Friday, 13 July 2012

আত্মজীবনী লেখার সাহস হয় না

প্রশ্ন: একদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, এখনকার কবিরা কোথায়? এই অভিব্যক্তির তাৎপর্যটা একটু খুলে বলবেন? আল মাহমুদ: কথাটা বলেছি—কারণ কবিদের কোলাহল তো শুনি না। নিশ্চয়ই তাঁরা আছেন। কিন্তু আগে যেমন আমি আজিজ মার্কেটে ঘুরে কিংবা নানা জায়গা থেকে কবিতার বই সংগ্রহ করে নিয়ে আসতাম, লিটল ম্যাগাজিন পড়তাম, এখন তো সেসব পারি না। আমার বয়স হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষ। আমি চোখেও দেখি না। যাইও না কোথাও। একসময় আমরা বন্ধুরা, যেমন—শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান ও ফজল শাহাবুদ্দীন বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিয়েছি, দাপিয়ে বেড়িয়েছি গোটা শহরটায়। তখন আমাদের শোরগোলটা কিন্তু ছিল চারদিকে। এখন কি কবিদের সেরকম সদর্প পদচারণা আছে! বুঝতে পারি না। প্রশ্ন: বাংলা ছোটগল্প অনেক দূর এগিয়েছে। তবু এখনো, রবীন্দ্রনাথের ছোটপ্রাণ ছোট ব্যথাকে গল্পের পরিচয় নির্ণয়ে সামনে আনা হয়। আপনি, কবি আবার গল্পকার আল মাহমুদও কম শক্তিশালী নয়; ওই সংজ্ঞা আজও কতটুকু প্রাসঙ্গিক মনে করেন? আল মাহমুদ: (মৃদু হেসে) না, আমি কবি হিসেবেই কাজ করেছি। গল্পকার হিসেবে যারা বড় করে দেখে আমাকে, তারা ভালোবেসে বলে। তবে রবীন্দ্রনাথের সেই কথাকে এখন আর আমি মানি না। তিনি ছোটগল্পের যে ফর্মের কথা বলেছেন, এটা তো মানা যায় না। এটা এখন আমাদের ওপর চাপানো উচিত না। উনি আমার প্রিয় লেখক, তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রাচুর্য আছে। নজরুলও আমার প্রিয়। বাংলা ভাষার জন্য অত্যন্ত দরকারি ছিল কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। এটা আমি অনুভব করি। তাঁর একটা কবিতা আছে—‘বল বীর, বল উন্নত মম শির...’; কবিতাটির সমতুল্য কবিতা ওই সময়ে বা পরেও দেখা যায় না। এসব একবারই হয়। বাংলা সাহিত্যে এটা অসাধারণ সৃষ্টি। প্রশ্ন: কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা কতখানি? আল মাহমুদ: আরে, ছন্দ ছাড়া কি কবিতা হয়? আমি তো লিরিকের মানুষ। গীতিপ্রবণতা আমার স্বভাবগত। আমি আসলে ছন্দে আছি, গন্ধেও আছি। প্রশ্ন: কবির জীবন কি হবে শুধু উদাসীন, ছন্নছাড়া আর পাগলটে? আল মাহমুদ: কবিদের জীবনযাপন পাগলের মতো কেন হবে? তারা তো পাগল না। হ্যাঁ, বড়জোর বলতে পারো—উদাসীন। উদাসীনতা কবিদের স্বভাবের মধ্যেই পড়ে। এটাকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। কবিতার কারণে জীবন সফল হয় না, তা নয়। আমি একবার বলেছিলাম, যারা সাহিত্যচর্চা করে, আমি তো দেখি না কেউ খালি হাতে ফিরেছে। একটা প্রাপ্তি নিশ্চয়ই আছে। প্রশ্ন: সোনালি কাবিনে আপনি বলেছেন—পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা। আবার আপনার একটা বইয়ের নাম—সৌরভের কাছে পরাজিত! আল মাহমুদ: সৌরভের কাছে পরাজিত বইটি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে। না হলে তো গোলমাল হয়ে যায়। আগেই বলেছি, পরাজিত হয় না কবিরা। আমার সব সময় তা-ই মনে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমি পরাজিত নই। আই অ্যাম নট ডিফিটেড। সত্য-সুন্দর ও কল্যাণের পথেই তো কবিরা হাঁটেন। প্রশ্ন: কবিতায় গল্প-উপন্যাসে আপনি প্রেমের নানা রকম চিত্রায়ণ করেছেন। প্রেম বা ভালোবাসাটা কী ব্যাখা করতে পারেন? আল মাহমুদ: ভালোবাসা কী—এটা তো আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। এটুকু বুঝি ভালোবাসা একটা অবস্থা। যখন মানুষ কাউকে ভালোবাসে, তখন সেই ভালোবাসার মধ্যেই জিনিসটা উপলব্ধি করা যায়। প্রশ্ন: কবিরা তো ভালোবাসা ভাঙিয়েই খান, এটাই তাঁদের মূল শক্তি। এটা কতখানি সত্য? আল মাহমুদ: একটা কবিতা আছে—‘গাছ তোলে বুক ফুল তোলে বুক, সন্ধ্যা ভোরের আলোর বীণায়; সবাই মিলে গান ধরেছে, প্রেমের মতো আর কিছু নয়।’ এটা আমার মনে হয়। ভালোবাসার অপর নাম। জীবনে, এখন কবিতাই আমার একমাত্র ভালোবাসা। প্রশ্ন: আপনি এখনো তো প্রেমের কবিতা লিখছেন। এই বয়সে আপনার কি প্রেমে পড়তে বা ভালোবাসতে ইচ্ছে করে? আল মাহমুদ: এটা তো ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, অবস্থার ওপর হয়ে থাকে (স্বতঃস্ফূর্ত দীর্ঘ হাসি)...। এটা আসলে অনুভবের বিষয়। কেউ কেউ এখনো এসে বলে, ‘আপনাকে ভালোবাসি।’ কী আশ্চর্যের বিষয়! প্রশ্ন: সাহিত্যে—কবিতা বা গল্পে নিরীক্ষার যে প্রয়াস, এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? আল মাহমুদ: নিরীক্ষা-ফিরিক্ষা কী আবার? নিরীক্ষার ধার ধারি না আমি। সাহিত্য হচ্ছে চর্চার বিষয়। চর্চা করে যারা, তারা এর স্বাদ গ্রহণ করে। ভেতরে কী আছে, সেটা তারা উপলব্ধি করে। আর কবিতার জন্য পুরো জীবন কাজ করে যেতে হয়। আমি মনে করি সাহিত্য হচ্ছে মানুষের জন্য। সাহিত্য ব্যক্তিজীবনের জন্য স্বপ্ন। আমি সব সময় জীবন, মানুষ ও স্বদেশকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। আমি কল্যাণ চাই। চাই সুন্দর-স্বপ্নময় স্বদেশ। আমার লেখা পড়লেও সেটাই বোঝা যাবে। প্রশ্ন: আপনার অনেকগুলো কবিতার বই বেরিয়েছে। কিন্তু মানুষ কেবল সোনালি কাবিন-এর কথাই বলে। এটাকে আপনি কীভাবে বিবেচনা করেন? আল মাহমুদ: এটা তো হতেই পারে। এটার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। প্রশ্ন: কিছু লিখছেন? সময় কাটে কীভাবে? আল মাহমুদ: এই তো, ঘরে বসে থাকি। বাইরে তেমন যাই না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকি। শুয়ে থাকি। এই তো।

No comments:

Post a Comment