Friday, 13 July 2012

কালের ডানায় সোনালি রোদ্দুর

মো হা ম্ম দ নূ রু ল হ ক আধুনিক কবি কালের ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন; কিঞ্চিত্ প্রভাবিত। সমকালের বিভিন্ন প্রপঞ্চ আধুনিক মন ও মননকে বিমোহিত করে সত্য; কিন্তু তাতেই শৃঙ্খলিত করে না। বিশেষত কবি ঘটনার ফল নন; ঘটনার দ্রষ্টামাত্র। শব্দের অর্থ কবির হাতে পড়ে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। মানবমন বস্তুনিরপেক্ষ নয়। ফলে নিষ্প্রাণ বস্তুরাশিও সময়ে প্রাণবন্ত ও সজীব হয়ে ওঠে। সচেতন প্রয়াসেই কবি তার প্রতিবেশ নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যক্তিমানুষের ক্ষোভ, প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা, ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের বহুরৈখিক রূপ অঙ্কন করেন। আধুনিক কবি সমাজ নয়; ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, মনোবিকার ও তাত্ক্ষণিক অনুভূতির বহুমাত্রিক চিত্র আঁকার চেষ্টা করেন গভীর মনোনিবেশে। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে আধুনিক বাংলা কবিতা উত্কর্ষে ও প্রাচুর্যে অনন্য। নিসর্গ চেতনা ও মানবজাতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌনচেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আল মাহমুদের কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। প্রকৃতি ও নারী আল মাহমুদের চেতনায় একই প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। সেখান থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন না। অথবা সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টাও করেন না। পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রের পুনর্জীবনের কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও সাম্যবাদের বিকিরণ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞ, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজাতির জ্ঞানকাণ্ডে সিঞ্চনের জন্য শীতল জলের যে আধার তা কতটা নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ, তার যৌক্তিক স্বপ্নকল্প নির্মাণ করার দায় একা কবির? তা হলে সে দায় এবং স্বাপ্নিক বিরোধে তর্কলিপ্ত হতে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিঃশঙ্ক। জীবনানন্দ দাশে দেখি ইতিহাস চেতনা, ভৌগোলিক ধারণার সঙ্গে মানুষের মনোবিকার একই সমতলে অঙ্কন করতে। জীবনানন্দ দাশ চিত্রকল্প নির্মাণে নৈসর্গিক আবহকে প্রাধান্য দিয়েছেন; ফলে তার কবিতা চিত্রকল্পপ্রধান এবং গ্রামীণ অনুষঙ্গে বিভাসিত হতে দেখা যায়। তবে তার কণ্ঠে জটিল সারল্য ছিল। এক ধরনের কমনীয়তাও লক্ষ করা যায় দাশকাব্যে। অন্যদিকে একেবারেই গ্রামীণ জীবনে উচ্চারিত শব্দ সমবায়ে গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার চিত্র অঙ্কন করেছেন জসীমউদ্দীন। জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ দু’জনই আধুনিক চিত্রকলার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জসীমউদ্দীনকে অনুপ্রাণিত করেছে আবহমান বাংলার জীবনযাত্রা নিয়ে অঙ্কিত চিত্রকর্ম আর জীবনানন্দ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আধুনিক চিত্রকলার ইঙ্গিতময়তার দ্বারা। আর তাদের দু’জনের মিশ্র প্রভাব লক্ষ করি আল মাহমুদে। মাত্র উপমা নির্মাণ কিংবা চিত্রকল্প নির্মাণের নৈপুণ্যই কবিতা নয়, তা হলে কলাকৈবল্যবাদীরাই কবি অভিধায় অভিষিক্ত হতেন। বাকিরা থাকতেন চির উপেক্ষিত। তবু কবিমাত্রই ছন্দে সিদ্ধহস্ত। ছন্দমাত্রাজ্ঞানহীন ব্যক্তির পক্ষে আর যাই হোক, কবিতা লেখা সম্ভব নয়। প্রকৃত কবিতার শরীরের কোষে কোষে ছুটে চলা রক্তকণিকার মতো ছন্দের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি বিদ্যমান। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ কবি শুরু করেছেন শঙ্কাহীন পৌরুষ এবং শর্তহীন আত্মনিবেদনের ভাবাবেগ দ্বারা। আত্মনিবেদনের এমন বিলোড়িত ও শৈল্পিক ভঙ্গি এর আগে বাংলা কবিতার পাঠক প্রত্যক্ষ করেছেন মর্মে কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। নতজানু পুরুষ তার চিরকাঙ্ক্ষিত রমণীর সামনে, এরকম দৃশ্য আর কেউ আঁকেননি। এখানে রমণীর কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কোনোরূপ উল্লেখ করা হয়নি। তবু কবি কী কারণে কাঙ্ক্ষিত রমণীর কোনো বিশেষ গুণটির জন্য নিজেকে এভাবে সমর্পণ করলেন, তার সদুত্তর পাওয়া মুশকিল। তা হলে রমণীর কোনো রূপ জ্ঞান কিংবা সৌন্দর্য ব্যতিরেকেও অন্য কোনো অনুল্লেখ্য সাধারণ কিংবা অব্যাখ্যেয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিও কবিপুরুষ বিমোহিত হন কখনও-কখনও? সোনার দিনার নেই দেনমোহর চেয়ো না হরিণী যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি। [১নং সনেট] কবিতা জ্ঞানের বস্তু নয়; অনুভবের এবং পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গমাত্র। কবিতা ইতিহাস নয়; ইতিহাসের নির্যাস কবিতায় প্রচ্ছন্ন। আল মাহমুদ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দকে এসব অভিজ্ঞতার স্মারক হিসেবে গ্রহণ করে শব্দ ব্যবহারের একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রকরণের প্রচলন করেছেন। এটি তার নিজস্ব ঢং, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তার শব্দ নির্বাচন, নতুন শব্দ গঠন এবং উপমা প্রয়োগে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য পরিশ্রমের স্বাক্ষর মেলে। ভাবালুতা-সর্বস্ব চিত্রকল্প কিংবা তরল বাক্য বিন্যাসের বিলসিত আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে মেলে না। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের আটপৌরে শব্দরাজির সঙ্গে আধুনিক মননজাত শব্দ সমবায়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্বয়সাধন তার কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে, জীবনানন্দ দাশের ইউরোপীয় আধুনিক চেতনা এবং জসীমউদ্দীনের পল্লীর সাদামাঠা ভাবালুতাময় শব্দ থেকে। সম্ভবত এ কারণে আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠক আল মাহমুদকে গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠকালে জসীমউদ্দীন পল্লীর সাধারণ মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে এবং জীবনানন্দ দাশ তার অন্তহীন বিগলিত ইউরোপীয় আধুনিকতার তাত্পর্যময় অনন্ত বিষণ্নতাসহ উপস্থিত হন

No comments:

Post a Comment