Friday, 13 July 2012
বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র ও নাট্য পরিচালক আর্নেস্ট ইঙ্গমার বার্গম্যান
সুজন মনজুর
মোশন পিকচারের ইতিহাসের ইঙ্গমার বার্গম্যান একজন বিখ্যাত পরিচালক হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র, মঞ্চ এবং টেলিভিশনের একজন সুইডিশ পরিচালক, লেখক এবং প্রযোজক। তার কাজের মধ্যে চরিত্রের গভীরতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রূপক বিষয় নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। উডি অ্যালেনের মতে "সব দিক বিবেচনা করে মোশন পিকগচার ক্যামেরার উদ্ভাবনের পর সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি সর্বকালের একজন অন্যতন গুণী এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে পরিচিত। প্রেক্ষাগৃহে এবং টেলিভিশনে মুক্তি পেয়েছে এ রকম ষাটটির ওপর ছবি এবং প্রামাণ্য চিত্র পরিচালনা করেছেন বার্গম্যান, যার বেশিরভাগ তিনি নিজেই লিখেছেন। এছাড়াও তিনি একশ সত্তরটির ওপর নাটক পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে তার সাথে কাজ করেছেন হ্যারিয়েট অ্যানডারসন, লিভ উলম্যান, গানার জমস্ট্র্যান্ড, বিবি অ্যানডারসন, এরল্যান্ড জোসেফসন, ইনগ্রিড থুলিন এবং ম্যাক্স ভন সিডো। তার বেশিরভাগ ছবি সুইডেনে চিত্রায়িত। তার ছবির প্রধান বিষয় ছিল মৃত্যু, অসুস্থতা, বিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা এবং উন্মত্ততা। আর্নেস্ট ইঙ্গমার বার্গম্যান সুইডেনের আপসালা শহরে ১৯১৮ সালের ১৪ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন ধর্মযাজক লুথেরান এর ছেলে তিনি তার সন্তানদের কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে লালন করেছেন। বার্গম্যান পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করেছেন যে তিনি আট বছর বয়সে ধর্মে বিশ্বাস হারিয়েছিলেন এবং যখন 'উইন্টার লাইট' ছবিটি তৈরি করেন সেই সময় এই সত্যটি সবার সামনে উন্মোচিত হয়। এ রকম পরিবেশে বেড়ে ওঠার ছবির প্রতি বার্গম্যানের এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয় যেটাকে সে তার কঠোর নিয়মে বড় হয়ে ওঠার বিপরীতে মুক্তি পথ মনে করতো। মাত্র ছয় বছর বয়সে বার্গম্যান তার প্রাথমিক কাজ হিসেবে বাতিল ফিল্মের টুকরো জোড়া দিয়ে নিজে নিজে ছবি তৈরি করেন। 'সোনডাগসবার্ন' নামক ছবিটিতে বার্গম্যানের সাথে তার বাবার বাইসাইকেল ভ্রমণ চিত্রিত হয়েছে। নয় বছর বয়সে সে 'ম্যাজিক ল্যান্টার্ন'-এর জন্য এক সেট টিনের সৈনিক কেনেন আর এ এক এমন সম্পত্তি যা তার জীবনের চলার পথকেই পরিবর্তন করে দিয়েছিল। আর পরবর্তী এক বছরের মধ্যে এই ধরনের খেলনা নিয়ে খেলতে খেলতে তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি জগৎ তৈরি করেন। তিনি তার কর্ম জীবন শুরু করেন পাপেট থিয়েটার দিয়ে। যেখানে তিনি, আর বোন এবং তার বন্ধুরা অভিনয় করতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ম্যানেজার। কয়েক বছর পর বার্গম্যান তার প্রথম মঞ্চ নির্দেশনা দেখার পর পুতুল নাটকের মঞ্চে তার নিজের নাটক মঞ্চস্থ করার কাজ শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে কলা এবং সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য তিনি স্টকহোম ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন (পরবর্তী সময়ে স্টকহোম ইউনিভার্সিটি নামকরণ করা হয়) এবং সেখানে তিনি ছাত্র নাট্যগোষ্ঠীর একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন। বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতেন ছাত্র নাট্যমঞ্চের সাথে জড়িত থেকে এবং পরবর্তী সময়ে একজন সত্যিকারের চলচ্চিত্র আসক্ত হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে প্রেমঘটিত কারণে চার বছরের জন্য তিনি তার বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যদিও তিনি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেননি কিন্তু তিনি বহু নাটক এবং গীতিনাট্য লিখেছেন এবং ধীরে ধীরে তিনি মঞ্চনাটকের একজন সহকারী পরিচালক হয়ে ওঠেন। ১৯৪২ সারে উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের (১৫৬৪-১৬১৬) বিখ্যাত ম্যাকবেথ মঞ্চস্থ করার পর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিচালক সুইডিশ রয়েল অপেরাতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সেই বছরই তিনি তার প্রতিভাকে সমানভাবে মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রে ভাগ করে নেন। ইঙ্গমার বার্গম্যান ১৯৬৩-৬৬ সাল পর্যন্ত সুইডিশ রয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন আর সেখানে তিনি সুইডেনের প্রায় সকল প্রফেশনাল অভিনয় শিল্পীদের ভাড়া করেছিলেন। বার্গম্যান ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় ছিলেন। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়াকে কেন্দ্র করে একটি ভুল তদন্তে ১৯৭৬ সালে তার কর্মজীবন খুবই আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে। যার ফলে বার্গম্যান ক্রোধের বশবর্তী হয়ে বেশ কিছু অসমাপ্ত কাজ স্থগিত করেন, তার স্টুডিও বন্ধ করে দেন এবং নিজের সিদ্ধান্তেই আট বছরের জন্য জার্মানিতে নির্বাসনে চলে যান। কয়েক বছর পর তিনি আবার সুইডেনে ফিরে আসেন এবং তার শেষ ছবি 'ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেকজান্ডার' তৈরি করেন। তার ছবিতে সব সময় যারা নির্বাচিত হতেন সেই সব সুইডিশ অভিনয় শিল্পীদের জন্য বার্গম্যান একটি ব্যক্তিগত তথ্য ভা-ার (জবঢ়বৎঃড়ৎু পড়সঢ়ধহু) গড়ে তুলেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন ম্যাক্স ভন সিডো, বিবি অ্যান্ডারসন, হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসন, এরল্যান্ড জোসেফসন, ইনগ্রিড থুলিন, গুনেল লিন্ডবস্নম, বেঙ্গট একেরট, অ্যানডারস এক এবং গানার বর্নস্ট্রান্ড আর প্রত্যেকেই বার্গম্যানের সাথে নূ্যনতম পাঁচবার কাজ করেছেন। এই গ্রুপে সর্বশেষ যোগ দিয়েছিলেন নরওয়ের অভিনেত্রী লিভ উলম্যান যিনি বার্গম্যানের নয়টি ছবিতে (১৯৬৬ সালে "পারসোনা" ছবিতে অভিনয় করেন) এবং একটি টেলিভিস্যুয়াল ছবিতে (সারাব্যান্ড) অভিনয় করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত শিল্প চর্চা এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে উভয় ক্ষেত্রে বার্গম্যানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। লিন উলম্যান (জন্ম ১৯৬৬) নামে তাদের একটি মেয়ে ছিল। 'থ্রো এ গ্ল্যাস ডার্কলি (১৯৬০)' নির্মাণের সময় ইঙ্গমার বার্গম্যান তার বহু দিনের সঙ্গী সিনেম্যাটোগ্রাফার ভেন নাইকভিস্ট এর সাথে তিনি ১৯৮৪ সালে ছবি নির্মাণ হতে অবসর নেন এবং এরপর ২০০৩ সালে ৮৫ বছর বয়সে তিনি মঞ্চ নাটকের পরিচালনা হতে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে ওয়েডলকে তাদের মেয়ে মারিয়া জন্মাবার পর বার্গম্যান অবশেষে ইনগ্রিড বার্গম্যানকে (ইনগ্রিড ভন রসেন) ১৯৭১ সালে বিয়ে করেন। এটা ছিল তার একমাত্র বিয়ে যা বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়নি। তার দাদী তাকে সিনেমার সাথে পরিচয় করান এবং যখন তিনি খুব ছোট আর তার কঠোর হৃদয়ের বাবা যখনও পর্যন্ত তাকে ছবি দেখার অনুমতি দেননি সেই সময় তাকে নিয়ে তার দাদী প্রায়ই খুব গোপনীয়তার সাথে সিনেমা দেখতে যেতেন। যেখানে তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন সেই ফ্যারো আইল্যান্ডে তাকে কবর দেয়া হয়। হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসনের সাথে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এবং বিবি অ্যান্ডারসনের সাথে ১৯৫৫ সালে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত প্রণয়াবদ্ধ ছিলেন। সুইডিশ, ফরাসী এবং ইংরেজি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। চলচ্চিত্র ছাড়া শিল্পের এমন কোনো ধারা নেই যা সাধারণ সচেতনার বাইরে চলে যেতে পারে। সরাসরি পেঁৗছতে পারে আমাদের আবেগের কাছে, অন্ধকার পরিবেষ্টিত ঘরে মনের গভীরে। চলচ্চিত্রের প্রতিটি বিষয় আমাকে নিজেকে শিখতে হয়েছে। মঞ্চের জন্য গোটেবার্গে একজন বিস্ময়কর মানুষের সাথে কাজ করেছি, যেখানে আমি চার বছর খেটেছি। তিনি ছিলেন একজন শক্ত ও কঠিন মানুষ, কিন্তু মঞ্চকে বুঝতেন এবং তার কাছে থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ছবির জন্য শেখাবার কেউ ছিল না। যুদ্ধের আগে আমি ছিলাম স্কুলের ছাত্র। তারপর যুদ্ধের সময় কোনো বিদেশি ছবি দেখতে পারিনি। সময়ের সাথে সাথে ইে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে লালন পালনের পাশাপাশি আমি কাজ করেছি। সৌভাগ্যবশত শুরু থেকেই প্রকৃতিগতভাবে আমি নিজেই নিজেকে নির্দেশ দিতাম, অনেকটা এমন যে নিজেই নিজের শিক্ষক, যদিও তাতে কখনো কখনো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম না। নিজের সাথে নিজে কথা বলা মানুষ কোনো কোনো সময় টেকনিক্যাল দিকটায় খুব বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলে। 'একটি ছবির কাহিনীকে ক্যামেরায় ধারণ করা পুরো জগৎকে সংগঠিত করার মত।' একটি ব্যর্থ প্রেম, যার পরিণতি ছিল আত্মহত্যা (কারো ব্যক্তিগত জীবন থেকে নেয়া) এরকম একটি কাহিনীকে অবলম্বন করে ১৯৪৫ সালে বার্গম্যান তার প্রথম ছবি 'ক্রাইসিস' পরিচালনা করেন। এর পরপরই তিনি আরো কিছু ছবি পরিচালনা করেন। কিন্তু ১৯৫৬ সালে 'দ্যা সেভেন্থ সিল'-এর মাধ্যমে বার্গম্যান সমালোচনা এবং জনপ্রিয়তার শিখরে পেঁৗছে যান। 'দ্য সেভেন্থ সিল একজন যোদ্ধার নৈতিকতার কাহিনী যিনি তার ধর্ম সম্পর্কে সন্দেহের সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে বেড়ান এবং জগতের রহস্য উন্মোচন করেন, মৃত্যুকে দাবা খেলায় চ্যালেঞ্জ করেন। এমনকি বার্গম্যানের সমালোচকরা পর্যন্ত একমত যে এই ছবিটিতে অসাধারণ নাটকীয় ক্ষমতার দুঃসাহসিক দৃশ্য আছে। এর এক বছর পর যৌবন বার্ধক্যের মধ্যে যে ভিন্নতা তার উপর একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে বার্গম্যান পরিচালনা করেন 'ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ'। তার পরবর্তী ছবি 'দ্যা ম্যাজিশিয়ান' (১৯৫৯)-এর মাধ্যমে বার্গম্যান তার পূর্ববর্তী প্রতীকী কাজের ধারায় ফেরেন, যেখানে কিছুকে কিছুকে বোঝাবার জন্য বিভিন্ন বস্তু বা বিষয়কে ব্যবহার করা হয। এটি একদল ভ্রাম্যমাণ যাদুঘর এবং তাদের অপার্থিব ক্ষমতা ব্যবহারের গল্প নিয়ে তৈরি। অল্প কিছু কাজের পাশাপাশি ১৯৬০ তিনি তৈরি করেন 'ভার্জিন স্প্রিং'। ১৯৬১ সালে বার্গম্যান তার উচ্চাভিলাষী তিনটি ছবি নিয়ে উঠে পড়ে লাগেন। শুরু করেন ঘোর, উন্মত্ত, পারিবারিক সহিংসতার পর্যবেক্ষণমূলক ছবি 'থ্রো এ গ্ল্যাস ডার্কলি' দিয়ে। দ্বিতীয় অবদান 'উইন্টার লাইট (১৯৬২)', বিশ্বাস হারিয়ে যাওয়ায় শূন্যতার উপস্থাপন। তৃতীয় ছবি 'দ্য সাইল্যান্স (১৯৬৩), যোগাযোগ সমস্যার রহস্য উদঘাটন। এই তিনটি ছবির মাধ্যমে ঈশ্বরের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্ট উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পায়। ফলে জগত সম্পর্কে বার্গম্যানের ক্রমবর্ধমান জটিল দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হয়। মৃদু কাব্যিক ধরনের ছবি 'পারসোনা (১৯৬৬)' তেও এক ধরনের জটিলতার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। এই ছবির কাহিনী এক অদ্ভুত সম্পর্ককে ঘিরে যেখানে এক তরুণী নায়িকা যে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে এবং একজন বাঁচাল নার্স যে তার সেবায় রত। ১৯৬৮ সালে একজন শিল্পীকে নিয়ে নির্মাণ করেন 'দ্য আওয়ার অফ দ্য ওলফ' যার ওপর ভূত ভর করে। এই ছবিটির মাধ্যমে বার্গম্যানের পূর্বের ধর্মীয় অবিশ্বাসের বিপরীতে কিছু অনুশোচনীয় অনুভূতির সন্ধান মেলে। আয়কর সমস্যার কারণে ১৯৭০ সালে টেলিভিশন অনুষ্ঠান তৈরি করার জন্য নরওয়ে, জার্মানি এবং সুইডেনে অবস্থানকালে বার্গম্যান খুব বেশি খরচ করেন। সেই সময়ে তার নাটক নির্ভর ছবিগুলোর মধ্যে ছিল 'ক্রাইস এন্ড হুইসপারস (১৯৭১), এবং 'অটাম সোনাটা (১৯৭৮)'। টেলিভিশনে যেসব কাজ করেছেন তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একই বছরে নির্মিত 'সিনস ফ্রম এ ম্যারেইজ (১৯৭৩)' এবং 'দ্য ম্যাজিক ফ্লুট'। ১৯৮২ সালে বার্গম্যান তার জীবনের বিস্তারিত বিবরণ সমৃদ্ধ একটি আত্মজীবনীমূলক ছবি 'ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেকজান্ডার' মুক্তি দেন। যেহেতু এটা ছিল তার শেষ ছবি তাই তার পুরনো কাজগুলো থেকে এই ছবিটির মধ্যে বহু আলাদা ধরনের বিষয় লক্ষ্য করা যায় এবং এই ছবিতে তার জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে একটি শক্তিশালী সারমর্ম প্রতিফলিত হয়। 'ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেকজান্ডার' ছবিটি থেকে বার্গম্যান ১৯৮৮ সালে তার আত্মজীবনী 'দ্য ম্যাজিক ল্যানট্যার্ন' এবং ১৯৮৯ সালে 'বেস্ট ইনটেনশন' নামে একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন এবং সুইডিশ টেলিভিশন আর মঞ্চের জন্য তার লেখা এবং পরিচালনা অব্যাহত রাখেন। ১৯৯১ সালে বার্গম্যানের চিত্রনাট্য অবলম্বনে সুইডিশ টেলিভিশনের জন্য তৈরি হয়েছিল বেস্ট ইনটেনশন। ২০০১ সালে 'ফেইথলেস' মুক্তি পেল, এটি লিখেছিলেন বার্গম্যান কিন্তু পরিচালনা করেছিলেন অভিনেত্রী লিভ উলম্যান। বার্গম্যান এই ছবিটির কাহিনী বিশ্বাস করতেন_ একজন পুরষের সঙ্গে একজন বিবাহিত নারীর উন্মাতাল প্রেম_ এটা ছিল অনেকটা তার ব্যক্তিগত জীবনের ছায়া মতো। পৃথিবীতে একজন অন্যতম স্মরণীয় বিখ্যাত পরিচালক হিসেবে আজো বার্গম্যান এবং তার ছবিগুলো বহুল পরিচিত হয়ে টিকে আছে। বহু সুপরিচিত আমেরিকান পরিচালক, যেমন উডি অ্যানেনের মতো পরিচালকরা বার্গম্যানকে উল্লেখ করেছেন। বার্গম্যানের ছবি প্রায়ই সুইডেনের বাইরে বিভিন্ন টাইটেলে মুক্তি পেতো। বার্গম্যান সব সময় নিজেই চিত্রনাট্য লিখতেন। লিখবার আগে মাসের পর মাস অথবা বছর ধরে সেটা নিয়ে চিন্তা করতেন। তার নির্মিত শুরুর দিকের ছবিগুলো খুবই সতর্কতার সঙ্গে নির্মাণ করেছিলেন এবং সেগুলো করতেন হয় তার নাটক অবলম্বনে অথবা অন্য লেখকদের সঙ্গে যৌথভাবে লিখে। বার্গম্যান উল্লেখ করেন তার পরবর্তী কাজগুলোতে যখন কোনো সুযোগ আসতো তার ইচ্ছাতেই শিল্পীরা একটু ভিন্নভাবে কাজ করতে চাইতেন। তিনি তাদেরকে সেভাবেই কাজ করতে দিতেন। যদি তিনি তা না করতেন তবে অনেক সময় কাজের মান খুবই খারাপ হতো। তার ক্যারিয়ারে উন্নতি আসার সঙ্গে সঙ্গে বার্গম্যান তার অভিনয় শিল্পীদের অব্যাহতভাবে সংলাপ ইমপ্রোভাইজ করতে বলতেন। তার শেষের দিকের ছবিগুলোতে তিনি শুধু দৃশ্যের ধারণাগুলো লিখতেন এবং তার শিল্পীদের সেই দৃশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক সংলাপ বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। বার্গম্যানের ছবিতে সচরাচর মৃত্যু, একাকীত্ব এবং ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন বিদ্যমান থাকতো। তার নারী চরিত্রগুলো যৌনাচারে পুরুষদের চেয়ে বেশি অগ্রগামী ছিল এবং তারা তা অসঙ্কোচে প্রকাশ করতেন। কোনো কোনো সময় মাত্রা ছাড়ানো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে (যেমন 'ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপারস) তা প্রকাশ পেতো। যেন কোনো যাদুকরের যাদু প্রদর্শনের মতো। ১৯৬০ সালের টাইম ম্যাগাজিনের কভার স্টোরিতে বার্গম্যান নিজেই নিজেকে সেই যাদুকর বলেছেন। ১৯৬৪ সালে প্লেবয় পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'চরম যৌনাচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ করে আমার জন্য। সবচেয়ে বড় কথা আমি শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক ছবি বানাতে চাইনি। আমি চেয়েছি দর্শকরা আমার ছবি বসে বসে বোঝার চেয়ে অনুভব করুক, স্পর্শ করুক। এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বার্গম্যান চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত, এছাড়াও তার জীবনে তিনি একজন সক্রিয় এবং সৃষ্টিশীল মঞ্চ পরিচালক। স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে তার পড়াশোনাকালীন সময়ে তিনি এই ইউনিভার্সিটির ছাত্র নাট্য সংঘে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। গ্র্যাজুয়েশনের পর তার প্রথম কাজ ছিল স্টকহোম থিয়েটারের একজন শিক্ষানবিস পরিচারক হিসেবে। ২৬ বছর বয়সে তিনি ইউরোপের হেলসিংবর্গ থিয়েটারের সর্বকনিষ্ঠ মঞ্চ ব্যবস্থাপক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি হেলসিংবর্গে তিন বছর অবস্থান করেন এবং তারপর তিনি ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত গোথেনবার্গ সিটি থিয়েটারের পরিচালক মনোনীত হন। তিনি ১৯৫৩ সালে ম্যালমো সিটি থিয়েটারের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং সাত বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। তার অনেক তারকা অভিনয় শিল্পী ছিলেন যাদের সঙ্গে তিনি মঞ্চে কাজ শুরু করেছিলেন এবং ষাটের দশকে বার্গম্যানের নাট্যদলের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিলেন ম্যালমো সিটি থিয়েটারের কর্মীরা (যেমন ম্যাকভন সিডো)। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত তিনি স্টকহোমে রয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারের পরিচালক এবং ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত ম্যানেজার ছিলেন যেখানে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সম্মিলিতভাবে কোরিওগ্রাফার ডনিয়া ফইয়ারের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। কর ফাঁকি দুর্ঘটনার কারণে বার্গম্যান সুইডেন থেকে চলে যাওয়ার পর তিনি জার্মানির মিউনিখে রেসিডেন্স থিয়েটারের পরিচালক হিসেবে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত কাজ করেন। তিনি ১৯৯০ পর্যন্ত মঞ্চে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন এবং ২০০২ সালে রয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারে তার শেষ প্রযোজনা হেনরিক ইবসেনের 'দ্যা ওয়াইল্ড ডাক' দিয়ে মঞ্চ পরিচালনার সমাপ্তি টানেন। তিনি মিউনিখে থেকে তার সব কাজ পরিচালনা করতেন। ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি বার্গম্যান সুইডেন সরকারের প্রতি তার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা পরিহার করেন। ফ্যারোতে তার ষাটতম জন্মদিন পালন করার জন্য ওই বছরের জুলাই মাসে তিনি সুইডেন ভ্রমণ করেন এবং লয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারের পরিচালক হিসেবে আংশিকভাবে তার কাজ আবার শুরু করেন। তার ফিরে আসার সম্মানে সুইডিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট চলচ্চিত্রে সম্মানসূচক অবদান রাখার জন্য তার নামে একটি সম্পূর্ণ নতুন পুরস্কার 'ইঙ্গমার বার্গম্যান পুরস্কার' চালু করেন। এরপরও ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি মিউনিখে ছিলেন। ২০০৫ সালে ফ্যারো আইল্যান্ডে নেয়া তার শেষ এক সাক্ষাৎকারে বার্গম্যান বলেন যে, রাগের বশবর্তী হয়ে চলে যাওয়ার জন্য তিনি তার কর্মজীবন থেকে আটটি বছর হারিয়েছেন। বার্গম্যান চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে তার নিতম্বে অস্ত্রোপচার করা হয় এবং অনেক কষ্টভোগের পর আরোগ্য লাভ করেন। ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই আটানব্বই বছর বয়সে ফ্যারো আইল্যান্ড, গটল্যান্ডস ল্যান, সুইডেনে তার বাড়িতে ঘুমের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ওই একই দিনে আরেকজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মাইকেল অ্যাঞ্জেলো অ্যানতোনিওনিও মারা যান। ২০০৭ সালের ১৮ আগস্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে তাকে ফ্যারো আইল্যান্ডে সমাহিত করা হয়।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment