Friday, 13 July 2012

বাংলাভাষা বাংলাদেশেরই আত্মা, কলকাতায় সব হিন্দি আর ইংরেজি : আল মাহমুদ

সাক্ষাত্কার : হাসান হাফিজ/আহমদ বাসির # ৭৭-এ পা দিচ্ছেন, কেমন বাংলাদেশ আপনি দেখতে চান? — স্বাধীন, সার্বভৌম, শান্তিময় বাংলাদেশ দেখতে চাই, সুখী বাংলাদেশ। # আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবের বাংলাদেশের মধ্যে ফারাকটা কতখানি? — বেশ ফারাক আছে। কারণ কবি যে কল্পনা করে, আমরা একটু বেশি আশা করি, সে রকম তো আর হয় না, আমরা যা আশা করি। তবু পায়ের নিচের মাটিটা তো বাংলাদেশ। তাই না? এক ভালোবাসার টান। # একটা রক্তের প্লাবনের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন আমরা জানি। সে সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলেন। — স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমরা প্রকাশ্যে ছিলাম না, কিন্তু আশপাশে ছিলাম, তাদের সঙ্গেই। # এবং তারও আগে থেকেই বাংলাদেশের সত্তা যখন গঠিত হচ্ছিল, আপনার বিভিন্ন লেখার মধ্যে এসেছে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এসেছে, ভাষা আন্দোলন এসেছে। বাংলাদেশের মাটিকে, এদেশের জলকে, হাওয়াকে, লোকজ জীবনকে তুলে এনেছেন—এসবের পেছনে আপনার কী দর্শনটা কাজ করেছিল? — বাংলার মাটি! একটা কথা আছে না—‘বাংলার মাটি বাংলার জল/পুণ্য হউক পুণ্য হউক...’ এই। # কবিতা ও নারী—কে বেশি রহস্যময়ী? — সন্দেহ নেই, এ দু’জনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ব নেই, কারণ কবিরা যেখানে শুতে যায় সেই জায়গাটার একদিকে নারী, আরেক দিকে বই থাকে। এই দুটোকে সরিয়ে কবিকে বিশ্রাম নিতে হয়। আশা করি কথাটা বুঝেছ। # আপনি তো একজন ঘোরতর আস্তিক মানুষ। এই বিশ্বাস, এই রহস্যময়তা আপনার বিপুল রচনাসম্ভারে নানা মাত্রিকতায়, নানা অবয়বে প্রতিফলিত। এই মরমিয়াবাদ সম্পর্কে পাঠকদের কিছু বলুন। — আমি বিশ্বাসী। বিশ্বাসী মানুষ কী করে? বিশ্বাসী মানুষ সবসময় একটা কাজ করে। সেটা কী করে? সে সেজদা করে অদৃশ্যের দিকে এবং সে প্রার্থনা করে, অ্যান্ড হি প্রেজ, প্রার্থনা করতে থাকে। এটা আমার একটা ধারণা। ধারণা কী? এটা সত্য। # আপনার লেখালেখির শুরুটা কেমন করে হয়েছে? — আমি মফস্বল শহরে থাকতাম। খুব পড়তাম আমি। পড়তে পড়তে একদিন মনে হলো—আচ্ছা, আমিও তো এরকম লিখতে পারি। লেখা শুরু করলাম। আশ্চর্য যে, আমার লেখা তখন এদেশের শ্রেষ্ঠ কাগজগুলো খুবই অনায়াসে ছেপে দিল। # সেটা তো বিস্ময়কর! — আমার কাছেও বিস্ময়কর! # এখনও? — এখনও লাগে। # আপনার জীবনে এমন কোনো স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা আছে কী, যেটা এখনও পূর্ণ হয়নি? — এটা তো তুমি একটা খুব জটিল প্রশ্ন করলে। আমি তো পূর্ণতা এবং অপূর্ণতার মধ্যে বাস করি। কিছু পাই, কিছু পাই না। এই হাতড়ে বেড়াই। এটা হলো জীবন। # ‘লোক লোকান্তর’ থেকে ‘পাখির কথায় পাখা মেললাম’ এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আপনার যে বাঁকবদলগুলো হয়েছে, তার পেছনে কোন ফ্যাক্টরগুলো কাজ করেছে বলে আপনি মনে করেন? — আমার জীবনই একটা আশ্চর্য জীবন। কত ঘাটে ভিড়তে হয়েছে। কত কিছু দেখলাম, জানলাম। সবকিছুর মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে, দেশে যা কিছু ঘটেছে। আমি তো এদেশ থেকে পালিয়ে যাইনি। আমি দেশে থেকে দেশের সব কিছুতে অংশগ্রহণ করেছি, দেখেছি, মুভ করেছি এবং আরেকটা কী ব্যাপার—কেঁদেছি। আই ওয়েপ্ট। # নানা ধরনের লেখা আপনি লেখেন। কথাশিল্প, কলাম, কবিতা, আত্মজৈবনিক—কোন শাখায় লিখতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, কেন? — আসলে ওই অতীত নিয়ে লিখতে ভালোই লাগে। কিন্তু অতীত বেশিদিন দেখা যায় না। আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু বর্তমানটা যে এতই বাস্তব এবং এতই রূঢ় যে, এর মধ্যে বসবাস করতে হলে সাহস, শক্তি এবং কাব্যগুণ লাগে। সেটা মনে হয় আমারও কম-বিস্তর আছে। # কেউ কেউ বলে, অদূর ভবিষ্যতে ‘বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হবে ঢাকা’। — এটা কেউ কেউ নয়, আমিই বলেছি প্রথম। # এ কথার বাস্তব ভিত্তি কতটা মজবুত হয়েছে? — বাংলা ভাষাই বাংলাদেশের আত্মা। এই ভাষার সঙ্গে অন্য কিছুকে বাংলাদেশ মিশ্রিত করে না। এক দিগ্বিজয়ী ভাষা। শব্দের তরঙ্গ বাংলাদেশেই বইছে। বাংলাদেশ ছাড়া এটা আর কোথাও সম্ভবপর হয়নি। কলকাতা গেলে তুমি দেখবে, সব হিন্দি আর ইংরেজি। # সেখানে বাংলা ভাষা মরে যাচ্ছে, ওরা টিকিয়ে রাখতে পারছে না। — না, পারছে না। # গদ্য কিংবা কবিতা লেখার পরবর্তী যে অনুভব কিংবা সাফল্যের শিহরণ—দুয়ের মধ্যে মৌল কোনো পার্থক্য আছে কি? — আমি সব সময় ভাবি যে, আমার খাপে তো দুইটা তরবারি আছে—একটা গদ্যের, একটা পদ্যের। যখন যেটা আমার প্রয়োজন, সেটা ব্যবহার করেছি। # তরুণ কবিদের জন্য আপনার কোনো উপদেশ আছে কি? — কথা হলো যে, উপদেশ দেয়া আমার জন্য ঠিক না। তরুণরা ইচ্ছানুযায়ী চলবে—এটাই আমরা চাই। তবে একটা কথা বলব। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। জ্ঞান না হলে কিছুই হয় না। বলা হয় না, জ্ঞানবৃক্ষের ফল না খেলে সে তো কিছুই জানে না? জ্ঞানবৃক্ষের ফল একবার যে খেয়েছে, তাকে পৃথিবীতে আসতে হয়েছে স্বর্গ ছেড়ে। স্বর্গ থেকে তাকে বের করে দেয়া হবে, সে পৃথিবীতেই চলে আসবে। পৃথিবীতে এসে নিজের পরিশ্রমের অন্ন নিজে খাবে। # দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতা প্রকৃত সাহিত্যচর্চায় কতটা অবদান রাখতে পারছে? — আমাদের দেশে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পৃষ্ঠা আমাদের সাহিত্যের জন্য সাহায্যকারী হয়েছে। অন্য দেশে এটা হয়নি, আমাদের দেশে হয়েছে। # মানসম্পন্ন সাহিত্য কাগজের অভাবের কারণে হয়েছে? — তাই, তাই তো দেখতে হবে। নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা নেই। লিটলম্যাগ আছে। # বাংলা কবিতার ভবিষ্যত্ কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? — এটা বলা উচিত না। কারণ, আধুনিক বাংলা কবিতা হলো আধুনিক জাতীয় জীবনের একটা দৃষ্টান্ত। আধুনিক বাংলা কবিতা এতই পরিপকস্ফ এবং এতই ডালপালা মেলে দিয়েছে, যদিও গদ্যকে আমরা আধুনিক বলি, এটা অন্য কোনো সাহিত্যে ঘটেনি যে, কবিতাই বিজয়ী হয়েছে। # সাধারণভাবে বলা হয়, বাংলাদেশে কবিতার পাঠক ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এর কারণটা কী? — আশ্চর্য কথা—বাংলাদেশে কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে। দল বেঁধে কেউ কবিতা (৭-এর পৃষ্ঠার পর) পড়ত নাকি? কোনো সময় পড়েনি। দলবদ্ধভাবে কাব্যচর্চা করেছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। কেউ কেউ করেছে—এরাই তো বাঁচিয়ে রাখে সব। # আমাদের সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা বিশ্বমানের বিচারে কোন অবস্থায় আছে? — আধুনিকতার দিক দিয়ে প্রায় জগতের সাহিত্যের সমকক্ষ। আমাদের কবিতা যদি ব্যাপক অনুবাদ হয় তাহলে বোঝা যাবে, কী আশ্চর্য কাজ হয়েছে বাংলা ভাষায়! # স্বাধীনতার চল্লিশ বছর হয়ে গেল, অনুবাদের ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য কিন্তু সেভাবে আসেনি। — না, অনুবাদ করার মতো লোক আসেনি। এটা ঠিকই কথা। # বাংলা একাডেমীর একটা ভূমিকা, দায়িত্ব কি এক্ষেত্রে ছিল না? — কার কার ভূমিকা বা দায়িত্ব ছিল এটা বলে কোনো লাভ নেই। এটা ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। একজন লোক যদি থাকে, তাহলে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেয়। # কেউ যদি বলে, আপনার ইদানীং কালের লেখায় আগেকার সেই লাবণ্য ও মাধুর্য কিছুটা গরহাজির—এ অভিযোগের বিপরীতে আপনার বক্তব্য কী হবে? — আমার পক্ষ থেকে এর কোনো জবাব নেই। তবে কী কারণে বলে, তা কিন্তু উল্লেখ করা হয় না। তারা ভ্রান্ত কিনা, নাকি আমি ভুল করছি সেটা বোঝার মতো ব্যাখ্যা হয়নি এখনও। # বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে সমকালীন কাব্যধারা কিংবা প্রবণতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যগুলো কী কী? — আমি পশ্চিমবঙ্গের কবিতা সম্পর্কে কম জানি। আমার পড়া হয়ে উঠছে না। এ ব্যাপারে জ্ঞান অপেক্ষাকৃত কম আমার। কে লিখছে, কী লিখছে এটা আমি জানি না, তখন একটা আন্দাজি মন্তব্য আমি করতে পারি না। তবে একথা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের কাব্যের শক্তি এবং ঐশ্বর্য অনেক বেশি। বিশেষ করে এর যে লোকজ গ্রাউন্ড, সেটা অনেক উর্বর বলে আমি মনে করি। # আপনার মায়াবি কলমে শিশু-কিশোরদের জন্য বেশকিছু মূল্যবান ফসল ফলেছে। কারও কারও অভিযোগ, আপনি এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনোযোগ ও সময় দেননি। আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনার বক্তব্য কী হবে? — হয়তোবা। যারা আমার এ খুঁতটা ধরতে পেরেছে তারা আমার অনুরাগী। তাদের উচিত ছিল একটা পরামর্শ দেয়া, কিন্তু তারা তো সেটা করেননি। করা উচিত ছিল। এটা তারা যদি বলে দিতেন, তাহলে আমি সেভাবে চলতাম। # বলা হয়, আমাদের কবিতাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ কখনও নেয়া হয়নি। এই ক্ষতির জন্য কে বা কারা দায়ী? — কেউ দায়ী নয়। ভালো ট্রান্সলেটরের অভাব— যে একই সঙ্গে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী হবে। তাদের আবির্ভাব হয়নি। এটা একটা দুর্ভাগ্য বলা যেতে পারে। # একজন খাঁটি কবি হওয়ার ক্ষেত্রে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা কতটা জরুরি? — আমি আস্তিকতাকে খুব মূল্য দিই। কারণ, বিশ্বাস হলো একটা হাতল। এটা ধরতে হয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। বিতণ্ডা করে কোনো লাভ নেই। # মহাকালের বিচারে আপনার কবিতা কতটা টিকে থাকবে বলে আপনার ধারণা? — আমি তো ভবিষ্যত্ বক্তা নই। যে কারণে বলতে পারব না। মহাকালের বিচারে টিকে থাকে না অনেক কিছুই। তুমি চর্যাপদ দেখ, চর্যাচর্যাবিনিশ্চয়। এটা কীভাবে আছে? ‘শাশুড়ী নিদ গাএ বউড়ি জাগত্র কানেট চোরে নিল কাগই মাগত্র’ # প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলী আকবর খান একবার বলেছিলেন যে, নিবিড় সঙ্গীত সাধনার এক পর্যায়ে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য অনুভব করা যায়। কবিতা রচনার কোনো পর্যায়ে এমন ধরনের কোনো ঐশী বোধ কি কখনও আপনাকে আচ্ছন্ন করেছে? — তিনি তো বলেছেন সঙ্গীত সম্পর্কে; কিন্তু আমি যে জিনিস চর্চা করি এটার নাম হলো আধুনিক কবিতা। কবিতার মধ্যেও সঙ্গীত আছে। আমি লিরিকটা পছন্দ করি। আমি একটু লিরিক্যাল লোক এবং লিরিক হলো সবকিছু পাওয়ার একটা পথ। এটাই অনুসন্ধান করতে হবে।

No comments:

Post a Comment