Friday, 13 July 2012

ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

ড. কা জী দী ন মু হ ম্ম দ ১ বিংশ শতাব্দী বাংলার মুসলমানের রেনেসাঁর যুগ। একালে যে সকল মনীষী মুসলিম জাগরণের জন্য নানাভাবে সাধনা করে গেছেন তাঁদের মধ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অন্যতম অগ্রগণ্য। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সে কালে মুসলিম রক্ষণশীল ও সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পড়তে গিয়ে তিনি অসুবিধায় পড়েন। সংস্কৃতের এমএ পাঠক্রমে বেদ-শাস্ত্রও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বেদ পড়াতেন বিখ্যাত বৈদিক পণ্ডিত সত্যব্রত শামশ্রমী। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান প্রাচীনপন্থী গোঁড়া পণ্ডিত ছিলেন। মুসলমান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ছাত্র হবেন এবং তিনি তাঁকে বেদ পড়াবেন—এ হয় না। এ সম্বন্ধে তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন যে, ‘বিধর্মী’কে তিনি বেদ পড়াবেন না। ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ অনুরোধেও তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না; বরং তিনি পদত্যাগের হুমকি দিলেন। এ ব্যাপারে সে সময় কলকাতায় বিশেষ আন্দোলন হয়। বিশেষ করে তখনকার দিনের বিখ্যাত মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলী, যিনি সে সময় উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য তাঁর সুপরিচিত ইংরেজি পত্রিকা কমরেড (ঈড়সত্ধফব) প্রকাশ করতেন, তিনি ঞযব ঝযধযরফঁষষধয অভভধরত্ শীর্ষক কতকগুলো জোরালো প্রবন্ধ লেখেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এভাবে লোকের চোখের সামনে এসে পড়েন। এ নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার, বিলেতে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা ইত্যাদি কারণে তরুণ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নাম বাংলার ঘরে ঘরে শিক্ষিত মহলে বহুল আলোচিত হওয়ার সুযোগ পায়। ভাইস চ্যান্সেলর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এ ব্যাপারে বিব্রতবোধ করেন এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁকে ঈড়সঢ়ধত্ধঃরাব চযরষড়ষড়মু বা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে এমএ পড়ার পরামর্শ দেন। তখন বিভাগটি সবেমাত্র খোলা হয়েছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার পরামর্শ মেনে নেন। তিনি ১৯১২ সালে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে যথারীতি এমএ পাস করেন। এ সঙ্গে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৪ সালে তিনি আইন পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। এরও প্রায় এক যুগ পরে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি ডি-লিট এবং ধ্বনি-বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ডিপ্লোফোন লাভ করেন। এরপর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাতক্ষীরায় ওকালতি আরম্ভ করেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল বিদ্যাচর্চার দিকে, পঠন-পাঠন ও গবেষণার দিকে। ওকালতিতে তিনি মন বসাতে পারেননি। স্যার আশুতোষ তাঁর গুণগ্রাহী ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে নিজের হিতৈষী গুরুর মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা ও মান্য করতেন। স্যার আশুতোষ তাঁকে আইন ব্যবসা ছেড়ে বিদ্যার সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে উপদেশ দেন। মূলত তাঁরই উত্সাহে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লক্ষ্মীর রত্নভাণ্ডার ত্যাগ করে সরস্বতীর পুষ্পোদ্যানে স্থান লাভ করেন এবং তাঁর কালে বাংলা তথা ভারতবাসী হিন্দু-মুসলমানের মানসিক উত্কর্ষের পক্ষে বিশেষ লাভ ও উপকার হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঐঁসধহরঃরবং বা ‘মানবিকী’ বিদ্যায়, অর্থাত্ ভাষা-সাহিত্য-ইতিহাস-সমাজনীতি-অর্থনীতি-রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন-আধ্যাত্মিকতার সাধন এবং রস অর্থাত্ শাশ্বত সত্তার মধ্যে নিহিত যে আনন্দের অনুভূতি—এসব বিষয়ে তিনি একজন ‘সর্বন্ধর’ আচার্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন।

No comments:

Post a Comment