Friday, 13 July 2012

আবহমান বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, প্রথাগত ধারণাকে গভীরভাবে আত্মস্থ করে আধুনিক জীবনের, যুগযন্ত্রণার অভিজ্ঞতাকে নির্মম বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করেছেন। কামহীন প্রেমকে কবি সন্দেহের চোখে দেখেছেন এবং প্রেমহীন কামকে কবি ঘৃণার্হ করে তুলেছেন শব্দের পর শব্দ নির্বাচন, গঠন ও প্রয়োগের মাধ্যমে। তার পর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী ক্ষেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ [১০নং সনেট] মিথ এবং উপকথার প্রতি কবির অমোঘ আকর্ষণ লক্ষণীয়। পুরাণের বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ড তার মন ও মননে গভীর রেখাপাত করেছে; নয়তো পুরুষ তার নারীকে প্রলুব্ধ করার জন্য বিভিন্ন চরিত্রের উদাহরণ টেনে আনবেন কেন! তার কাছে শাস্ত্রীয় ধর্মের চেয়ে মানবধর্ম বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষের ধর্ম মানেই ফসলের সুষম বণ্টন হবে—এই প্রত্যয় নিয়ে কবি তার দয়িতাকে আলিঙ্গনে আহ্বান করেন। কোনো সংঘ কবির আরাধ্য নয়। কারণ কবিমাত্রই বাঁধনহারা, দৃঢ়চেতা এবং সত্ সাহসী। কবিরা কোনো সংঘের শরণ নেয়ার চেয়ে দরিদ্র বাউলের বাউণ্ডুলেপনাকে শ্রেয় বোধে লালন করেন। পূর্বপুরুষরা কবে ছিল কোন সম্রাটের দাস বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড় সেই অপবাদে আজও ফুঁসে উঠে বঙ্গের বাতাস মুখ ঢাকে আলাউল রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার এর চেয়ে ভাল নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল? [৬নং সনেট] শব্দকে একটি শান্ত ও গম্ভীর প্রবহমান নদীর মতো প্রয়োগ করতে পারার মধ্যে শিল্পীর নান্দনিক ও তাত্পর্যময় ভূমিকা রয়েছে, যার মাধ্যমে কবি নিজের ব্যক্তিত্ব, মনন ও রুচিকে সংক্রমিত করেন তার পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যেও। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দের যুক্তিগ্রাহ্য ও নান্দনিক চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে পুরাণ ও মিথকে আশ্রয় করেছেন। এই প্রবণতা তাকে বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে তার পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক অন্য কবিদের কাব্যভাষা থেকে। ফলে তার কণ্ঠস্বরটি স্বতন্ত্র মর্যাদা পেয়েছে—যথার্থ ও অনিবার্য কারণেই। ছন্দ নির্বাচনে কবি আঠারো মাত্রার সমিল অক্ষরবৃত্তকে বেছে নিয়েছেন—বোধ হয় এই ছন্দের প্রবল গাম্ভীর্যময় চারিত্র্যের জন্যই। নিরূপিত ছন্দোপযোগী শব্দ নির্বাচনে আধুনিক কবির স্বাধীনতা সামান্যতম হলেও ক্ষুণ্ন হয় বলে মনে করি। কারণ যথেচ্ছ শব্দ নির্বাচন ও গঠনের সুযোগ নিরূপিত ছন্দে নেই বললেই চলে। এর কারণ বাক্যস্থিত শব্দ সমবায়ের বিন্যাস হতে হয়—অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য পরম্পরায়। এর ব্যতিক্রমে ছন্দপতন ও বিষয়ের বোধগম্যতায় জটিলতা দেখা দিতে পারে। ফলত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। প্রস্তর যুগের এই সর্বশেষ উলাসের মাঝে কোথায় পালাবে বলো কোন ঝোপে লুকাবে বিহ্বলা? স্বাধীন মৃগের বর্ণ তোমারও যে শরীরে বিরাজে আমাদের কলা কেন্দ্রে আমাদের সর্ব কারুকাজে অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা। [১১নং সনেট] এই অস্তিবাদী জিরাফেরা তাদের ব্যক্তিগত গলা অহরহ বাড়ায়। আজকের অশান্ত বিশ্বের প্রতিটি অশুভ কর্মযজ্ঞের নেপথ্যে রয়েছে এই অস্তিবাদী জিরাফেরা। এই যে বিষয়ের সঙ্গে ছন্দোপযোগী শব্দ ও পর্ববিন্যাস এবং উপমার যে অভিনবত্ব দেখি, তা অনস্বীকার্যভাবে উজ্জ্বল। বাংলার কৃষকসমাজের উত্থান-পতন যেমন জসীমউদ্দীন এঁকেছেন তার স্বভাব সারল্যে; আবহমান বাংলার মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিল রূপ যেমন এঁকেছেন জীবনানন্দ দাশ তার দীর্ঘ বিষণ্নতার ঘোর রহস্যময় সম্মোহনে; তেমনি আল মাহমুদ এঁকেছেন তার মননশীলতার সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির অন্বয়সাধনের মাধ্যমে। সোনালি কাবিন বিষয় নির্বাচন, শব্দ প্রয়োগ, উপমা-চিত্রকল্প নির্মাণ, ছন্দের প্রয়োগ, পদবিন্যাসের স্বতন্ত্র কৌশলের কারণে বিশিষ্ট। সুলুক সন্ধানী পাঠকমাত্রই আবিষ্কার করবেন এই সনেটগুচ্ছে প্রকৃতি ও মানুষের এক ঘোর রহস্যময় সারল্যের ভাষাচিত্র। স্বাপ্নিক বিরোধ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে নেই সত্য; কিন্তু অন্তহীন রহস্যময় দিগন্তরেখার মোহনীয় উদ্ভাস লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্বোধ্যতা ভর করেনি, সারল্যও নেই; আছে বিমূর্ত আবহের চেতনা। আধুনিক বাংলা কবিতা অনুভবের জন্য শিক্ষিত পাঠকমন প্রয়োজন। কবিতা শুধু বুদ্ধিপ্রধান বাক্যবন্ধের সমষ্টি নয়; ভাবালুতাসর্বস্ব তরল শব্দ সমবায়ে রচিত বাক্যাবলিও কবিতা নয়। কবিতা যদি মানবজীবনের যাপিত অংশের শৈল্পিক ধারাভাষ্য কিংবা নান্দনিক প্রতিচ্ছবি না হয়, তাহলে পাঠক সেটাকে গ্রহণ করে না। আবার গতানুগতিক বিষয়ের প্রথাগত বুননও কবিকণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করি। কাব্য-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কবির দীর্ঘদিনের অভ্যাস, অর্জিত জ্ঞান, মনীষা, আত্মোপলব্ধিজাত অন্তর্নিহিত তাত্পর্যময় চিত্রকল্প, উপমা, উেপ্রক্ষা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কালই শেষ পর্যন্ত কবিতার শ্রেষ্ঠ পাঠক ও বিচারক। বাংলা কবিতার ইতিহাসে সোনালি কাবিন একাধারে বুর্জোয়া, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ। সোনালি কাবিনে ব্যবহৃত শব্দরাজি বাঙালির যাপিত জীবনের প্রতিদিন উচ্চারিত শব্দরাজি থেকে আহরিত। সোনালি কাবিন নিখিল নাস্তির দলিল নয়; নয় প্রবল বিশ্বাসের খতিয়ানও। হ

No comments:

Post a Comment