাষাগত নমনীয়তা। যে নমনীয়তার মধ্যদিয়ে চর্যাগীতিকা'র মতো, গীতগোবিন্দ'র মতো বৃষ্টিবর্ষিত 'ললিতলবঙ্গলতা'র মতো 'পরিশীলিত' কাব্য সম্ভব হয়ে উঠেছিলো। মেঘৈর্মেদুরমসুরং বনভূবঃ শ্যামান্তমালদ্রুমৈর্নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়। ইত্থং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জদ্রুমং রাধামাধবয়োর্জয়তি যমুনাকূলে রহঃ কেলয়ঃ মেঘে মেদুরা এই সে আকাশ, তমালগুচ্ছে শ্যামাচ্ছন্নবনভূমি। রাত্রিমতো, সে এই ভীরু, তাকে পৌঁছে দিওগ' গৃহে তুমি রাধে এমতো নন্দনিদেশে চলে রাধামাধবের কুঞ্জকেলি প্রতিটি কদমে পথে পথে যায় তরুচ্ছায়, যমুনাজঘনে জয়, জয় হরি জয়দেব (১২শতক, শেষপাদ), 'প্রাকৃত ভাষা'র উত্তমমার্গীয় কবি। তিনি যে গীতগোবিন্দ লিখেছেন, তাতে এত যে বর্ষার তুমুল মাদকরসে সিক্ত কাব্যস্ফূর্তি, ঘন বর্ষায় ডাক দিয়ে ওঠা যে রাধামাধব, বাংলায় যতো পঙ্ক্তিগুচ্ছ রচিত হতে থাকবে তার ভিতরে সে কীর্তি এক কালোত্তীর্ণ গাথামলি্লকা হয়ে থাকবে। কালিদাসের পাশে যদি কাউকে আসন দিতে হয় তা'হলে সে জয়দেবেরই সহজ প্রাপণীয়। তার পঙ্ক্তিগুচ্ছে সেকালের সহজ চিত্রকল্প যেমতো উঠে আসতে দেখা যায়, সেখানে তদানীন্তন প্রতিচ্ছবি এমতো ফুটে যে তাতে আমাদের অন্তরাত্মা মহূর্তে অনড় অচলবৎ থমকে দেয়। প্রতিটি মগজের কানায় কানায়। তা'হলে সেই বর্ষার চিত্রকল্প কি এখন আর মেঘে মেঘে ওড়ে আসা-যাওয়া করছে না আর! মেঘের কি আর সে থেকে মুক্তির উপায় আছে! সে বর্ষিত কবিতারও নেই। তবুও কোথায় যেন কী এক মেরুদুস্তর ব্যবধান। সে কি সময়ের, নাকি যাপনেরও! এই যাপনগুচ্ছগুলিই যেন সেই বর্ষার সাথে কিছুতেই মেলানো যায় না। দূর দিগন্তে মেঘ তো এখনও 'চেলু দুলাএ' দুলাএ ঘুড্ডীন ঠিকই, তবু মেঘের কোণে দৃষ্টি রাখা সেই কান্ত কান্তা কই? বর্ষার কার্পাস তো পৃথিবীর সব আকাশেই তার ঋতুর অবকাশে ঘুরে ঘুরে চরছে ফিরছে। তাতে আমাদের এই অঞ্চলে আর নতুন কি! যে প্রাণ ফুরিয়ে আসে তার জন্যে হয়তো নতুন কিছু নয়, কিন্তু যে প্রাণ নতুন করে উজয়, তার জন্য তো নতুনই বটে। তখন ফুরিয়ে যাওয়া প্রাণে যতোই জড়তা এসে ভর করুক, বর্ষার তাতে বিন্দুমাত্র বিচলন নাই, বছরে তার মাত্র একবারের স্পর্শে যে নতুন প্রাণের স্ফূর্তি দেখা দেয় তাতেই প্রাণের তারুণ্য চির চঞ্চল থাকে। বর্ষাজনিত এই প্রাণের স্ফূর্তিতেই এই ভারত উপমহাদেশে যতো বৃক্ষ ও লতাগুল্মের উচ্ছ্রিতির প্রকাশ পেয়েছে পৃথিবীর আর কোথাওই এর নজীর নাই। ফলে বর্ষা পৃথিবীর সর্বত্রই ঘুরে ঘুরে বেড়াক, আমাদের এই অঞ্চলে এই বর্ষা চির নবীন। চির নবীন যে তার সাক্ষর মেলে বর্ষা ঘিরে যতো কবিতা হয়েছে, তার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশগুলোর দিকে যদি আমাদের নজর যায়। কালিদাস (৪র্থ-৫ম শতক), সংস্কৃত ভাষার কবি। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের অনবদ্য এক কাব্য নিদর্শন। মেঘদূতম্। মন্দাক্রান্তায় বিন্যস্ত তার এক কাব্য চির নবীই যদি না হবে, আজও তার আবেদন সেই একই মনের চির নতুন নতুন মনে দ্রবিভূত হবে কেন? পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত কাব্যটি এ পর্যন্ত বাংলায়ও অনেকগুলো অনুদিত সংস্করণ বের হয়েছে। বাংলায় অনুদিত সেগুলোর মধ্যে এখনও পর্যন্ত যেটি সবচে' বেশি পঠিত ও আদৃত, সেটি সাত মাত্রায় রচিত বুদ্ধদেব বসু'র অনুবাদ। উচ্চ বিমানের অন্তঃপুরে যেথা তোমারই অনুরূপ মেঘেরা সততগতিশীল বায়ুর চালনায় অবাধে নীত হয় কখনো- স্বজলকণিকার সংক্রমণে তারা দূষিত ক'রে দিয়ে চিত্রাবলি, সদ্য শঙ্কায় পলায় বাতায়নে, ধোঁয়ার অনুকারে, শীর্ণ। উত্তরমেঘ-৭২ বর্ষা প্রকৃতির সৃষ্টিশীল বেদনার সর্বোৎকৃষ্টতম পরিণত রূপের প্রকাশ। বিপুল প্রাণৈশ্বর্য্যর ফসলে যে দুনিয়া হয়ে ওঠেছে বহু ভাষাময়, সে তো বর্ষারই আলেখ্যমালা। ক্রমেই দানবাতিদানব হয়ে উঠা নগরায়নের দেয়ালের পিঠে দেয়ালঢাকা প্রকোষ্ঠের ভিতরেও বৈষ্ণব পদাবলীর পুরা আকর থেকে এখনও মনে হবে গ্রামসন্ধ্যার ধোঁয়াটে মতো সেকালের সেই বর্ষণসিক্ত মাটির সোঁদাগন্ধ উঠে আসছে। যে মানুষ নিজেই প্রকৃতির একটি ক্ষুদে পরিচয়, বর্ষা তার মধ্যেই পল্লবিত হয়েছে প্রবল বটপি হয়ে কী বোধে কে জানে। বর্ষাপ্রাণে শক্তিমদমত্ত এ মানুষ এখন সে প্রকৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে কি আসে যায়, দেয়ালের পিঠে দেয়ালঢাকা প্রকোষ্ঠের মধ্যে যাপিতজীবনের অন্তঃস্থলেও যেরকম নকশায় পর্বতের গহীন অভ্যন্তরে সরীসৃপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া বর্ষার অবশিষ্ট সঞ্চিত জলধারার মতো প্রশান্তির স্পর্শ এনে দিতে পারে, গীতগোবিন্দ বৈষ্ণবপদাবলীও তাই। এমনই এক পটভূমিকায় ওই পদাবলীর প্রকাশ ঘটেছিলো যা ছিলো মাঠ তেপান্তরডোবা বর্ষার জলঘেরা গ্রামপাটাতন। তো, সে পদাবলী থেকে বর্ষণসিক্ত মাটির সোঁদাগন্ধ উঠে আসবে না তো কী আর উঠে আসবে? বাংলা কবিতা যেখানেই যাক, পদাবলীগুলো থাকবেই। অন্তত যতোদিন আষাঢ়-শ্রাবণ আছে, ততোদিন তো বটেই। বর্ষা যেমন পৃথিবীর জন্য প্রাণ সঞ্জিবনীই না, প্রাণভোমরা রূপ মৃতসঞ্জিবনীও। বাংলা কবিতার জন্য পদাবলীর ভা-ারও তাই। বৈষ্ণবপদাবলীতে যে বহুলউক্ত 'ব্রজনৌকা' পাই সেতো সেই আদিগন্ত জলমগ্ন বর্ষারই স্মারক। ব্রজবুলি ভাষার কবি এ কালপরিক্রমায় যারা উল্লেখযোগ্য ছিলেন, বড়ু চ-ীদাস (১৪ শতক), মৈথিল বিদ্যাপতি (১৪ শতক), বাঙালি বিদ্যাপতি, চ-ীদাস, বিজয়গুপ্ত, জ্ঞানদাস, মালাধর বসু, গোবিন্দ আচার্য, রায় রমানন্দ, বৃন্দাবন দাস, মুকুন্দ দত্ত, ময়ূরভট্ট প্রমুখ সহ আরোও বহু ব্রজবুলি'র পদাবলী রচয়িতা ছিলেন, যারা বাংলা কবিতাকে প্রকৃত অর্থেই বর্ষাসিঞ্চন করে গিয়েছেন। কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৬ শতক), 'চ-িমঙ্গলে'র অবিস্মরণীয় কবি। 'কালকেতু'র মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা তার ওই কাব্যকীর্তিটিও বর্ষাজলমগ্ন এমনই এক ভূপ্রকৃতির চিত্রসূত্র খোলে দেয়, যার মধ্যদিয়ে অনায়াসেই প্রবেশসাধ্য হয়ে ওঠে তৎকালীন বাংলার সামাজিক ও সংস্কৃতিক পাটাতনটিতে। শিল্পকুশলতায় যেখানে কবি একান্তই নিজস্বস্বরে ভাস্বর, এই নিজস্বতায় যদি তিনি আরেকটু অগ্রসর হয়ে ঝরঝরে গদ্যভাষী হয়ে উঠতেন, তা হলে সেটা চিরকালের জন্য সময়ের এক অনবদ্য পরিচয়বাহী হিসেব বাংলার চরিত্রচিত্রণ হয়ে দেখা দিতো। কিন্তু তার ঝরঝরে কাব্যভাষই বা কম কি সে! এটি হচ্ছে পদ্যে রচিত এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত বাংলায় প্রথম উপন্যাস। সে গেলো বাংলা কবিতা আধুনিক চোখে পুষ্ট হওয়ার পূর্বকালের কাব্যপরিচিতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে তাঁর কবিতায় বর্ষা দ্বারা বিপুল উজ্জীবিত হয়েছিলেন সে ছিলো কবি হিসেবে তিনি মনের দিক থেকে বাংলা কবিতার ধারাতেই পুষ্ট থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে কবিতা যদি বৈষ্ণব পদাবলী সময়ের কাব্যের মতো জলদমগ্ন না থাকে তা'হলে তা কালের অাঁচরে শুখায়ে কাঠ হয়ে যাবে। 'বর্ষামঙ্গল' বইটির নামকরণের মধ্যদিয়েও বোঝা যায় কবি হিসেবে পূর্ববর্তী কবিদের মানসলোক দ্বারা তিনি কতটা ঐতিহ্যানুসারী ছিলেন। তিরিশি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কাল থেকে শুরু হয়ে অদ্যাবধি যা অকল্পনীয় বলে বিবেচিত। অনুকরণ করা যাবে, তবে তা রবীন্দ্রযুগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। তার পরবর্তী কারো কাব্যবৈশিষ্ট্য দ্বারা নয়। বর্ষা প্রকৃতি নিয়ে বাংলাভাষায় প্রচুর গদ্যপদ্য হয়েছে। কবিতাও। বর্ষা নিয়ে রচিত কবিতার মধ্য দিয়েই প্রকৃত কবির অন্তঃস্থ শক্তিমত্তা বোঝা যায়। কবিতার সাথে কেননা বর্ষার সম্পর্কটি স্বাভাবিকভাবেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বৃষ্টি বা বর্ষা যেমন পৃথিবীর সকল শস্য, ফল, ও প্রকৃতির প্রাণ উজ্জীবনী শক্তি, কবিতাও সেরকম পৃথিবীর সকল ভাষার প্রাণ উজ্জীবনী শক্তি বিশেষ। বর্ষা নিয়ে রচিত কবিতার অধিকাংশেই 'নারী' উপস্থিতি অত্যন্ত প্রবল। সেক্ষেত্রে নারী কবি রচিত বর্ষা বিষয়ক কবিতায় 'পুরুষ' উপস্থিতি অত্যন্তই কৃপণ। সেখানে প্রকৃতিদৃশ্যই উঠে আসছে বেশি। কবিতায় ভুলে যাওয়া হয় 'পুরুষ'সত্তা যে প্রকৃতির মোটেও বাইরের কোনও সত্তা নয়। সে যেভাবে প্রকাশিত সেটা যে প্রকৃতির স্বরূপেই প্রকাশিত এবং যেভাবেই প্রকাশিত সেভাবেই যে তা কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে, বাংলা কবিতায় যেন তা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে। ফলত বর্ষা বিষয়ক অধিকাংশ কবিতায় যা উঠে এসেছে তার অধিকাংশই মূলত আরোপিত ও বহু কষ্টকল্পিত ভাবোদ্রেক বিশেষ। যে কারণে বর্ষা বিষয়ক কবিতার সামগ্রিক পাটাতনটি এখনও পর্যন্ত বাংলা কবিতায় সহজাত হয়ে উঠতে পারেনি। কারো কারো কবিতায় 'পুরুষ' উঠে আসতে দেখা গেছে চটুল ও বিকৃতরূপে। সহজাত রূপে নয়। স্বয়ং কবিও নিশ্চয় যেটির সাথে বিশ্বস্ত তো ননই, বরং সে কবি'র সাথে যোগাযোগ ঘটলে দেখা যাবে এ আসলে প্রতারণার মোড়কে ঢাকা। যেন সেই বৃষ্টির মতো এ এক অবিশ্বস্ত কবি, যেমন কোথাও হঠাৎ 'এসিড বৃষ্টি' বর্ষিত হলো, ফসলের অনেক ক্ষতিসাধন করলো, সেরকম প্রকৃতিবিরুদ্ধ প্রকৃতি যে কবি'র কবিতায় দেখা দেয় তা কারো কাছে তথ্যের জন্য চকিত চমকপ্রদ হলেও নিশ্চয় সহজ ও স্থায়ী প্রীতিকর কোনও সৃষ্টিশীলতা নয়। ফলে এহেনকার কবিতায় কান্তা যেভাবেই হোক, আছে যদ্যপি, কিন্তু কান্ত দূর অস্ত অপসৃত। সৈয়দ আলী আহসান 'আমার পূর্ব বাংলা' নামে যে অনবদ্য কবিতাটি রচনা করেছেন, সেটি সমগ্র বাংলা কবিতায় অন্যতম প্রধানের একটি। বর্ষার যে সহজাততা, বর্ষাপ্রাণের মধ্যদিয়ে প্রকৃতি যেভাবে বাঙ্ময় ও লালিত্যাভিসারী হয়ে উঠে চির জাগরুক থাকে, তার শ্যামল চিত্রালেখ্যই 'আমার পূর্ব বাংলা'। কবিতায় প্রকৃতির সাবলীল সুরটি সৈয়দের কবিতায় এতাবৎ সুচারুরূপে অঙ্কিত ও প্রতিবিম্বিত হয় যে, বাংলা কবিতায় এর দৃষ্টান্ত বিরল । সহজ ও স্থায়ী প্রীতিকর কবিতা বলতে যা বোঝায় কবিতাটি তারই একটি অনবদ্য পরিচয়। গ্রামবাংলার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ষাচিত্র অাঁকার ক্ষেত্রে জসিমউদদীন গ্রামীণ জীবনধারাকে যেরকম সহজাত ও সাবলীলভাবে বিন্যস্ত করতে পেরেছেন, তা বাংলা কবিতায় এখন কষ্টকল্পিত করেও সম্ভব নয়। জীবনানন্দ দাশের 'রূপসি বাংলা'য় চিরায়ত বর্ষাপুষ্ট যে গ্রামীণ পটভূমি উঠে আসে তার সাথেও শহুরে জীবনধারার সাথে ক্রমেই একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও অজিত দত্ত বর্ষাবিদায়ী বেদনারম্য শরতের মধ্যে খুঁজেন বৃষ্টির শৃষ্টিশীল উৎপাদনমুখিতা। সুধীন প্রাণের উৎসে বৃষ্টির যে সার্বভৌম প্রেরণা, তা তিনি তার 'শাশ্বতী' কবিতায় কল্পনার যে পরিপাটীত্ব দেখান, রন্ধ্রে রন্ধ্রে এতো নিবিড় গহীন গভীরতাসঞ্চারী যে, তাতে করে এই শৈলী বাংলা কবিতায় চিরায়তের মর্যাদা বহন করে যাবে। স্মৃতি পিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা; সে ভুলে ভুলক, কোটি মন্বন্তরে আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না। শাশ্বতী, অর্কেস্ট্রা অজিত দত্ত বর্ষাশেষে শরতের মধ্যে মৃতের যে পুনঃপ্রাণের আকাঙ্ক্ষা উড্ডীন মেঘের ছায়ায় শীতল হতে চায়, পুনশ্চ পরিক্রমায় ফিরে আসার প্রত্যাশায় তারই এক নিবিড় উদ্ঘাটনা 'মেঘচ্ছায়া' কবিতায় রেখে যায়। শরৎ মেঘের সি্নগ্ধ ছায়াগুলি চলে যায় উড়ে আমার বিশ্রাম হতে, আমার পৃথিবী থেকে দূরে। ...................................................... সেই মৃত্যু কাছে আসে মেঘগুলি যতদূর চলে আমারে বঞ্চিত ক'রে শীতল চঞ্চল ছায়াতলে। মেঘচ্ছায়া, জানালা আল মাহমুদের কবিতায় বর্ষা ও তার পরিপ্রেক্ষিতে যে লোকজীবন, লোকজীবনের সাথে যে নগরজীবনের মিশেল তাও বেশ সহজাত হয়ে দেখা দেয়। কবিতায় তিরিশোত্তর, চলি্লশোত্তর কবিদের পর যাঁরা আন্তরিক তিনি থাকবেন তাঁদের শিরোভাগে। কবিতার যে ভাষিক প্রগাঢ় নিবিড়িত্ব, তাঁর কবিতায় সেটা লক্ষ করলেই সে আন্দাজ হতে পারে। কবিতার মেজাজ ও রুচি এখন দ্রুত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল ঠিক নয়, আরোপিত পরিবর্তনশীল। কিন্তু বর্ষা তো আর আরোপিত হতে পারে না। ফলে চাইলেও যেন কবিতা থেকে বর্ষা সরানো যাচ্ছে না। ঘুরে ফিরে যেভাবেই হোক কবিতায় বর্ষা আসছেই। বর্ষার ওপর সাবলীল কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রকৃতপ্রস্তাবে বিষয় বা চিত্রকল্পের ওপর কবির আন্তরিকতাই মুখ্য শর্ত। সেই সঙ্গে কবির জীবনযাপনের ধরনটির প্রতিফলন তো থাকবেই। এই আন্তরিকতার বিষয়টি জসিমউদদীনের কবিতায় সহজ প্রাপণীয়। চলমান সময়ের ওপর দিয়ে যাওয়া কবির জীবনধারা বদলালেও বর্ষা বা প্রকৃতির প্রকাশ কিন্তু সেই আগের মতোই আছে। ফলে এই কবিতায় এই দুয়ের সাম্য বজায় রাখা মোটেও সহজসাধ্য নয়। কাঁচের ভিতর থেকে, বা চশমার ভিতর থেকে বর্ষা দেখার প্রকৃতি যে রকম রোমান্টিক হবে, কাঁচের বাইরে সে কখনওই হওয়ার নয়। কবিতায় জীবনধারার বাহ্যপ্রভাব ও আন্তঃপ্রভাবের একটা সম্মিলন তো ঘটাতে হবেই। তা-ই যদি না ঘটলো, সেতো আর কবির আন্তরিকতায় বিশ্বস্ততার সাথে উত্তীর্ণ হলো না। ফরহাদ মজহারের ' মেঘ মেশিনের সঙ্গীত' কবিতায় সে আকাঙ্ক্ষারই আকুতি উঠে আসতে দেখা যায়। মেঘ তুমি বালকের ভাষা আদিম উদ্দীপনা মেঘ তুমি আদি স্মৃতি যখন এখানে উৎসাহ ছিল, ছিল পরিকল্পনা ছিল নির্মাণরীতি .................................................. তবে কথা বলো মেঘ, কথা বলো বৃষ্টির অক্ষরে কথা বলো উচ্চাসা মেঘ মেশিনের সঙ্গীত আজকালকার প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের অধিকাংশই তো নাগরিক জীবনধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে তার কবিতায় সে যাপনধারার বিশ্বস্ততা না থাকে কি করে। বিরেন চট্টোপাধ্যায়ের 'বর্ষা' কবিতায় সে চিত্রটি খুবই সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিশ্বস্ত থাকতে দেখা যায়। আষাঢ় এসে ভীষণ জোরে দুয়ারে দিল নাড়া- শীর্ণ হাতে শিশুরা খোলে খিল বৃষ্টি, লখিন্দর সমকালীন অভিজ্ঞতায় বর্ষার ওপর যেসব বাংলা কবিতা লেখা হচ্ছে, সেখানে কবির সেরকম বিশ্বস্ততা খুব কমই উপস্থিত। স্মরণযোগ্য তো নয়ই, খুব কম লেখাই আছে যেগুলো চকিত আবেদনময় হয়ে উঠতে পারে। কবিতায় কবির আন্তরিকতার সুরটি না থাকাতেই কেমন যেন বেসুরো লাগে। বলতে কি, ষাট উত্তরকালে বাংলা কবিতায় এই আন্তরিকতার সুরটি উঠেই গেছে বলতে হয়। এর প্রভাবটি বর্ষা কেন্দ্রিক কবিতায়ও এসে পড়েছে। তবুও এর মধ্যদিয়েই কিছু কবিতা আছে, যাতে বর্ষার ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। আবিদ আজাদের কবিতা, 'বৃষ্টি'। 'টাপুরটুপুর টাইপরাইটারের শব্দে বৃষ্টি নামলো সারা মতিঝিলে বৃষ্টি নামলো রিমঝিম রিমঝিম কমার্স বিল্ডিংয়ের ছাদে বৃষ্টি নামলো দোতলার তেতলার সারি সারি জানালার শার্সিজুড়ে-' বনতরুদের মর্ম শহুরে জীবনাধায় যেভাবে বৃষ্টি দেখা দেয় তারই চিত্রাবলি আবিদের ওই কবিতাটি। পিচঢালা পথে বৃষ্টিপতনের সাথে কেরানিজীবনের টাইপটারের শব্দের সাথে এই যে সম্প্রীতি, তা এক কথায় অভাবিত। কেরানিজীবনের যেমন কোনো সৃষ্টিশীল উত্থান নেই, তেমনি শহরের পিচঢালা পথে, উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদে বৃষ্টি পতনের সাথেও কোনো সৃষ্টিশীলতার সম্পর্ক নেই। শহরের এই বৃষ্টি স্রেফ গ্রীষ্মের দাবদাহে আইঢাই প্রাণে একটু শীতল পরশ ছুঁয়ে যায় মাত্র। কিছু ক্ষেত্রে অতিরেক দুষ্টতা মেনেও কবিতাটি বৃষ্টিবান্ধব গ্রামীণ কর্মব্যস্ততা, জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন এক শহুরে জীবনধারার চিত্রকল্প তুলে আনার মধ্যে কবি যে ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করলেন বাংলা কবিতায় তা প্রশংসনীয় হয়ে থাকবে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছেন, 'বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা'। তাঁর কবিতাও আধা গ্রামীণ আবহম-িত বর্ষাজলদ সি্নগ্ধভাষে পূর্ণ। অতি শিক্ষিত নাগরিক চোখে দেখা বর্ষার প্রকৃতি শামসুর রাহমানে যেরকম পরিপাটী হয়ে আসে বর্ষাও নিশ্চয় ততো স্তরে স্তরে পরিপাটীরূপ ফলে না। শহরের জীবনধারার সাথে বৃষ্টি কিভাবে আসতে পারে, তা সৈয়দ শামসুল হকের 'বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা'তেও উঠে আসতে দেখা গেছে। উত্তরকালে এসে বাঙ্গালা কবিদের জীবনধারা হয়ে পড়ে দ্বিধান্বিত। ফেলে আসা গ্রাম তার কাছে আত্মপরিচয়ের সঙ্কট হয়ে উঠছে। সে স্মৃতিও মোটরকারের ওপর বা জানালার শার্সির ওপর পতিত বৃষ্টিদৃশ্যের মতো ঝাপসা। নিকট থেকেই কিছু দেখা যাচ্ছে না বলে দূর থেকে কি আর দেখা যাবে। এভাবে কবিতায় বর্ষার সহজ প্রকাশ হয়ে পড়ে নিরতিশয় খ-িত। 'বর্ষামন' বলে যে গূঢ়ৈষা থাকবে কবিতার কানায় কানায়, তা অনুপস্থিত। নিরেট বায়বীয় মনস্ক এসব কবিতায় রাধা'র অগণন নয়া উপস্থিতি আছে বটে, এবং তা যতোটা প্রকট, ততোটা সহজ কিন্তু 'কাহ্নু' নেই। এই বায়বীয় মনস্ক 'কাহ্নু' কবি নিজেই। এক ধরনের টেকনোপোয়েট্রি বিন্যাসের মধ্যদিয়ে যেখানে 'কবিপুরুষ' নিজেই নিজের 'প্যারোডি' হয়ে আসছেন বারবার। এই পীড়ন কতো আর সহ্য করা যায়। কবিতায় কবির কোনো দ্বিতীয়, তৃতীয় 'পুরুষ' নেই। 'ব্যক্তি'র ভিতরে অবজেক্টিভিটি বা 'সমগ্রতা' দেখতে চাওয়ায় এক রকম মাত্রা আর 'সমগ্রতা'র মধ্যে 'ব্যক্তি'কে সন্ধান করার ভিতরে যে আরেক রকম মাত্রা উঠে আসবে সেটাই তো মূলক। উৎকট ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পীড়নে কবিতায় এ দু'টোর মেলবন্ধনই যদি অনুপস্থিত থাকে, তো সে কাব্যভাষ খ-িত না হয়ে উপায় আছে? কি করে সে কবিতা প্রকৃতই বর্ষাবান্ধব হয়ে উঠবে? ফলে বলতে হচ্ছে এ বয়ানই বাড়তি, যে এধরনের কবিতায় নতুন কোনো মাত্রা বয়ে আনতে পারেনি।ুদ

No comments:

Post a Comment