Friday, 13 July 2012
ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্
২
পণ্ডিতমহলে অনেকেই বলে থাকেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন গড়ারহম ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ—চলন্ত বিশ্বকোষ বা জীবন্ত অভিধান। অনেকের ধারণা যে, তিনি প্রায় দুই কুড়ি ভাষা জানতেন। একবার কারো কোনো লেখায় ‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঊনচল্লিশটি ভাষা জানেন’ বলে উল্লিখিত হয়। আমরা কয়েকজন এদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন : তারা অতিরিক্ত বাড়িয়ে বলেন। আসলে তিনি খুব ভালো করে পড়তে, লিখতে ও বলতে পারতেন বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহট্ট, উর্দু, হিন্দি, সিংহলি, কাশ্মীরি, নেপালি, অহমিয়া, ওড়িয়া, পোশতু এবং আরো কয়েকটি ভাষা। আর পড়তে ও বুঝতে পারতেন আরো দু’ডজনের মতো ভাষা। এক কথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন ইংরেজিতে যাকে বলে চড়ষুমষড়ঃ—বহুভাষিক। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ও ভাষা বিশ্লেষণে বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান, বিশেষ করে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার তাত্পর্য ব্যাখ্যায় তাঁর তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান সমৃদ্ধ করেছিল—যা তাঁর তাত্ত্বিকতার মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বস্তুত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞানপরিধির বিস্তার আমাদের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে এ কথা নিশ্চিত বলতে পারি, এ এলাকায় যে ক’জন ভাষাতত্ত্বের অনুশীলনে নিয়োজিত হয়েছেন, তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে তাঁর কাছে ঋণী। তাঁরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেরণায় তারা ভাষাতত্ত্ব আলোচনায় আত্মনিয়োগে সমর্থ হয়েছেন। আমার নিজেরও ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র উত্সাহ ও প্রেরণায়ই হয়েছে।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমাদের দেশ-জাতি-ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। গবেষণা ছাড়া সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মে তাঁর অগাধ জ্ঞান, কোরআন, হাদিস ও ফিকহ বিষয়ক তাঁর সুবিজ্ঞ আলোচনা সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। তিনি ফরাসি, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ইত্যাদি নানা ভাষায় বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রণয়ন করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র অবদান সম্বন্ধে আলোকপাত করতে প্রয়াস পাব।
৩
ভাষাতত্ত্বমূলক আলোচনা আমাদের দেশে নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব তিন-চার শতকে যাস্ক, পাণিনি প্রভৃতি ভাষাবিজ্ঞানী বিবৃতিমূলক ভাষাতত্ত্বের প্রথম সূত্রপাত করেন। পাণিনি ছিলেন পাকিস্তানি। পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে কালাতুর গ্রামে তিনি বাস করতেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মী ও উত্তরসূরিরা সে অঞ্চলে প্রচলিত প্রাচীন কথা আর্য ও সংস্কৃত ভাষার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাদের আলোচনার পদ্ধতি ও ধারা আজও বিবৃতিমূলক ভাষাবিজ্ঞানের আদর্শস্থানীয় হয়ে রয়েছে। বর্তমানের ইউরোপ ও আমেরিকার আধুনিক ভাষাতত্ত্বেও আলোচনা তাঁরই আদর্শ অনুসরণ করে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ যুগেও পাশ্চাত্য দেশে পাণিনির ব্যাকরণকে মানুষের জ্ঞানের চরম নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।
পাণিনির পরেও অনেক দিন পর্যন্ত পাক-ভারতে এই ধারায় ভাষা-বিষয়ের আলোচনা অব্যাহত ছিল। পাণিনির মতো পতঞ্জলি প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানী এই উপমহাদেশে বর্ণনাভিত্তিক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। এরপর কিছুকাল আমরা আমাদের নিজেদের ভুলে গিয়েছিলাম। তাই বোধকরি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মতোই ভাষাতত্ত্বের আলোচনায়ও ভাটা পড়ে। ইউরোপ তথা পশ্চিম গোলার্ধ ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অনুশীলনীতে হাত দেয় আরো অনেক পরে। পশ্চিমের চোখে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলির আবিষ্কার এক মহাবিস্ময়। আধুনিক ভাষাতত্ত্বের মূল সূত্রটি এখান থেকেই নিয়ে তারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিজেদের ভাষার বিশ্লেষণ শুরু করলেন।
কিন্তু কিছুদিন আগ পর্যন্তও ভাষাকে তুলনামূলক বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই দেখা হতো। সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার শব্দসম্ভারে সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্য, মিল-গরমিল বিশ্লেষণ করে অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের ভাষাগুলোর স্বরূপ নির্ণয়ই ছিল তখনকার দিনের মোটামুটি ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা।
আজ আবার পুরনো ধারার নবজাগৃতির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাই বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের দিকেই আবার সবার নজর ফিরেছে। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় দেশি ও বিদেশি মনীষীর অবদানের ইতিহাস বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের আওতার বাইরে। কিন্তু তাদের বিচার-বিশ্লেষণের স্বরূপ বোঝার জন্য তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিঞ্চিত্ আলোচনার অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কেননা ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহেক বুঝতে হলেও এদের সামগ্রিক
আলোচনার একটি মোটামুটি আভাস জানা থাকা একান্ত প্রয়োজন। এর আগে ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলে নিলে আমাদের আলোচনার সুবিধা হবে।
ভাষাতত্ত্বে তিন ধারার ভাষা সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে—প্রথমত, বর্ণনামূলক ধারা। একে ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ও বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এবং তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব।
বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বে ভাষাতাত্ত্বিক কোনো বিশেষ ভাষার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আলোচনার সুবিধার জন্য এই কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন : ১. ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) ২. ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology) ৩. রূপতত্ত্ব (Morphology) ৪. পদক্রম বা বাক্যরীতি (ঝুহঃধী) ৫. বাগর্থ বিজ্ঞান (Semantics) এবং ৬. অভিধান বিজ্ঞান (Lexicography)|
বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের মূল কথা হলো, যে কোনো একটি ভাষার বিশেষ কালের বিশেষ রূপের বর্ণনা করা। তা করতে হলে সেই বিশেষ ভাষাভাষী লোকের মধ্য থেকে নির্বাচিত যে কোনো একজনের মুখের ভাষাই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। এভাবে একেকটি উপভাষার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সাহায্যে সেই ভাষার সামগ্রিক বর্ণনা সম্ভব হয়। মানুষের মুখের ভাষা যেমন ব্যবহৃত হয়, তারই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে সূত্র নির্ণয় করতে হয়। এই ধরনের বর্ণনায় ভাষার কোন নিয়ম আছে আর কোন নিয়ম নেই, তারই উল্লেখ থাকে; ভাষায় কী হওয়া উচিত আর কী হওয়া উচিত নয়, সে ধরনের বিধি-নিষেধের স্থান সেখানে নেই। এমনকি কেন এমন হয়, কেন এমন হয় না, তারও বিশ্লেষণ সেখানে অসঙ্গত। ভাষায় ব্যবহৃত নানা উপাদানকে একটা বিশেষ সংজ্ঞার মাধ্যমে একটা পদ্ধতির বন্ধনে আবদ্ধ করে যে বিশ্লেষণ শাস্ত্র গড়ে ওঠে, তাকেই তখন বলা হয় সেই ভাষার ব্যাকরণ।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment