Friday, 13 July 2012

আমার আব্বা ড. শহীদুল্লাহ্র শেষ দিনগুলি

মা হ্ যূ যা হ ক ১৯৬৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পবিত্র রমজান মাসের শেষ সপ্তাহে আব্বার ইতেকাফে যাওয়ার দিন। তাই আব্বা ব্যস্ততার সঙ্গে সিএসপি পরীক্ষার খাতা দেখা শেষ করে নম্বর উঠিয়ে খামে ভরে সিল দিয়ে সফীকে বুঝিয়ে দিলেন যথাস্থানে পৌঁছানোর জন্য। আল্লাহর মর্জি, তিনি অসুস্থ হওয়ার আগেই এ কাজটি সমাধান করতে পেরেছিলেন। আমার মামাতো ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে। মেয়ের চাচাতো ভাই এসে তাকে জানালো, ‘দাদা আপনি বিয়ের উকিল হবেন।’ ছেলের তরফের লোক জানালো, ‘নানা আপনি বয়রাত যাবেন ছেলের সঙ্গে, যেহেতু আপনি ছেলের নানা।’ তিনি খুব খুশি হলেন। এর মধ্যে তাদের উপদেশ দিলেন, ‘তোমরা মোহাজের মানুষ, বিয়েতে কার্ড ছাপিয়ে টাকা নষ্ট করেছো কেন? লাল কালি দিয়ে হাতে লিখলেই তো পারতে!’ ওরা বললো, ‘আজকাল কেউ লাল কালি দিয়ে বিয়ের চিঠি লেখে না। বিয়েতে তো খরচ হবেই। তাতে আর কটা টাকা না হয় বেশি খরচ হবে।’ তিনি শুনে আর কিছু বললেন না। আছরের সময় হলে তিনি মাকে বললেন, ‘আমার বেডিংঝাঁপি গুছিয়ে রাখ। বাইরের পায়খানা ঘর পরিষ্কার করতে বলবে।’ তিনি এসব বলে বেগমবাজার মসজিদে চলে গেলেন। কতক্ষণ পর একজন মুসল্লি দৌড়ে এসে খবর দিল, ‘ডক্টর সাহেব নামাজের মধ্যে পড়ে গেছেন, আপনারা শিগগির আসুন।’ ভাইরা দৌড়ে গিয়ে ওঠানোর সময় তিনি বেআবরুর ভয়ে সামনের কাপড় চেপে রাখলেন। ভাইরা তাকে ঘরে আনলে তাকে চেয়ারে বসিয়ে তার মুখে পানি দেয়ার সময় ইশারায় দেখালেন তিনি রোজা আছেন। কথা বলতে পারলেন না। খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার নূরুল ইসলাম সাহেব এলেন। তিনি তাকে হাসপাতালে নেয়ার কথা বললেন। প্রথমে তিনি যেতে চাচ্ছিলেন না। তার মুখ দেখে বোঝা গেল। পরে মায়ের অনুরোধে রাজি হলেন। অসুস্থ হয়ে তিনি নীরবে মেনে নিলেন তার অসুস্থতাকে। চোখের পানি ফেললেন না বা বেশি অসহায় বোধ করলেন না। ওইদিন রাতের বেলায় দেখলেন তাঁর সেবকরা নিচে শুয়ে আছে আর তিনি পালংয়ে। তিনি জিদ ধরলেন—জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে শোব, ওপরে শোব না। তোমরা নিচে শুয়ে আছো, আর আমি ওপরে শোব? তা হতে পারে না। এটা অন্যায়।’ তিনি দু’রাত নিচে শুলেন। সফী এটা দেখে বুদ্ধি বের করলো, ‘বাবু এখানে অনেক ইঁদুর। আপনাকে তো কামড়ে দিতে পারে। আপনি অসুস্থ, আপনি ওপরে শোন। ইঁদুর কামড়াতে পারবে না।’ আব্বা বললেন, ‘আচ্ছা।’ জানুয়ারি মাসে রেজিস্ট্রার সাহেব এলেন তার পে বিল নিয়ে। তার পে বিলে দস্তখত নিতে। তিনি পে বিলে দস্তখত করতে পারলেন না। রেজিস্ট্রার সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি টিপ দিলেই হবে।’ তিনি রাগত স্বরে বললেন, ‘টিপ দিয়ে আমি টাকা নেব না। আমার টাকার দরকার নেই। আমাকে সরকার খাওয়াচ্ছেন। হাসপাতালে আছি, আমার টাকার কিসের দরকার?’ তিনি টিপ দিলেন না। আস্তে-ধীরে বললেন, ‘ভালো হয়ে নিই। বাম হাতে লেখার অভ্যাস করব।’ তিনি হাসপাতালে একাধারে আট মাস থাকাকালীন আমার মা হঠাত্ হার্টফেল করলেন। ডাক্তার নূরুল ইসলাম সাহেবকে জানানো হলে তিনি বললেন, ‘অবশ্যই তাকে এ খবর জানাতে হবে, তবে আস্তে আস্তে। তাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে, ইনজেকশন দিতে হবে, তার পরে।’ আমার ভাই সফী হাসপাতালে গেল। অসময়ে সফীকে হাসপাতালে দেখে তিনি ঘড়ি দেখে বললেন, ‘তুমি অসময়ে হাসপাতালে কেন?’ সফী বলল, ‘মায়ের শরীর খারাপ। সেজন্য ডাক্তারের কাছে এসেছি।’ সফীকে অনেকক্ষণ হাসপাতালে দেখে তিনি রাগ করে বললেন, ‘তোমার মায়ের অসুখ, তুমি হাসপাতালে ঘোরাফেরা করছো? যাও তাড়াতাড়ি তোমার মাকে দেখ গিয়ে।’ আস্তে আস্তে তার মৃত্যুর খবর তাকে জানানো হলে তার চোখ পানিতে ভরে গেল। বললেন, ‘ও! শি ওয়াজ এ পায়াস লেডি। ডাক্তার যদি যেতে দেন, তবে আমি তার জানাজায় শরিক হবো। এটা আমার কর্তব্য।’ ডাক্তার তাকে অনুমতি দিলেন, তিনি মায়ের জানাজায় শরিক হলেন এবং দাফনেও শরিক হয়েছিলেন। তার অসুস্থ অবস্থায় চোখের পানি দেখিনি। নীরবে মেনে নিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে বলতেন, ‘বিশ্রাম নিইনি, তাই এমন হয়েছে।’ চেনা লোক দেখলে খুশি হয়ে তার হাত ধরে চুমো দিতেন। খুলনা থেকে তার আপন মামাতো বোন এলে তিনি তাকে ঠিকই চিনেছেন। তাকে বলেছেন, ‘তুমি আমার আপনজন, আমার বাড়িতে থাক, ওখানে খাওয়া-দাওয়া কর।’ তিনি হাসপাতালে থাকাকালে আমার ছোট মেয়ে ডলি লেবার ওয়ার্ডে ছিল। তাকে তিনি হুইল চেয়ারে করে দেখতে যেতেন। আমার পোতার পটকা ফুটে হাত জখম হয়ে হাসপাতালে ছিল। তিনি জানতে পেরে তাকেও হুইল চেয়ারে করে দেখতে গেছেন। আমি হাসপাতালে তাকে দেখতে যেতাম। ফেরার সময় তার কদমবুসি করতে গেলে আমি কেমনভাবে ফিরব, তা তিনি চিন্তা করতেন। বলতেন, ‘সফীকে ফোন কর, গাড়ি পাঠালে যেও।’ নামাজের সময় হলে অজু করে চেয়ারে বসে থাকতেন। তার মাথায় সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস হয়েছিল। তিনি সম্পূর্ণ জ্ঞান হারাননি। জ্ঞানের ঘাটতি হয়নি, তা তার কার্যকলাপে বোঝা যেত। তিনি নিজেই বুঝেছেন, তিনি কলেমা ভুলে গেছেন। তিনি আমার ভাইদের বলে দীনিয়াত আনিয়ে নিয়ে সবসময় দীনিয়াত হাতে করে পড়তেন। আমি গেলে আমার হাতে দীনিয়াতখানা দিয়ে বলতেন, ‘দেখো তো ভুল হয় কি-না।’ দেখে তিনি ঠিকই পড়তেন। না দেখে পড়তে পারতেন না। অবাক হয়ে বলতেন, ‘আগে তো এমন ছিল না!’ অনেক ছাত্রছাত্রী তাকে দেখতে গেলে তাদের নাস্তা দিতে বলতেন। মেয়েরা মাথায় কাপড় না দিয়ে গেলে মাথায় কাপড় দিতে বলতেন। আমার এক বান্ধবীর অপারেশনের সময় আব্বার কাছে দোয়া নিতে এলে তাকে তিনি দোয়া করে সান্ত্বনা দিয়েছেন। আমি তাকে দেখতে গেলে তিনি তার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, কেমন আছে জানতে চাইতেন। হাসপাতালে থাকতে যখন তিনি জানতে পারলেন মওলানা আকরম খাঁ সাহেব হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছেন, তাকেও তিনি দেখতে গেছেন হুইল চেয়ারে বসে। আমি গেলে আমাকে বলেছেন, মওলানা সাহেব অসুস্থ, দেখে আস। তিনি ১৮ নং কেবিনে আছেন।’ তিনি কাগজ পড়ে জানতে পারলেন—তার বন্ধু সুশীল দে মারা গেছেন। আমি গেলে বললেন, ‘আমার বন্ধু সুশীল দে মারা গেছে।’ একবার কাগজে পড়লেন, বিড়াল ছোট বাচ্চাদের কামড়ে দিচ্ছে। তিনি আমাকে সাবধান করে বলেছেন, ‘জানালা বন্ধ রেখো। বিড়াল ছোট বাচ্চাদের কামড়িয়ে দিচ্ছে।’ তার মৃত্যুর এক মাস আগে বাংলা বিভাগের প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই সাহেব ট্রেনের নিচে পড়ে মারা গেছেন শুনে মর্মাহত হয়ে বলেছেন, ‘আবদুল হাই আমার ছাত্র ছিল। সে এমনভাবে মারা গেল কেন?’ তিনি অসুস্থ থেকেও সবার খোঁজ-খবর নিতেন এবং কর্তব্যবোধে সচেতন ছিলেন। সফীর মেয়ে চম্পার বিয়ে এবং আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে মিলুর বিয়েতে কী দেবেন, সফীর সঙ্গে তা নিয়ে তিনি পরামর্শ করেছেন। যদি বলতাম, ‘আপনি অসু্স্থ, আপনি অনুষ্ঠানে না গেলেও চলবে।’ তিনি বললেন, ‘না না, আমার ভাই নেই, তার পোতার বিয়েতে আমার যাওয়া কর্তব্য।’ চম্পার বিয়েতে তিনি উপস্থিত ছিলেন কর্তব্য মনে করে। ১৯৩৭ সালে আমার দাদি মারা গেলে নীলক্ষেতের মসজিদের পাশে জমি কিনে তাকে দাফন করা হয়। পরে আব্বা তার মায়ের কবরের পাশের জমি নিজের জন্য কিনে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি তার মায়ের কবর জিয়ারত করতে যেতেন এবং বলতেন, ‘আমি আমার জন্য মায়ের কবরের পাশে একখণ্ড জমি কিনে রেখেছি। আমার কবর মায়ের কবরের পাশেই হবে।’ কিন্তু তার কবর তার মায়ের কবরের পাশে হয়নি। দু’টি জিনিস মানুষকে তার দিকে জোরে টানে। একটা দানাপানি আরেকটা কবরের মাটি। আমার আব্বার ঢাকায় দানাপানি ছিল। তাই তিনি সুদূর ২৪ পরগণা থেকে ঢাকার দানাপানি খেলেন এবং ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এখানে তার মাটি ছিল, তাই তার পারিবারিক গোরস্থান থাকতেও এবং নিজের কেনা জমিতেও তার কবর না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্জন হলের প্রাঙ্গণে মুসা খাঁ মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হলো। তার দাফনের সঙ্গে একটা বিরাট জ্ঞানভাণ্ডারকেও দাফন করা হলো। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ঢাকা হলের নাম শহীদুল্লাহ হল রাখা হয়েছে। তিনি দীর্ঘ ৪৮ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং নানা ধরনের পদ অলঙ্কৃত করেছেন। ঢাকা তাকে ঢেকে রাখলো চিরতরের জন্য। তার কর্মব্যস্ত জীবনে তিনি কখনও কারও আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেননি। কোনো অসুস্থ আত্মীয় কুটুম্ব তার সাহায্য ও সহানুভূতি থেকে বিমুখ হয়নি। তিনি কাউকে নিরাশ করতেন না। তিনি বলতেন, ‘দিও কিঞ্চিত, না করিও বঞ্চিত।’ তিনি কত দেশে গেছেন। কত লোকের সঙ্গে মিসেছেন। তার শেষজীবনে সাদাসিধে পোশাক ছিল। তাকে অনেকেই চিনতে পারত না। তার রীতিনীতিতে আজীবন ইসলামী ভাবধারা বিরাজমান ছিল। তিনি জাতীয় জীবনে একটি আদর্শের উত্স। ফুলের সৌরভ কুলের গৌরব থাকে না চিরদিন। হে জ্ঞান সাধক! তোমার স্মৃতি তোমার গৌরব, চিরদিন রবে অমলিন। আমীন, সুম্মা আমীন। হ লেখিকা কর্তৃক ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে গ্রন্থ থেকে

No comments:

Post a Comment