Friday, 13 July 2012

বাংলাভাষা বাংলাদেশেরই আত্মা, কলকাতায় সব হিন্দি আর ইংরেজি : আল মাহমুদ

# দেশে এবং বিদেশে আপনার প্রিয় লেখক কারা? — অনেক নামই তাহলে বলতে হয়। আমাদের দেশে আমার প্রিয় লেখক কাকে বলব—সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একজন, রবীন্দ্রনাথ... # রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তো আপনার অনেক লেখা আছে— গদ্য, পদ্য... — আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিশাল ভাণ্ডার। সেখান থেকে অনেক কিছু নেয়ার আছে। আর নজরুলকে আমি অনেক ভালোবাসি। তার কারণ হলো—তিনি নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন, বিদ্রোহ করেছিলেন এবং একটিমাত্র কবিতা তার আছে—‘বল বীর/ চির উন্নত মম শির’—যার সমতুল্য কাব্য বাংলা ভাষায় আর নেই। # জীবনানন্দ দাশকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? — জীবনানন্দ তো নির্জনতার কবি। তাঁর একটা কবিতায় আছে—উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে—এটাই জীবনানন্দ সম্পর্কে আমি বলি। # সাম্প্রতিককালে কী লিখছেন? — কলাম-টলাম তো লিখছি। দু’একটা কবিতা হয়তো লিখছি। আরও কিছু লিখতে পারলে হয়তো ভালো হতো। আমার তো বয়স হয়ে গেছে আসলে আশি। এ বয়সে মানুষ আর লেখে না, ছেড়ে দেয়, কিন্তু আমি তো এখনও ছাড়িনি। # বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থা, এটা নিয়ে কি আপনি আশাবাদী? দেশটা কি সত্যিকার একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপনীত হবে? — আমি অবশ্য আমাদের জনগণকে অধিক মূল্য দান করি। আমি শুধু বলব যে, আমাদের জনগণ নির্বোধ নয়। তারা সবই বুঝতে পারে। # আপনার প্রিয় সুগন্ধি কী? আপনি তো সুগন্ধি ভালোবাসেন। আপনার গল্পও আছে—সৌরভের কাছে পরাজিত। — আতর আমার প্রিয় সুগন্ধি। সবচেয়ে ভালো লাগে গোলাপি আতর। অসাধারণ। মানুষ আসল গোলাপি আতর পায় না। কিন্তু আসল গোলাপি আতর এক ধরনের পানির মধ্যে ভেসে ওঠা তেলের মতো। খুবই মধুর। একদিন লাগালে দু’তিন দিন থাকে। # আপনার সংগ্রহে আছে? — ছিল, এখন আর নেই। # আপনার প্রিয় খাবার কী? — আমার প্রিয় খাবার সাধারণত কোর্মা-পোলাও। এখনও এটা আমি ভালোবাসি, খেতেও পারি। # আপনি একটা কথা বলেছেন, সমাজতন্ত্রের কথা এখন আর কেউ বলে না কারণ সাম্রাজ্যবাদের পরাক্রম বেড়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে যে আরব বিশ্বে ইসলামী গণজাগরণের ঢেউ উঠেছে, এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন? — এটা আমি একবার বলেছিলাম কিন্তু। একটা বিষয় আসছে, পৃথিবীতে যেটা সম্পূর্ণ নতুন এবং তার কোনো কামান-বন্দুক নেই। সে অস্ত্রশূন্য হাতে একটি পুস্তক নিয়ে আসছে—তার নাম হচ্ছে ইসলাম। এর হাতে হলো পবিত্র কোরআন শরীফ। এটা পুঁজিবাদের সঙ্গেও মিলে না, সমাজতন্ত্রের সঙ্গেও না। এটা হলো আধুনিক জগতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ব্যাপার। এটা ব্যবসাকে হালাল করে, সুদকে হারাম করে দেয়। যে সমাজে সুদ আছে সে সমাজে সুখ নেই। সুদের সঙ্গে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই। সুদ তো হারাম করে দিয়েছে। আমার মতে যারা সুদ খায়—আমাদের বইপত্রে আছে যে, যারা সুদ খায় তারা উঠে দাঁড়াতে পারে না। # লেখালেখির ব্যাপারে আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে? — এক সময় তো আমার স্ত্রীই ছিলেন এবং আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। এখন এই যে নিঃসঙ্গ আমি, এই ক্ষতি তো আর পূরণ হবে না, হয়ও না। # এক সময় তো কবি হওয়ার জন্য লেখালেখি শুরু করেছেন। এখন কেন লিখছেন—এটা কি কোনো দায়বোধ? — আমরা তো কোথাও পৌঁছতে চাই। ঠিক কোথায় পৌঁছতে চাই, সেটা আমি এখন বলছি না। তবে একটা কথা হচ্ছে—ইসলাম আসছে। ভবিষ্যত্ হলো ইসলামের হাতে। # এখন যদি আপনার হাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হয়, আপনার প্রথম কাজ কী হবে? — প্রথম কথা হলো—এ দায়িত্ব আমি নিতে চাই না। # আপনি চান না, কিন্তু যদি কোনোভাবে এমনটা হয়? — তাহলে তো প্রথমে জনগণের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এটাই আমি করব। # আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানাই সময় দেয়ার জন্য। ‘কবি ছাড়া আমি আর কিছুই নই’— এ কথা কবি আল মাহমুদের। যদিও তিনি ছোটগল্প, উপন্যাস, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, সাংবাদিক হিসেবে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা, তথাপি তাঁর কবি পরিচয়ই তাকে বর্ণময় ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত করেছে। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর সমৃদ্ধিসাধনে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন অগুনতি পাঠকের কাছ থেকে। হাজার বছরের বাংলা কাব্যধারায় অবগাহন করে আল মাহমুদ বাংলাভাষী পাঠককে উপহার দিয়েছেন প্রায় তিনডজন কাব্যগ্রন্থ। কবিতায় তিনি বাঁকের পর বাঁক বদল করে ক্রমাগত ছুটেছেন সমুদ্রের দিকে। তাঁর অতৃপ্ত কবিপ্রাণ এখনও ধাবমান। বয়স আশির কাছাকাছি হলেও প্রাণে তার তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। কবিতায় তিনি ধারণ করেছেন এই বাংলাদেশের আত্মা। ‘আজানের শব্দে কুপির শিখার পাশে অবগুণ্ঠিত কিষাণীর মুখ’ তিনি দেখেছেন। গ্রাম বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যে জারিত লোকজজীবনের অনুষঙ্গ তার কবিতাকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা, বিশেষ মহিমা। লোক লোকান্তর, সোনালি কাবিন, কালের কলস, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহরান্তের পাশফেরা, বখতিয়ারের ঘোড়া, একচক্ষু হরিণ, আমি দূরগামী, দোয়েল ও দয়িতা, দ্বিতীয় ভাঙন, বিরামপুরের যাত্রী, উড়ালকাব্য, বরুদগন্ধী মানুষের দেশ কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, ডাহুকী, পুরুষ সুন্দর, যে পারো ভুলিয়ে দাও, কবি ও কোলাহল, আগুনের মেয়ে, চেহারার চতুরঙ্গ তার আলোচিত উপন্যাস। ছোট্টগল্প লিখেও চমকে দিয়েছেন তিনি পাঠকদের। পানকৌড়ির রক্ত, গন্ধবণিক, সৌরভের কাছে পরাজিত, ময়ূরীর মুখ, নদীর সতীন ইত্যাদি তার ছোট্টগল্প গ্রন্থ। যেভাবে বেড়ে উঠি, বিচূর্ণ আয়নার কবির মুখ—তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন বেশ ক’টি গ্রন্থ। লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী, সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম বিষয়ক এবং আত্মগত অসংখ্য প্রবন্ধ ও কলাম। গত ১১ জুলাই ছিল এই মহান কবির জন্মদিন। এ উপলক্ষে গত ১০ জুলাই সন্ধ্যায় কবির বাসায় হাজির হয়েছিলাম আমরা। মগবাজারের আয়শা-গোমতী ভিলায় কবির ফ্ল্যাটে যখন আমরা পৌঁছি তখন তিনি একটি পত্রিকার প্রতিনিধিকে সাক্ষাত্কার দিচ্ছিলেন। আমাদের ডাকলেন তাঁর শোয়ার ঘরে। কবিকে মনে হলো বেশ চঞ্চল ও উত্ফুল্ল। সাক্ষাত্কার দিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। কথা বললেন বিভিন্ন বিষয়ে। তার এই সাক্ষাত্কারটি এখানে পত্রস্থ হলো।

No comments:

Post a Comment