Friday, 13 July 2012

বাংলাভাষা বাংলাদেশেরই আত্মা, কলকাতায় সব হিন্দি আর ইংরেজি : আল মাহমুদ

# বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে আপনি প্রায়ই বলতেন, চিত্রকল্পই কবিতা। ত্রিশের দশকের খ্যাতিমান এক কবি বলে গেছেন, উপমাই কবিতা। এ ব্যাপারে বিশদ বলবেন কি? — আমি কেন যে চিত্রকল্পকেই কবিতা বলেছিলাম, সেটা একটু ভেবে দেখতে হবে। আমার কবিতায় তো আমি এটা ত্যাগ করিনি। চিত্রকল্প তো প্রায় কবিতারই সমার্থক। কবিতায় একটা চিত্রকল্প লাগে। # আমরা জানি, কবিতা পড়তে গিয়ে ভালো লাগার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারপর আসে উপমা, চিত্রকল্প, উেপ্রক্ষা, প্রতীকের দক্ষ শৈল্পিক প্রয়োগের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি ছন্দের ব্যাপারটিও জরুরি, তাই নয় কি? — সবচেয়ে বড় কথা হলো ছন্দ। একজন কবিকে জানতে হয়—মিলটা কীভাবে সংঘটিত হয়। অনুপ্রাস জানতে হবে। এটা জানলেই তার মনে দারুণ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এটা না জানলে কিন্তু অনেক অসুবিধা। # দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় আপনার সৃজিত কবিতাগুচ্ছে বিধৃত হয়েছে সমকাল, বাংলাদেশের লোকজীবন, দেশ, সমাজ, জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য, অহং, ঐতিহ্য ইত্যাদি। সফল সাহিত্য সৃষ্টির প্রশ্নে এসবের প্রতিফলন অত্যন্ত জরুরি। এগুলো কেন জরুরি বলবেন কি? — তুমি নিজেই তো বললে জরুরি। জরুরি এজন্য যে, একটাকে বাদ দিলে খুঁত থেকে যায়। এই খুঁত ভরাট করার আর কে আছে, কিছু তো নেই। কবিতার জায়গাটা কবিতা দিয়েই ভরাট করা দরকার, অন্য কিছু দিয়ে হয় না। # উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানতে চাই। — এটা হলো—দার্শনিকরা যেটা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছে, সেটা ঘাড়ে তুলে নেয়া। # উত্তর আধুনিকতা বলতে পশ্চিমে আধুনিকতা-পরবর্তী কালটাকে বোঝানো হয়। কিন্তু ভারতে বা বাংলাদেশে এটাকে প্রাচীন ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া বোঝাচ্ছে—এ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন? — আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশটা প্রাচীন ঐতিহ্য ছাড়া ঘটেনি। কবিতা কিন্তু মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ কারণেই, যেখানে পায়ের তলায় মাটি আছে সেখানে সবসময় প্রাচীন ঐতিহ্য আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে তো থাকা যায় না। মানুষকে সামনের দিকে এগোতে হয়। পুরনো ঐতিহ্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, কিন্তু কবিতা হয়ে উঠতে হলে আধুনিকতা দরকার। # এবার একটু ম্যাজিক রিয়েলিজম সম্পর্কে আলাপ করতে চাই। রিয়েলিজম ও ড্রিমের মধ্যে সেতু তৈরি করাকেই আমরা ম্যাজিক রিয়েলিজম বলে বুঝি। এ নিয়ে লাতিন ও ক্যারিবিয়ান কথাশিল্পীরাই বেশি কাজ করে থাকেন। পরে এই জাদুবাস্তবতার ধারণা বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। কবিতায়ও এর প্রতিফলন ঘটে। আপনার কবিতায়ও আমরা এর লক্ষণ দেখছি। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতার বইতে এই বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই আছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন। — এটার মধ্যে যা বক্তব্য সেটা ঠিক খোলাসা করা যায় না। তবে এটুকু বলতে পারি—সবগুলো জটিলতার জট খুলে যায় যখন মিল বোঝে কবি—ছন্দের দোলায় যখন পৌঁছে। ছন্দ, গন্ধ এবং স্পর্শের যে আনন্দ; এটা একজন কবিকে সামনে ঠেলে দেয়। ভবিষ্যতের দিকে দারুণভাবে ঠেলে দেয়। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়। # আপনার কাব্য-সহযাত্রী কবি শামসুর রাহমান এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন—সেটাই কবিতা যা প্রথম পাঠে ভালো লাগে। এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? — তিনি কী বলেছিলেন সেটা আমি বলতে পারব না। তবে প্রথম পাঠে অনেক কিছুই ভালো লাগে। এটা কি যুক্তিসঙ্গত কথা হলো? প্রথম পাঠে অনেক অকবিতাও ভালো লাগে, তাই না? প্রথম পাঠে আমার ভালো লাগে গদ্য। কারণ গদ্য আধুনিক। এটা তো বলা যায় না—আমার প্রথম পাঠে যেটা ভালো লাগে সেটাই কবিতা। এর সঙ্গে ঠিক আমি একমত হতে পারি না। # আপনি কি বলতে চাচ্ছেন—একটা কবিতা প্রথম পাঠে ভালো লাগল, কিন্তু আপনি যখন কয়েকবার পাঠ করলেন তখন মনে হলো—না, ভালো লাগার আসলে কারণ নেই। — হ্যাঁ, কোনো কারণ নেই দেখা যাচ্ছে। # আনন্দ ও বেদনা—কবিতার কাছে আপনি কোনটা বেশি পেয়েছেন? — আমার মনে হয়, আনন্দ-বেদনা—এই দুইটাই সমভাবে আমাকে অভিভূত করেছে। # একজন লেখকের বিকাশের জন্য সংঘ বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি? — কোনো কোনো ক্ষেত্রে আছে। কিন্তু দল বেঁধে কাব্য হয় না। # এই যে জাতীয় কবিতা পরিষদ হয়েছে, কেউ বলেন এটা এখন খুব স্তিমিত হয়ে আছে—এগুলো কি চূড়ান্ত বিচারে আমাদের সাহিত্যের কোনো উপকার করেছে? — কবিতার যে কোনো সংগঠন বা কবিতার জন্য যারা কাজ করে, তারা কিছু না কিছু কাজ তো করেই—এটুকু শুধু বলতে পারি। # মৃত্যুচিন্তা কি আপনাকে কখনও আচ্ছন্ন করে? এ অনুভূতিটা কেমন? — যেহেতু আমি জন্মেছি, মৃত্যু হবেই। এটা যখন আমি নিশ্চিতভাবে জানি, তখন মৃত্যুর ভয়টা হয়তো ঈষত্ কমে আছে—কিন্তু মৃত্যুর যে ভয়, বিস্ময়, মৃত্যুর যে একটা স্বাদ আছে এটা আমি কখনও গ্রহণ করিনি। এটা একবারই মানুষ গ্রহণ করে, যখন সে মরে যায়। ফিরে এসে আর কিছু বলতেও পারে না। # বিশ্ব সমাজে সমাজতন্ত্র যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা আপনাকে ব্যথিত করে কি? — সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা কিন্তু বলা যাবে না। আসলে সমাজতন্ত্রের কথা আজকাল আর কেউ বলে না। কারণ, পুঁজিবাদ এত প্রবল ও পরাক্রান্ত হয়েছে যে, সমাজতন্ত্রীরা মুখ খুলতে পারছে না। পুঁজিবাদ যতই বৃহদাকার ধারণ করুক—পুঁজিরও একটা পরিসমাপ্তি আছে। # আপনার রাজনৈতিক চিন্তায় আমরা ব্যাপক পরিবর্তন দেখি। বামধারা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় আপনি আস্থাশীল হয়েছেন সময়ের পরিক্রমায়। এই পরিবর্তনের অনিবার্যতা কী ছিল? আপনার সাহিত্যচিন্তা ও লেখালেখিতে এর কেমন প্রভাব পড়েছে বলে আপনি মনে করেন? — আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বাম ঘরানা, যতই বলে না কেন, মানুষের বিশেষ করে কবির স্বাধীনতা হরণ করে। # বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত লেখালেখিকে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই। — এ কথাটা আংশিক সত্য। কিন্তু আমি তো লিখেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছি—আয়-রোজগার যাই বলো, এই লেখা থেকেই। # আপনি তো অন্যান্য চাকরিও করেছেন। সেগুলো যদি করতে না হতো... — সেটা করেছি, কিন্তু লেখালেখি থেকেই আমাকে আয়-রোজগার বেশি করতে হয়েছে। তবে একটা কথা বলি—যেটা ঘটে না, সেটা ঘটবে না বলেই ঘটে না। এটা সত্য। # কবিরা সত্যদ্রষ্টা হয়ে থাকেন বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে বর্তমান কবিদের কবিতায় তার কেমন প্রতিফলন আছে? — সব কবি সত্যদ্রষ্টা কিনা জানি না। তবে আমি বলি—কবিরা দ্রষ্টা। সে দেখে। # আপনি এক সময় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা বৃত্তি কতটা উপকারী কিংবা অপকারী বলে আপনার মনে হয়েছে? — এটা নিজের ওপর নির্ভর করে। আমি সাংবাদিকতা করেছি। কেন করেছি? আমার পেটের জন্য করেছি। বেঁচে থাকার জন্য করেছি। সেটাও প্রয়োজন ছিল। # কবিতার কাছে আপনার ঋণ কতখানি? — যা কিছু নিয়েছি, কাব্যের কাছ থেকেই নিয়েছি। তবে দিয়েছিও, শোধ করার চেষ্টাও আমি করেছি। # কেউ কেউ বলে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে শক্তিমান লেখক আর আসছেন না। আপনি কি এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত? — আমি ঠিক একমত নই। তবে সব সময়ই দেখা যায় যে, প্রকৃত লেখক যারা, তারা বেশ একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে আসেন, প্রতিদিন তো আর আসেন না। # আপনার প্রথম প্রেমের অনুভূতি, রোমাঞ্চ—নারী প্রেম অর্থে, এ সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? — আমারও এমন একটা মুহূর্ত এসেছিল। কৈশোর উত্তীর্ণ সময় যেটা, যেটাকে আমরা যৌবন বলি, তার প্রারম্ভে। এ সম্পর্কে আর কিছু বলার নেই, বলা উচিতও নয়। # কবিদের মধ্যে ক্ষুদ্র দলাদলির ব্যাপারটি কি আপনাকে পীড়িত করে? একজন খাঁটি কবি দলভুক্ত না হলে ন্যূনতম স্বীকৃতিও পান না। এ ব্যাপারে কী বলবেন আপনি? — এটা আমি ঠিক মানি না, কারণ কবিতা একটি ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। কবিতা নীরবে লিখতে হয় এবং কবি একা, কবি নীরব সব সময়। # কিন্তু দল না করলে পুরস্কার পাওয়া যায় না। বাংলা একাডেমী পুরস্কার নিয়েও এটা হয়ে থাকে। — এগুলো বাস্তবতা। এগুলো আমি অস্বীকার করে চলে এসেছি। # ইদানীংকালে আপনার দিনগুলো কেমন করে কাটছে? — আমি তো চোখে-টোখে দেখি না। দৃষ্টি তো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মোটামুটি বসে থাকি। পড়তে খুব ইচ্ছা করে। আমার পড়ে শোনানোর লোকও আছে। নাতি-নাতনিরা আছে। তারা জরুরি বিষয় যেটা সেটা পড়ে শোনায়। পত্রিকা শোনায়। আমি মাঝে মাঝে গান শুনতে ভালোবাসি। # আপনার প্রিয় শিল্পী কে? প্রিয় গান সম্পর্কে বলুন। — আমি তো এদেশের শ্রেষ্ঠ যারা গায়ক-গায়িকা, তাদের সবারই গান শুনি। # আপনি তো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখেছেনও। শিল্পকলা একাডেমী থেকে আপনার বইও হয়েছে। — আছে। আব্বাসউদ্দীনকে নিয়েও আমি একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছি। # আপনার প্রিয় গান কোনটা—রবীন্দ্র, নজরুল? — ক্লাসিক্যাল মিউজিক আমার প্রিয়। এছাড়া আমার একটা স্বতন্ত্র পড়াশোনা ছিল পশ্চিমা মিউজিকের ওপর। এটা খুবই আমার কাছে লেগেছিল। আমি এদেশীয় সঙ্গীত বুঝতে পেরেছি। যাকে বলে পশ্চিমা সঙ্গীত, সেটারও ধ্বনি তরঙ্গ আমি অনুভব করতে পারি। এর ওপর আমার কিছু বক্তৃতাও ছিল। আমি মাঝে মাঝে এ সম্পর্কে বলতাম। আমি প্রায়ই একটা কথা বলে থাকি—যদি আমি কবি না হতাম, তাহলে আমি অবশ্যই সঙ্গীতজ্ঞ হতাম

No comments:

Post a Comment