Friday, 13 July 2012

বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র ও নাট্য পরিচালক আর্নেস্ট ইঙ্গমার বার্গম্যান

সুজন মনজুর মোশন পিকচারের ইতিহাসের ইঙ্গমার বার্গম্যান একজন বিখ্যাত পরিচালক হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্র, মঞ্চ এবং টেলিভিশনের একজন সুইডিশ পরিচালক, লেখক এবং প্রযোজক। তার কাজের মধ্যে চরিত্রের গভীরতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রূপক বিষয় নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। উডি অ্যালেনের মতে "সব দিক বিবেচনা করে মোশন পিকগচার ক্যামেরার উদ্ভাবনের পর সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি সর্বকালের একজন অন্যতন গুণী এবং প্রভাব সৃষ্টিকারী চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে পরিচিত। প্রেক্ষাগৃহে এবং টেলিভিশনে মুক্তি পেয়েছে এ রকম ষাটটির ওপর ছবি এবং প্রামাণ্য চিত্র পরিচালনা করেছেন বার্গম্যান, যার বেশিরভাগ তিনি নিজেই লিখেছেন। এছাড়াও তিনি একশ সত্তরটির ওপর নাটক পরিচালনা করেছেন। এর মধ্যে তার সাথে কাজ করেছেন হ্যারিয়েট অ্যানডারসন, লিভ উলম্যান, গানার জমস্ট্র্যান্ড, বিবি অ্যানডারসন, এরল্যান্ড জোসেফসন, ইনগ্রিড থুলিন এবং ম্যাক্স ভন সিডো। তার বেশিরভাগ ছবি সুইডেনে চিত্রায়িত। তার ছবির প্রধান বিষয় ছিল মৃত্যু, অসুস্থতা, বিশ্বাস, বিশ্বাসঘাতকতা এবং উন্মত্ততা। আর্নেস্ট ইঙ্গমার বার্গম্যান সুইডেনের আপসালা শহরে ১৯১৮ সালের ১৪ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন ধর্মযাজক লুথেরান এর ছেলে তিনি তার সন্তানদের কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে লালন করেছেন। বার্গম্যান পরবর্তী সময়ে প্রকাশ করেছেন যে তিনি আট বছর বয়সে ধর্মে বিশ্বাস হারিয়েছিলেন এবং যখন 'উইন্টার লাইট' ছবিটি তৈরি করেন সেই সময় এই সত্যটি সবার সামনে উন্মোচিত হয়। এ রকম পরিবেশে বেড়ে ওঠার ছবির প্রতি বার্গম্যানের এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয় যেটাকে সে তার কঠোর নিয়মে বড় হয়ে ওঠার বিপরীতে মুক্তি পথ মনে করতো। মাত্র ছয় বছর বয়সে বার্গম্যান তার প্রাথমিক কাজ হিসেবে বাতিল ফিল্মের টুকরো জোড়া দিয়ে নিজে নিজে ছবি তৈরি করেন। 'সোনডাগসবার্ন' নামক ছবিটিতে বার্গম্যানের সাথে তার বাবার বাইসাইকেল ভ্রমণ চিত্রিত হয়েছে। নয় বছর বয়সে সে 'ম্যাজিক ল্যান্টার্ন'-এর জন্য এক সেট টিনের সৈনিক কেনেন আর এ এক এমন সম্পত্তি যা তার জীবনের চলার পথকেই পরিবর্তন করে দিয়েছিল। আর পরবর্তী এক বছরের মধ্যে এই ধরনের খেলনা নিয়ে খেলতে খেলতে তিনি সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি জগৎ তৈরি করেন। তিনি তার কর্ম জীবন শুরু করেন পাপেট থিয়েটার দিয়ে। যেখানে তিনি, আর বোন এবং তার বন্ধুরা অভিনয় করতেন। কিন্তু তিনি ছিলেন ম্যানেজার। কয়েক বছর পর বার্গম্যান তার প্রথম মঞ্চ নির্দেশনা দেখার পর পুতুল নাটকের মঞ্চে তার নিজের নাটক মঞ্চস্থ করার কাজ শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে কলা এবং সাহিত্য বিষয়ে পড়াশোনা করার জন্য তিনি স্টকহোম ইউনিভার্সিটি কলেজে ভর্তি হন (পরবর্তী সময়ে স্টকহোম ইউনিভার্সিটি নামকরণ করা হয়) এবং সেখানে তিনি ছাত্র নাট্যগোষ্ঠীর একজন সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন। বেশিরভাগ সময় ব্যয় করতেন ছাত্র নাট্যমঞ্চের সাথে জড়িত থেকে এবং পরবর্তী সময়ে একজন সত্যিকারের চলচ্চিত্র আসক্ত হয়ে ওঠেন। সেই সময়ে প্রেমঘটিত কারণে চার বছরের জন্য তিনি তার বাবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যদিও তিনি গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেননি কিন্তু তিনি বহু নাটক এবং গীতিনাট্য লিখেছেন এবং ধীরে ধীরে তিনি মঞ্চনাটকের একজন সহকারী পরিচালক হয়ে ওঠেন। ১৯৪২ সারে উইলিয়াম শেক্সপীয়ারের (১৫৬৪-১৬১৬) বিখ্যাত ম্যাকবেথ মঞ্চস্থ করার পর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিচালক সুইডিশ রয়েল অপেরাতে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সেই বছরই তিনি তার প্রতিভাকে সমানভাবে মঞ্চ এবং চলচ্চিত্রে ভাগ করে নেন। ইঙ্গমার বার্গম্যান ১৯৬৩-৬৬ সাল পর্যন্ত সুইডিশ রয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছিলেন আর সেখানে তিনি সুইডেনের প্রায় সকল প্রফেশনাল অভিনয় শিল্পীদের ভাড়া করেছিলেন। বার্গম্যান ছয় দশকেরও বেশি সময় ধরে সক্রিয় ছিলেন। ট্যাক্স ফাঁকি দেয়াকে কেন্দ্র করে একটি ভুল তদন্তে ১৯৭৬ সালে তার কর্মজীবন খুবই আশঙ্কাজনক হয়ে ওঠে। যার ফলে বার্গম্যান ক্রোধের বশবর্তী হয়ে বেশ কিছু অসমাপ্ত কাজ স্থগিত করেন, তার স্টুডিও বন্ধ করে দেন এবং নিজের সিদ্ধান্তেই আট বছরের জন্য জার্মানিতে নির্বাসনে চলে যান। কয়েক বছর পর তিনি আবার সুইডেনে ফিরে আসেন এবং তার শেষ ছবি 'ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেকজান্ডার' তৈরি করেন। তার ছবিতে সব সময় যারা নির্বাচিত হতেন সেই সব সুইডিশ অভিনয় শিল্পীদের জন্য বার্গম্যান একটি ব্যক্তিগত তথ্য ভা-ার (জবঢ়বৎঃড়ৎু পড়সঢ়ধহু) গড়ে তুলেছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন ম্যাক্স ভন সিডো, বিবি অ্যান্ডারসন, হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসন, এরল্যান্ড জোসেফসন, ইনগ্রিড থুলিন, গুনেল লিন্ডবস্নম, বেঙ্গট একেরট, অ্যানডারস এক এবং গানার বর্নস্ট্রান্ড আর প্রত্যেকেই বার্গম্যানের সাথে নূ্যনতম পাঁচবার কাজ করেছেন। এই গ্রুপে সর্বশেষ যোগ দিয়েছিলেন নরওয়ের অভিনেত্রী লিভ উলম্যান যিনি বার্গম্যানের নয়টি ছবিতে (১৯৬৬ সালে "পারসোনা" ছবিতে অভিনয় করেন) এবং একটি টেলিভিস্যুয়াল ছবিতে (সারাব্যান্ড) অভিনয় করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত শিল্প চর্চা এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে উভয় ক্ষেত্রে বার্গম্যানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। লিন উলম্যান (জন্ম ১৯৬৬) নামে তাদের একটি মেয়ে ছিল। 'থ্রো এ গ্ল্যাস ডার্কলি (১৯৬০)' নির্মাণের সময় ইঙ্গমার বার্গম্যান তার বহু দিনের সঙ্গী সিনেম্যাটোগ্রাফার ভেন নাইকভিস্ট এর সাথে তিনি ১৯৮৪ সালে ছবি নির্মাণ হতে অবসর নেন এবং এরপর ২০০৩ সালে ৮৫ বছর বয়সে তিনি মঞ্চ নাটকের পরিচালনা হতে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৫৯ সালে ওয়েডলকে তাদের মেয়ে মারিয়া জন্মাবার পর বার্গম্যান অবশেষে ইনগ্রিড বার্গম্যানকে (ইনগ্রিড ভন রসেন) ১৯৭১ সালে বিয়ে করেন। এটা ছিল তার একমাত্র বিয়ে যা বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়নি। তার দাদী তাকে সিনেমার সাথে পরিচয় করান এবং যখন তিনি খুব ছোট আর তার কঠোর হৃদয়ের বাবা যখনও পর্যন্ত তাকে ছবি দেখার অনুমতি দেননি সেই সময় তাকে নিয়ে তার দাদী প্রায়ই খুব গোপনীয়তার সাথে সিনেমা দেখতে যেতেন। যেখানে তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন সেই ফ্যারো আইল্যান্ডে তাকে কবর দেয়া হয়। হ্যারিয়েট অ্যান্ডারসনের সাথে ১৯৫২ থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত এবং বিবি অ্যান্ডারসনের সাথে ১৯৫৫ সালে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত প্রণয়াবদ্ধ ছিলেন। সুইডিশ, ফরাসী এবং ইংরেজি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। চলচ্চিত্র ছাড়া শিল্পের এমন কোনো ধারা নেই যা সাধারণ সচেতনার বাইরে চলে যেতে পারে। সরাসরি পেঁৗছতে পারে আমাদের আবেগের কাছে, অন্ধকার পরিবেষ্টিত ঘরে মনের গভীরে। চলচ্চিত্রের প্রতিটি বিষয় আমাকে নিজেকে শিখতে হয়েছে। মঞ্চের জন্য গোটেবার্গে একজন বিস্ময়কর মানুষের সাথে কাজ করেছি, যেখানে আমি চার বছর খেটেছি। তিনি ছিলেন একজন শক্ত ও কঠিন মানুষ, কিন্তু মঞ্চকে বুঝতেন এবং তার কাছে থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ছবির জন্য শেখাবার কেউ ছিল না। যুদ্ধের আগে আমি ছিলাম স্কুলের ছাত্র। তারপর যুদ্ধের সময় কোনো বিদেশি ছবি দেখতে পারিনি। সময়ের সাথে সাথে ইে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে, স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে লালন পালনের পাশাপাশি আমি কাজ করেছি। সৌভাগ্যবশত শুরু থেকেই প্রকৃতিগতভাবে আমি নিজেই নিজেকে নির্দেশ দিতাম, অনেকটা এমন যে নিজেই নিজের শিক্ষক, যদিও তাতে কখনো কখনো স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম না। নিজের সাথে নিজে কথা বলা মানুষ কোনো কোনো সময় টেকনিক্যাল দিকটায় খুব বেশি মনোযোগ দিয়ে ফেলে। 'একটি ছবির কাহিনীকে ক্যামেরায় ধারণ করা পুরো জগৎকে সংগঠিত করার মত।' একটি ব্যর্থ প্রেম, যার পরিণতি ছিল আত্মহত্যা (কারো ব্যক্তিগত জীবন থেকে নেয়া) এরকম একটি কাহিনীকে অবলম্বন করে ১৯৪৫ সালে বার্গম্যান তার প্রথম ছবি 'ক্রাইসিস' পরিচালনা করেন। এর পরপরই তিনি আরো কিছু ছবি পরিচালনা করেন। কিন্তু ১৯৫৬ সালে 'দ্যা সেভেন্থ সিল'-এর মাধ্যমে বার্গম্যান সমালোচনা এবং জনপ্রিয়তার শিখরে পেঁৗছে যান। 'দ্য সেভেন্থ সিল একজন যোদ্ধার নৈতিকতার কাহিনী যিনি তার ধর্ম সম্পর্কে সন্দেহের সন্তোষজনক উত্তর খুঁজে বেড়ান এবং জগতের রহস্য উন্মোচন করেন, মৃত্যুকে দাবা খেলায় চ্যালেঞ্জ করেন। এমনকি বার্গম্যানের সমালোচকরা পর্যন্ত একমত যে এই ছবিটিতে অসাধারণ নাটকীয় ক্ষমতার দুঃসাহসিক দৃশ্য আছে। এর এক বছর পর যৌবন বার্ধক্যের মধ্যে যে ভিন্নতা তার উপর একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে বার্গম্যান পরিচালনা করেন 'ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজ'। তার পরবর্তী ছবি 'দ্যা ম্যাজিশিয়ান' (১৯৫৯)-এর মাধ্যমে বার্গম্যান তার পূর্ববর্তী প্রতীকী কাজের ধারায় ফেরেন, যেখানে কিছুকে কিছুকে বোঝাবার জন্য বিভিন্ন বস্তু বা বিষয়কে ব্যবহার করা হয। এটি একদল ভ্রাম্যমাণ যাদুঘর এবং তাদের অপার্থিব ক্ষমতা ব্যবহারের গল্প নিয়ে তৈরি। অল্প কিছু কাজের পাশাপাশি ১৯৬০ তিনি তৈরি করেন 'ভার্জিন স্প্রিং'। ১৯৬১ সালে বার্গম্যান তার উচ্চাভিলাষী তিনটি ছবি নিয়ে উঠে পড়ে লাগেন। শুরু করেন ঘোর, উন্মত্ত, পারিবারিক সহিংসতার পর্যবেক্ষণমূলক ছবি 'থ্রো এ গ্ল্যাস ডার্কলি' দিয়ে। দ্বিতীয় অবদান 'উইন্টার লাইট (১৯৬২)', বিশ্বাস হারিয়ে যাওয়ায় শূন্যতার উপস্থাপন। তৃতীয় ছবি 'দ্য সাইল্যান্স (১৯৬৩), যোগাযোগ সমস্যার রহস্য উদঘাটন। এই তিনটি ছবির মাধ্যমে ঈশ্বরের অনুপস্থিতির কারণে সৃষ্ট উদ্বিগ্নতা প্রকাশ পায়। ফলে জগত সম্পর্কে বার্গম্যানের ক্রমবর্ধমান জটিল দৃষ্টিভঙ্গি উন্মোচিত হয়। মৃদু কাব্যিক ধরনের ছবি 'পারসোনা (১৯৬৬)' তেও এক ধরনের জটিলতার স্বাক্ষর পাওয়া যায়। এই ছবির কাহিনী এক অদ্ভুত সম্পর্ককে ঘিরে যেখানে এক তরুণী নায়িকা যে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে এবং একজন বাঁচাল নার্স যে তার সেবায় রত। ১৯৬৮ সালে একজন শিল্পীকে নিয়ে নির্মাণ করেন 'দ্য আওয়ার অফ দ্য ওলফ' যার ওপর ভূত ভর করে। এই ছবিটির মাধ্যমে বার্গম্যানের পূর্বের ধর্মীয় অবিশ্বাসের বিপরীতে কিছু অনুশোচনীয় অনুভূতির সন্ধান মেলে। আয়কর সমস্যার কারণে ১৯৭০ সালে টেলিভিশন অনুষ্ঠান তৈরি করার জন্য নরওয়ে, জার্মানি এবং সুইডেনে অবস্থানকালে বার্গম্যান খুব বেশি খরচ করেন। সেই সময়ে তার নাটক নির্ভর ছবিগুলোর মধ্যে ছিল 'ক্রাইস এন্ড হুইসপারস (১৯৭১), এবং 'অটাম সোনাটা (১৯৭৮)'। টেলিভিশনে যেসব কাজ করেছেন তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে একই বছরে নির্মিত 'সিনস ফ্রম এ ম্যারেইজ (১৯৭৩)' এবং 'দ্য ম্যাজিক ফ্লুট'। ১৯৮২ সালে বার্গম্যান তার জীবনের বিস্তারিত বিবরণ সমৃদ্ধ একটি আত্মজীবনীমূলক ছবি 'ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেকজান্ডার' মুক্তি দেন। যেহেতু এটা ছিল তার শেষ ছবি তাই তার পুরনো কাজগুলো থেকে এই ছবিটির মধ্যে বহু আলাদা ধরনের বিষয় লক্ষ্য করা যায় এবং এই ছবিতে তার জীবন এবং কর্ম সম্পর্কে একটি শক্তিশালী সারমর্ম প্রতিফলিত হয়। 'ফ্যানি অ্যান্ড অ্যালেকজান্ডার' ছবিটি থেকে বার্গম্যান ১৯৮৮ সালে তার আত্মজীবনী 'দ্য ম্যাজিক ল্যানট্যার্ন' এবং ১৯৮৯ সালে 'বেস্ট ইনটেনশন' নামে একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন এবং সুইডিশ টেলিভিশন আর মঞ্চের জন্য তার লেখা এবং পরিচালনা অব্যাহত রাখেন। ১৯৯১ সালে বার্গম্যানের চিত্রনাট্য অবলম্বনে সুইডিশ টেলিভিশনের জন্য তৈরি হয়েছিল বেস্ট ইনটেনশন। ২০০১ সালে 'ফেইথলেস' মুক্তি পেল, এটি লিখেছিলেন বার্গম্যান কিন্তু পরিচালনা করেছিলেন অভিনেত্রী লিভ উলম্যান। বার্গম্যান এই ছবিটির কাহিনী বিশ্বাস করতেন_ একজন পুরষের সঙ্গে একজন বিবাহিত নারীর উন্মাতাল প্রেম_ এটা ছিল অনেকটা তার ব্যক্তিগত জীবনের ছায়া মতো। পৃথিবীতে একজন অন্যতম স্মরণীয় বিখ্যাত পরিচালক হিসেবে আজো বার্গম্যান এবং তার ছবিগুলো বহুল পরিচিত হয়ে টিকে আছে। বহু সুপরিচিত আমেরিকান পরিচালক, যেমন উডি অ্যানেনের মতো পরিচালকরা বার্গম্যানকে উল্লেখ করেছেন। বার্গম্যানের ছবি প্রায়ই সুইডেনের বাইরে বিভিন্ন টাইটেলে মুক্তি পেতো। বার্গম্যান সব সময় নিজেই চিত্রনাট্য লিখতেন। লিখবার আগে মাসের পর মাস অথবা বছর ধরে সেটা নিয়ে চিন্তা করতেন। তার নির্মিত শুরুর দিকের ছবিগুলো খুবই সতর্কতার সঙ্গে নির্মাণ করেছিলেন এবং সেগুলো করতেন হয় তার নাটক অবলম্বনে অথবা অন্য লেখকদের সঙ্গে যৌথভাবে লিখে। বার্গম্যান উল্লেখ করেন তার পরবর্তী কাজগুলোতে যখন কোনো সুযোগ আসতো তার ইচ্ছাতেই শিল্পীরা একটু ভিন্নভাবে কাজ করতে চাইতেন। তিনি তাদেরকে সেভাবেই কাজ করতে দিতেন। যদি তিনি তা না করতেন তবে অনেক সময় কাজের মান খুবই খারাপ হতো। তার ক্যারিয়ারে উন্নতি আসার সঙ্গে সঙ্গে বার্গম্যান তার অভিনয় শিল্পীদের অব্যাহতভাবে সংলাপ ইমপ্রোভাইজ করতে বলতেন। তার শেষের দিকের ছবিগুলোতে তিনি শুধু দৃশ্যের ধারণাগুলো লিখতেন এবং তার শিল্পীদের সেই দৃশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঠিক সংলাপ বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করতেন। বার্গম্যানের ছবিতে সচরাচর মৃত্যু, একাকীত্ব এবং ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে প্রশ্ন বিদ্যমান থাকতো। তার নারী চরিত্রগুলো যৌনাচারে পুরুষদের চেয়ে বেশি অগ্রগামী ছিল এবং তারা তা অসঙ্কোচে প্রকাশ করতেন। কোনো কোনো সময় মাত্রা ছাড়ানো শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে (যেমন 'ক্রাইস অ্যান্ড হুইসপারস) তা প্রকাশ পেতো। যেন কোনো যাদুকরের যাদু প্রদর্শনের মতো। ১৯৬০ সালের টাইম ম্যাগাজিনের কভার স্টোরিতে বার্গম্যান নিজেই নিজেকে সেই যাদুকর বলেছেন। ১৯৬৪ সালে প্লেবয় পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'চরম যৌনাচার খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বিশেষ করে আমার জন্য। সবচেয়ে বড় কথা আমি শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক ছবি বানাতে চাইনি। আমি চেয়েছি দর্শকরা আমার ছবি বসে বসে বোঝার চেয়ে অনুভব করুক, স্পর্শ করুক। এটা আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বার্গম্যান চলচ্চিত্রে তার অবদানের জন্য পৃথিবীব্যাপী বিখ্যাত, এছাড়াও তার জীবনে তিনি একজন সক্রিয় এবং সৃষ্টিশীল মঞ্চ পরিচালক। স্টকহোম ইউনিভার্সিটিতে তার পড়াশোনাকালীন সময়ে তিনি এই ইউনিভার্সিটির ছাত্র নাট্য সংঘে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। গ্র্যাজুয়েশনের পর তার প্রথম কাজ ছিল স্টকহোম থিয়েটারের একজন শিক্ষানবিস পরিচারক হিসেবে। ২৬ বছর বয়সে তিনি ইউরোপের হেলসিংবর্গ থিয়েটারের সর্বকনিষ্ঠ মঞ্চ ব্যবস্থাপক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি হেলসিংবর্গে তিন বছর অবস্থান করেন এবং তারপর তিনি ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত গোথেনবার্গ সিটি থিয়েটারের পরিচালক মনোনীত হন। তিনি ১৯৫৩ সালে ম্যালমো সিটি থিয়েটারের পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন এবং সাত বছর এই দায়িত্ব পালন করেন। তার অনেক তারকা অভিনয় শিল্পী ছিলেন যাদের সঙ্গে তিনি মঞ্চে কাজ শুরু করেছিলেন এবং ষাটের দশকে বার্গম্যানের নাট্যদলের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিলেন ম্যালমো সিটি থিয়েটারের কর্মীরা (যেমন ম্যাকভন সিডো)। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত তিনি স্টকহোমে রয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারের পরিচালক এবং ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত ম্যানেজার ছিলেন যেখানে তিনি দীর্ঘ সময় ধরে সম্মিলিতভাবে কোরিওগ্রাফার ডনিয়া ফইয়ারের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। কর ফাঁকি দুর্ঘটনার কারণে বার্গম্যান সুইডেন থেকে চলে যাওয়ার পর তিনি জার্মানির মিউনিখে রেসিডেন্স থিয়েটারের পরিচালক হিসেবে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত কাজ করেন। তিনি ১৯৯০ পর্যন্ত মঞ্চে অত্যন্ত সক্রিয় ছিলেন এবং ২০০২ সালে রয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারে তার শেষ প্রযোজনা হেনরিক ইবসেনের 'দ্যা ওয়াইল্ড ডাক' দিয়ে মঞ্চ পরিচালনার সমাপ্তি টানেন। তিনি মিউনিখে থেকে তার সব কাজ পরিচালনা করতেন। ১৯৭৮ সালের মাঝামাঝি বার্গম্যান সুইডেন সরকারের প্রতি তার কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতা পরিহার করেন। ফ্যারোতে তার ষাটতম জন্মদিন পালন করার জন্য ওই বছরের জুলাই মাসে তিনি সুইডেন ভ্রমণ করেন এবং লয়্যাল ড্রামাটিক থিয়েটারের পরিচালক হিসেবে আংশিকভাবে তার কাজ আবার শুরু করেন। তার ফিরে আসার সম্মানে সুইডিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট চলচ্চিত্রে সম্মানসূচক অবদান রাখার জন্য তার নামে একটি সম্পূর্ণ নতুন পুরস্কার 'ইঙ্গমার বার্গম্যান পুরস্কার' চালু করেন। এরপরও ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি মিউনিখে ছিলেন। ২০০৫ সালে ফ্যারো আইল্যান্ডে নেয়া তার শেষ এক সাক্ষাৎকারে বার্গম্যান বলেন যে, রাগের বশবর্তী হয়ে চলে যাওয়ার জন্য তিনি তার কর্মজীবন থেকে আটটি বছর হারিয়েছেন। বার্গম্যান চলচ্চিত্র পরিচালনা থেকে ২০০৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে তার নিতম্বে অস্ত্রোপচার করা হয় এবং অনেক কষ্টভোগের পর আরোগ্য লাভ করেন। ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই আটানব্বই বছর বয়সে ফ্যারো আইল্যান্ড, গটল্যান্ডস ল্যান, সুইডেনে তার বাড়িতে ঘুমের মধ্যে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ওই একই দিনে আরেকজন বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক মাইকেল অ্যাঞ্জেলো অ্যানতোনিওনিও মারা যান। ২০০৭ সালের ১৮ আগস্ট এক পারিবারিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে তাকে ফ্যারো আইল্যান্ডে সমাহিত করা হয়।

বখশিশ


সারোয়ার কবীর দক্ষিণ খানের জমিটা বিক্রি করবার পারলে তোরে আমি পাক্কা এক লাখ টাকা বখশিশ দিমু। : কী যে কচ্ছেন বস! : আচ্ছা, টাকাটা পাইলে তুই কী করবি? এবার চট করে জবাব দিতে পারে না ফালান। পরক্ষণে অবশ্য বলে_ স্যার, অত টাকা পালি ডেইলি দুইবারে জায়গায় তিনবার আপনার হাত-পা টিপবো। সারা বডি ম্যাসেজ করে দিব। কথাটা শোনার পর বস শুধু উচ্চারণ করেন_ হুঁ। বেলা আটটা-সাড়ে আটটা হবে বড়জোর। একটু আগে বস মর্নিংওয়ার্ক করে ফিরেছেন লেডিসপার্ক থেকে। নিচতলার বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে আছেন। ট্রাকস্যুট ছাড়ার পর কেবল হাফপ্যান্ট পরা, থলথলে শরীর। মাথা ম্যাসেজ শেষে ফালান ঘাড়টা ম্যাসেজ করচে, তারপর দুই হাত, পিঠ-কোমড়, শেষে দুই পা। আবার রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আরেক দফা হাল্কা ম্যাসেজ। এ বাড়িতে তার প্রধান কাজটাই হলো বসের শরীর বানানো, তার বাদে অন্যান্য ফুটফরমায়েশ। বাজার বা সুপার মার্কেটের দোকান থেকে এটা ওটা আনা। বারান্দার সামনে ফেরারি করা বাগান। ডান পাশে গ্যারেজের ওপর সার্ভেন্ট কোয়ার্টার। দারোয়ান ও ড্রাইভারের পাশাপাশি ফালানও থাকে সেখানে। আলাদা আলাদা চৌকি। আগে বসের ড্রাইভার ছিল রহিম, দুবাই চলে যাওয়ার আগে তাকে এ বাড়িতে চাকরিটা দিয়ে গেছে। শর্ত ছিল একটাই ম্যাসেজ জানতে হবে। ফালান সেই ছোট্টবেলায় সৎ মায়ের ঝাঁটাপেটা খেয়ে বাড়ি ছেড়ে ছিল। নগরবাড়ী ঘাটে তারই বয়সী দুলালের সঙ্গে দোস্তি পাতায়। ছেলেটা ফেরিতে ফেরিতে লোকজনের মাথা মালিশ, গা-হাতপা টিপে দিতো। তার কাছেই ম্যাসেজের তালিম নেয়। শেষে এখানে সেখানে ভাসতে ভাসতে এই ঢাকায় এসে ফুলবাড়িয়া বাস টার্মিনালে ঠাঁই হওয়ার পর এক হরতালের আগের রাতে পুলিশ অনেকের সঙ্গে তাকেও লরিতে তুলে নেয়। বাকি রাত থানা হাজতে রেখে পরের দিন চালান করল কোর্ট-কাচারিতে। আত্মীয়স্বজন কেউ ছিল না যে ফালানকে ছাড়িয়ে আনবে। ফালতু হিসেবে কয়েক মাস কাটাতে হলো জেলখানায়। সেখানে কতজন তাকে দিয়ে শরীর টিপিয়েছে। শেষে রশিদ মিয়া জেলখানা থেকে বের করে আনে। তার সঙ্গে সেখানেই পরিচয়। জালিয়াতির মামলায় লাল দেয়ালের ভেতরে যাওয়া কালো মোটাসোটা লোকটার শরীরে কেমন বোকটা গন্ধ থাকলেও দিলটা ছিল দরিয়া। তাকে বেশ আদর সোহাগ করে বলতো_ ফালান, তুই পোলা না অইয়া মাইয়া অইলে তোরে আমার তিন নাম্বারের বিবি বানাইয়া ঘরে লইয়া যাইতাম। ঘরে না নিলেও রশিদ মিয়া তাকে এক রিকশা গ্যারেজে ম্যানেজার বানিয়ে দেয়। হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাকে লোকটা মারা না গেলে ফালানকে আজ বসের বাড়ি এ কাজ নেয়ার দরকার হতো না। : কি রে ফালান, কইলি না এক সঙ্গে এক লাখ টাকা পাইলে কী করবি? জবাবটা দিতে গিয়ে আবারও দ্বিধায় জড়িয়ে যায়। এক লাখ, একসঙ্গে! হিসাব মেলাতে না পেরে ফালান বলে_ কি যে কচ্ছেন বস, অত টাকা দিয়ে করমু কী? : ক্যান, টাকা পেলে দুই আগে বিয়া করবি। : কী যে কচ্ছেন বস, আমাকে কোনো মেয়ে বিয়া করবি! : ক্যান করবে না? : বস, যে কামাই আমার; বুঝলেন না, আজকাল মেয়েদের বেশি ডাটফাট। যে বেতন পাই, তাতে বউয়ের কী পোষাবি? : লাখ টাকা বখশিশ পাবি। অর্ধেক টাকা বিয়ায় খরচ করবি। বাকি টাকা দিয়ে কারবার করবি। ফুটপাত কিংবা বাজারে কাঁচামাল নিয়ে বসলেই তোর অনেক ইনকাম হবে। তোর সংসারের খরচ পুষিয়ে যাবে। : তা অবশ্য ঠিক বলেছেন, স্যার! খানিকটা উপুড় হয়ে পিঠ ম্যাসেজের সুখানুভূতিতে চোখ ভেজা বসের ঢোলা হাফপ্যান্টের ডান পকেটের ভেতর থেকে মোবাইল ফোন বেজে ওঠে আচমকা। ঝটপট সেট বের করে কানে ঠেকিয়ে বস কল রিসিভ করেন_ হ্যালো, কে_ ওহ হো খুররম! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। জাস্ট ওয়েট। আমি এখনই রওয়ানা হচ্ছি। বস আর বসলেন না। ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ফালানের দিকে বসেন_ যা তোর আজ ছুটি। বিকেলে ঘুরে আসিস কোথাও থেকে। আমার ফিরতে রাত হবে। ফালানের বুঝতে বাকি থাকে না বসের মুড শুধু নয়, তার দিনটাও ভালো, আসমানের চাঁদ হাতে ধরা দিতে চাচ্ছে। ২. বস গোসল-টোসল সেরে জামকালো গাড়ির পেছনের সিটে গা এলিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ফালানের সত্যিই ছুটি। রাত পর্যন্ত তার ওপর খবরদারি করার কেউ নেই। বিবি সাহেব গেছেন সেই আমেরিকায় বোনের কাছে বেড়াতে। ফালান মন ঠিক করে, বিকেলে ঘুরতে যাবে। এ বাড়িতে চাকরি নেয়ার পর গুলশান থেকে বড় একটা বেরোয়নি। যাবেই বা কোথায়? আজ ফার্মগেটে গিয়ে সিনেমা দেখবে। সেটা না করলে চলে যাবে মালিবাগ মোড়। বাস থেকে নেমে শান্তিবাগে হেঁটে যাবে। এক লাখ টাকা বাপের জিন্দেগিতেও চোখে না দেখলেও বসের কথা শোনার পর থেকেই হিম্মতটা সত্যিই বেড়ে যাচ্ছে। যদিও বসের বখশিশ দেয়ার ব্যাপারটা কাউকে জানায়নি। সবাইকে বিশ্বাস করতে নেই। ব্যাপারটা জানতে পারলে কেউ না কেউ আবার কান ভাঙানি দিতে পারে। এক লাখ টাকা হাতে পাওয়ার দৃশ্যটা কল্পনা করতেই তার শরীরে সত্যিই শিহরণ খেলে যায়। একটা বাহাদুরি ভাব ভর করে মনের ভেতর। গুলশান দুই নাম্বারের সুপার মার্কেটের সামনে থেকে ৬ নাম্বার বাস মহাখালী ওয়ারলেস গেট আসতেই কন্ডাক্টর ভাড়া নিতে আসে। ফার্মগেটের ভাড়া দিতে গিয়ে জানতে পারে, বাস নাবিস্কো-তিব্বত হয়ে সোজা চলে যাবে মগবাজারের দিকে। ফার্মগেটে গেলে মহাখালী মোড়ে নামতে হবে। ওদিকে আর না গিয়ে মালিবাগ মোড়ের ভাড়া কাটে ফালান। সিনেমা না হয় আরেকদিন দেখা যাবে। বস তাকে এক লাখ টাকা দেবে দৃশ্যটা চোখের সামনে ঝুলতে থাকলে তার মনে হয়, দুনিয়ায় সত্যিই অনেক ভালো মানুষ আছে। মাস চার-পাঁচ হতে চললো, দু'বেলা করে বসের বডি ম্যাসেজ করে দিচ্ছে। আর তাতেই কেল্লাফতের মতো একটা ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। কোটিপতি মানুষ, অর্থ-সম্পদের অভাব নেই। তার দিকে একটু নজর দিলেই ভেসে যায়। মালিবাগ মোড়ে নেমে ফালান শান্তিবাগের ভেতরে ঢোকার রাস্তায় পা রাখে। বাজারের কাছাকাছি গেলে বাঁদিকের গলির ভেতর এক বস্তিবাড়ি। বস তাকে এক লাখ টাকা দেবে। কথাটা এখন মর্জিনার মাকে বলবে না। গুলশানে কাজ পাওয়ার আগে তার কাছেই ছিল সে। মহিলা প্লাস্টিকের বক্সে খাবার ভরে সাপ্লাই দেয় পল্টন-মতিঝিলের অফিসে অফিসে। ফালান সে খাবার রিকশায় করে পেঁৗছে দিতো জায়গায় জায়গায়। মর্জিনা মায়ের এক ভাতিজি আছে। জ্যোৎস্না। গায়ের রঙ অবশ্য ফকফকে না হলেও চেহারাটা দারুণ। সিনেমার নায়িকাদের মতন। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর চাকরি করে মিরপুরের কোনো এক গার্মেন্ট কারখানায়। বোরখা পরে মাঝে মধ্যে ফুফুর কাছে আসতো। ওকে দেখলে ফালানের শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। বসের টাকাটা হাতে পেলেই সাহস করে প্রস্তাবটা দিয়ে বসবে। শান্তিবাগের চিপা গলিতে পা রেখে ফালান অবাক। সেই বস্তিবাড়ির টিনশেডের লম্বা ঘরগুলো আর নেই, বিল্ডিংয়ের ফাউন্ডেশন উঠছে। গলির পরিচিতি মুদি দোকানদারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, মর্জিনার মা এখন খিলগাঁওয়ের ওদিকে থাকে। ঠিকানাটা জানা নেই। ৩. পরদিন যথারীতি বসের থলথলে বডি ম্যাসেজে ব্যস্ত ফালান। এক পর্যায়ে না বলে পারে না_ স্যার, সত্যিই আমারে এক লাখ টাকা দেবেন? : ক্যান তোর বিশ্বাস হচ্ছে না! তাইলে সামনে আয়। বখশিশটা নে। বসের কথামতো ফালান তার সামনে এসে দাঁড়ায়। : এবার ঘুরে দাঁড়া। ঘুরে দাঁড়ানো মাত্রই পাছায় আচমকা লাথি খেয়ে ফালান প্রায় ছিটকে পড়ে কেয়ারি করা দোলনচাঁপা ঝাড়ের পাশে। ঘাড় ফেরাতেই বসের উৎফুল্ল মুখটা ঠিক কসাইয়ের চাপাটি হয়ে কোপ বসায়_ বিয়া করবার খুব শখ জাগছে? (Ref: the daily Jaijai din)

বাংলা কবিতায় মনবর্ষা

ষ মাতিয়ার রাফায়েল দক্ষিণ এশিয়ার বর্ষা, ধ্রুপদ ভারতবর্ষের এক অনতিরম্য পরিচয়। আচম্বিতেই যে অপূর্ব নীলিমাজুড়ে কীসব মেঘের আবর্জনায় ভরে ওঠে মধ্যআকাশ, ঈষাণে-নৈর্ঋতে, সে যদি শুধুই কার্পাসমতো মেঘের আবর্জনা হতো কে ভালোবাসতো আকাশের ওই রূপকে! প্রচ- ঝড়ের কু-লী সৃষ্টির মধ্যদিয়ে যে বৃষ্টির পূর্বাভাস দমকে দমকে ওঠে আকাশের ওই রূপটিতে, তা-ই ঝমঝমিয়ে, রিমঝিমিয়ে বৃষ্টি হয়ে আসে। তাতে যে সৃষ্টির সকল প্রাণের স্বার্থ নিহিত। প্রাগ্জ্যোতিষপুর বা হিমালয়দূহিতা যতো নদী আছে, নদীশাখা আছে, মেঘমল্লার আছে, এগুলো ভারত উপমহাদেশকে এমন এক অনন্য ও অনবদ্য সুপ্তিসুষমা এনে দিয়েছে যে বর্ষা শেষেও প্রতিটি তনুকূপে প্রাণের কান্তি ধরে রাখে। জ্যৈষ্ঠের গরমঠাপে প্রাণ যখন তেলাপোকার মতো উল্টান ভাঁজামাছ বিশেষ, কাঁঠালের কাটা বেঁধা প্রাণের টানে তখনই ধেয়ে আসে আদিগন্তমাঠজুড়ে ঝিরিঝিরি রিমঝিম ঋতুবর্ষা। কী এক উদ্বেগমাখা বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে পুকুরে, বিলে ও নদীতে। আবার বৃষ্টি থামতেই সহসা বিবিধ ফড়িংগুলোও উড়ছে যদৃচ্ছাক্রমে এখানে ওখানে। কখনও বা গিয়ে বসছে কোনো বাঁশের মাথায়। খড়ের ঢিবির মাঝে যে বাঁশ, সে বাঁশের মাথায়। বা কোনো দিগ্বালিকার বেনীপাকানো চুলের গুচ্ছে। এই যে চিত্রকল্পগুলো, সে গন্ডগাঁয়ের। যারা ধরে রেখেছে এখনও বৃষ্টির তুমুল অধিকার। নগরের চিত্রদর্শন নিশ্চয় অন্যমতো ছিলো। যে নগরগুলো ছিলো দূরে অদূরে প্রাকার বেষ্টিত চকমিলান জাতীয় অবকাঠামো সৃষ্ট। তার দেখা বর্ষা নিশ্চয় অভিজাত। বর্ষা অনুভবে, উপলব্ধিতে যতোই মনোরম হোক, তাতে তবুও কতো যে বিড়ম্বনা, সে অজগাঁ হোক কি গন্ডগাঁ, সে সকল যাপিতজীবনের অধিবাসীরাই শুধু জানতেন। বৃষ্টি উদ্ভুত সে বিড়ম্বনার মধ্যেই যে সৌন্দর্যটুকু, সেটাই বর্ষার প্রকৃত সৌন্দর্য। এর সাথে কবেই তো চির বিচ্ছেদ ঘটেছে বাংলা কবি ও কবিতার। সো মহ কন্তা দূর দিগন্তা। পাউস আএ চেলু দুলাএ ওই যে আমার কান্ত, দূরে দিগন্তে। বর্ষা আইলো ফের আঁচল দুলায়ে কালের পাতায় ওই একটি মাত্র পঙ্ক্তিতে টিকে থাকা অন্তর্গত যে 'রসবস্তু', সে যেন দূর আকাশে হারিয়ে চিরস্থির এক চিলতে মেঘের রেখায় জিইয়ে রইছে এখনও এতটুকুন 'আশা' হয়ে। পঙ্ক্তিটি হয়তো কোনোও অবহট্ঠপ্রাণা কিশোরী বধূ'র, বা প্রাকৃতের চৌকাঠে সদ্য পা রাখা কোনো তরুণীবধূর। বা সে কোনও প্রাণচঞ্চল দিগ্বালিকারও হতে পারে। বাক্যটির রচয়িতা কে, কোনও 'গোষ্ঠীস্মৃতি'ও ধরে রাখলো না তাকে। কিন্তু যতোদিন বাংলার মাটি বর্ষণসিক্ত হতে থাকবে ততোদিন ওই পঙ্ক্তিটির আবেদন থাকবেই। কেননা, পঙ্ক্তিটি যে কালের অভ্ররঙা পৃষ্ঠায় দুটি চিরায়ত পঙ্ক্তি! পঙ্ক্তি দুটিতে হয়তো আরও দু'একটি পঙ্ক্তি ছিলো, কিন্তু সে পঙ্ক্তি চিরকালের জন্যই হারিয়ে গেছে! সপ্তম শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে সংস্কৃত ভাষার বিপরীতে এতদ্দেশীয় বাংলারই পূর্বজ ভাষা অবহট্ঠ ভাষায় একরকম পেলব শ্বসাঘাতি উচ্চারণে তৎকালীন লোকজীবনে অনেক পঙ্ক্তি রচিত হয়ে থাকবে। উপর্যুক্ত পঙ্ক্তিযুগল তারই নিবিড় আত্মীয় বিশেষ। ওই পঙ্ক্তি যে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলার লোকজীবনে পরিপুষ্ট ছিলো, ফি বছর মেঘের বার্তায় তারই অনতিউচ্চ সাক্ষী হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'বর্ষা' কবিতায় পুনরায় ধরে রাখলেন : কোন মোহিনীর ওড়না সে আজ উড়িয়ে এনেছে, পূবে হাওয়ায় ঘুমিয়ে আমার অঙ্গে হেনেছে; চম্কে দেখি চক্ষে মুখে লেগেছে এক রাশ, ঘুম-ভাঙানো কেয়ার রেণু, কদম ফুলের বাস। সেই অবট্ঠের যুগরসে সিক্ত হতে হতে গড়ে ওঠা নতুন 'প্রাকৃত বাংলা' কবিতার ভাব প্রকাশেও একটা কাঠামো পেয়ে গেলো। গীতের আবহে প্রকাশিত এসব পঙ্ক্তিগুচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী গ্রামবাংলার লোকজীবনকে নিমগ্ন রেখে গেছে। কালপরিক্রমায় হাজার হাজার পঙ্ক্তি রচয়িতারা সহসা কবেই লুপ্ত। যেসব পঙ্ক্তি রচয়িতারা প্রধান পঙ্ক্তি রচয়িতাদের তুলনায় গৌণ হয়ে পড়েন, তাদের পঙ্ক্তি 'অজ্ঞাতনামা' পরিচয়ে লোকমুখে কিছুকাল প্রচলিত থাকলেও কালক্রমে একসময় লুপ্ত হয়ে যায়। তখন তো আর কবিদের 'কবরস্থান' বলে কোনো 'এন্থলজি'র সুযোগ ছিলো না। সেই লুপ্তি থেকে বেঁচে যাওয়া ওই পঙ্ক্তিদুটোতে যে সাক্ষ্য বহন করে সেটা সে পঙ্ক্তির ভাষাগত নমনীয়তা। যে নমনীয়তার মধ্যদিয়ে চর্যাগীতিকা'র মতো, গীতগোবিন্দ'র মতো বৃষ্টিবর্ষিত 'ললিতলবঙ্গলতা'র মতো 'পরিশীলিত' কাব্য সম্ভব হয়ে উঠেছিলো। মেঘৈর্মেদুরমসুরং বনভূবঃ শ্যামান্তমালদ্রুমৈর্নক্তং ভীরুরয়ং ত্বমেব তদিমং রাধে গৃহং প্রাপয়। ইত্থং নন্দনিদেশতশ্চলিতয়োঃ প্রত্যধ্বকুঞ্জদ্রুমং রাধামাধবয়োর্জয়তি যমুনাকূলে রহঃ কেলয়ঃ মেঘে মেদুরা এই সে আকাশ, তমালগুচ্ছে শ্যামাচ্ছন্নবনভূমি। রাত্রিমতো, সে এই ভীরু, তাকে পৌঁছে দিওগ' গৃহে তুমি রাধে এমতো নন্দনিদেশে চলে রাধামাধবের কুঞ্জকেলি প্রতিটি কদমে পথে পথে যায় তরুচ্ছায়, যমুনাজঘনে জয়, জয় হরি জয়দেব (১২শতক, শেষপাদ), 'প্রাকৃত ভাষা'র উত্তমমার্গীয় কবি। তিনি যে গীতগোবিন্দ লিখেছেন, তাতে এত যে বর্ষার তুমুল মাদকরসে সিক্ত কাব্যস্ফূর্তি, ঘন বর্ষায় ডাক দিয়ে ওঠা যে রাধামাধব, বাংলায় যতো পঙ্ক্তিগুচ্ছ রচিত হতে থাকবে তার ভিতরে সে কীর্তি এক কালোত্তীর্ণ গাথামলি্লকা হয়ে থাকবে। কালিদাসের পাশে যদি কাউকে আসন দিতে হয় তা'হলে সে জয়দেবেরই সহজ প্রাপণীয়। তার পঙ্ক্তিগুচ্ছে সেকালের সহজ চিত্রকল্প যেমতো উঠে আসতে দেখা যায়, সেখানে তদানীন্তন প্রতিচ্ছবি এমতো ফুটে যে তাতে আমাদের অন্তরাত্মা মহূর্তে অনড় অচলবৎ থমকে দেয়। প্রতিটি মগজের কানায় কানায়। তা'হলে সেই বর্ষার চিত্রকল্প কি এখন আর মেঘে মেঘে ওড়ে আসা-যাওয়া করছে না আর! মেঘের কি আর সে থেকে মুক্তির উপায় আছে! সে বর্ষিত কবিতারও নেই। তবুও কোথায় যেন কী এক মেরুদুস্তর ব্যবধান। সে কি সময়ের, নাকি যাপনেরও! এই যাপনগুচ্ছগুলিই যেন সেই বর্ষার সাথে কিছুতেই মেলানো যায় না। দূর দিগন্তে মেঘ তো এখনও 'চেলু দুলাএ' দুলাএ ঘুড্ডীন ঠিকই, তবু মেঘের কোণে দৃষ্টি রাখা সেই কান্ত কান্তা কই? বর্ষার কার্পাস তো পৃথিবীর সব আকাশেই তার ঋতুর অবকাশে ঘুরে ঘুরে চরছে ফিরছে। তাতে আমাদের এই অঞ্চলে আর নতুন কি! যে প্রাণ ফুরিয়ে আসে তার জন্যে হয়তো নতুন কিছু নয়, কিন্তু যে প্রাণ নতুন করে উজয়, তার জন্য তো নতুনই বটে। তখন ফুরিয়ে যাওয়া প্রাণে যতোই জড়তা এসে ভর করুক, বর্ষার তাতে বিন্দুমাত্র বিচলন নাই, বছরে তার মাত্র একবারের স্পর্শে যে নতুন প্রাণের স্ফূর্তি দেখা দেয় তাতেই প্রাণের তারুণ্য চির চঞ্চল থাকে। বর্ষাজনিত এই প্রাণের স্ফূর্তিতেই এই ভারত উপমহাদেশে যতো বৃক্ষ ও লতাগুল্মের উচ্ছ্রিতির প্রকাশ পেয়েছে পৃথিবীর আর কোথাওই এর নজীর নাই। ফলে বর্ষা পৃথিবীর সর্বত্রই ঘুরে ঘুরে বেড়াক, আমাদের এই অঞ্চলে এই বর্ষা চির নবীন। চির নবীন যে তার সাক্ষর মেলে বর্ষা ঘিরে যতো কবিতা হয়েছে, তার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশগুলোর দিকে যদি আমাদের নজর যায়। কালিদাস (৪র্থ-৫ম শতক), সংস্কৃত ভাষার কবি। প্রায় দেড় হাজার বছর আগের অনবদ্য এক কাব্য নিদর্শন। মেঘদূতম্। মন্দাক্রান্তায় বিন্যস্ত তার এক কাব্য চির নবীই যদি না হবে, আজও তার আবেদন সেই একই মনের চির নতুন নতুন মনে দ্রবিভূত হবে কেন? পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত কাব্যটি এ পর্যন্ত বাংলায়ও অনেকগুলো অনুদিত সংস্করণ বের হয়েছে। বাংলায় অনুদিত সেগুলোর মধ্যে এখনও পর্যন্ত যেটি সবচে' বেশি পঠিত ও আদৃত, সেটি সাত মাত্রায় রচিত বুদ্ধদেব বসু'র অনুবাদ। উচ্চ বিমানের অন্তঃপুরে যেথা তোমারই অনুরূপ মেঘেরা সততগতিশীল বায়ুর চালনায় অবাধে নীত হয় কখনো- স্বজলকণিকার সংক্রমণে তারা দূষিত ক'রে দিয়ে চিত্রাবলি, সদ্য শঙ্কায় পলায় বাতায়নে, ধোঁয়ার অনুকারে, শীর্ণ। উত্তরমেঘ-৭২ বর্ষা প্রকৃতির সৃষ্টিশীল বেদনার সর্বোৎকৃষ্টতম পরিণত রূপের প্রকাশ। বিপুল প্রাণৈশ্বর্য্যর ফসলে যে দুনিয়া হয়ে ওঠেছে বহু ভাষাময়, সে তো বর্ষারই আলেখ্যমালা। ক্রমেই দানবাতিদানব হয়ে উঠা নগরায়নের দেয়ালের পিঠে দেয়ালঢাকা প্রকোষ্ঠের ভিতরেও বৈষ্ণব পদাবলীর পুরা আকর থেকে এখনও মনে হবে গ্রামসন্ধ্যার ধোঁয়াটে মতো সেকালের সেই বর্ষণসিক্ত মাটির সোঁদাগন্ধ উঠে আসছে। যে মানুষ নিজেই প্রকৃতির একটি ক্ষুদে পরিচয়, বর্ষা তার মধ্যেই পল্লবিত হয়েছে প্রবল বটপি হয়ে কী বোধে কে জানে। বর্ষাপ্রাণে শক্তিমদমত্ত এ মানুষ এখন সে প্রকৃতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললে কি আসে যায়, দেয়ালের পিঠে দেয়ালঢাকা প্রকোষ্ঠের মধ্যে যাপিতজীবনের অন্তঃস্থলেও যেরকম নকশায় পর্বতের গহীন অভ্যন্তরে সরীসৃপের মতো এঁকেবেঁকে যাওয়া বর্ষার অবশিষ্ট সঞ্চিত জলধারার মতো প্রশান্তির স্পর্শ এনে দিতে পারে, গীতগোবিন্দ বৈষ্ণবপদাবলীও তাই। এমনই এক পটভূমিকায় ওই পদাবলীর প্রকাশ ঘটেছিলো যা ছিলো মাঠ তেপান্তরডোবা বর্ষার জলঘেরা গ্রামপাটাতন। তো, সে পদাবলী থেকে বর্ষণসিক্ত মাটির সোঁদাগন্ধ উঠে আসবে না তো কী আর উঠে আসবে? বাংলা কবিতা যেখানেই যাক, পদাবলীগুলো থাকবেই। অন্তত যতোদিন আষাঢ়-শ্রাবণ আছে, ততোদিন তো বটেই। বর্ষা যেমন পৃথিবীর জন্য প্রাণ সঞ্জিবনীই না, প্রাণভোমরা রূপ মৃতসঞ্জিবনীও। বাংলা কবিতার জন্য পদাবলীর ভা-ারও তাই। বৈষ্ণবপদাবলীতে যে বহুলউক্ত 'ব্রজনৌকা' পাই সেতো সেই আদিগন্ত জলমগ্ন বর্ষারই স্মারক। ব্রজবুলি ভাষার কবি এ কালপরিক্রমায় যারা উল্লেখযোগ্য ছিলেন, বড়ু চ-ীদাস (১৪ শতক), মৈথিল বিদ্যাপতি (১৪ শতক), বাঙালি বিদ্যাপতি, চ-ীদাস, বিজয়গুপ্ত, জ্ঞানদাস, মালাধর বসু, গোবিন্দ আচার্য, রায় রমানন্দ, বৃন্দাবন দাস, মুকুন্দ দত্ত, ময়ূরভট্ট প্রমুখ সহ আরোও বহু ব্রজবুলি'র পদাবলী রচয়িতা ছিলেন, যারা বাংলা কবিতাকে প্রকৃত অর্থেই বর্ষাসিঞ্চন করে গিয়েছেন। কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তী (১৬ শতক), 'চ-িমঙ্গলে'র অবিস্মরণীয় কবি। 'কালকেতু'র মধ্যদিয়ে গড়ে ওঠা তার ওই কাব্যকীর্তিটিও বর্ষাজলমগ্ন এমনই এক ভূপ্রকৃতির চিত্রসূত্র খোলে দেয়, যার মধ্যদিয়ে অনায়াসেই প্রবেশসাধ্য হয়ে ওঠে তৎকালীন বাংলার সামাজিক ও সংস্কৃতিক পাটাতনটিতে। শিল্পকুশলতায় যেখানে কবি একান্তই নিজস্বস্বরে ভাস্বর, এই নিজস্বতায় যদি তিনি আরেকটু অগ্রসর হয়ে ঝরঝরে গদ্যভাষী হয়ে উঠতেন, তা হলে সেটা চিরকালের জন্য সময়ের এক অনবদ্য পরিচয়বাহী হিসেব বাংলার চরিত্রচিত্রণ হয়ে দেখা দিতো। কিন্তু তার ঝরঝরে কাব্যভাষই বা কম কি সে! এটি হচ্ছে পদ্যে রচিত এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত বাংলায় প্রথম উপন্যাস। সে গেলো বাংলা কবিতা আধুনিক চোখে পুষ্ট হওয়ার পূর্বকালের কাব্যপরিচিতি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে তাঁর কবিতায় বর্ষা দ্বারা বিপুল উজ্জীবিত হয়েছিলেন সে ছিলো কবি হিসেবে তিনি মনের দিক থেকে বাংলা কবিতার ধারাতেই পুষ্ট থাকতে চেয়েছিলেন। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন যে কবিতা যদি বৈষ্ণব পদাবলী সময়ের কাব্যের মতো জলদমগ্ন না থাকে তা'হলে তা কালের অাঁচরে শুখায়ে কাঠ হয়ে যাবে। 'বর্ষামঙ্গল' বইটির নামকরণের মধ্যদিয়েও বোঝা যায় কবি হিসেবে পূর্ববর্তী কবিদের মানসলোক দ্বারা তিনি কতটা ঐতিহ্যানুসারী ছিলেন। তিরিশি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কাল থেকে শুরু হয়ে অদ্যাবধি যা অকল্পনীয় বলে বিবেচিত। অনুকরণ করা যাবে, তবে তা রবীন্দ্রযুগ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। তার পরবর্তী কারো কাব্যবৈশিষ্ট্য দ্বারা নয়। বর্ষা প্রকৃতি নিয়ে বাংলাভাষায় প্রচুর গদ্যপদ্য হয়েছে। কবিতাও। বর্ষা নিয়ে রচিত কবিতার মধ্য দিয়েই প্রকৃত কবির অন্তঃস্থ শক্তিমত্তা বোঝা যায়। কবিতার সাথে কেননা বর্ষার সম্পর্কটি স্বাভাবিকভাবেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। বৃষ্টি বা বর্ষা যেমন পৃথিবীর সকল শস্য, ফল, ও প্রকৃতির প্রাণ উজ্জীবনী শক্তি, কবিতাও সেরকম পৃথিবীর সকল ভাষার প্রাণ উজ্জীবনী শক্তি বিশেষ। বর্ষা নিয়ে রচিত কবিতার অধিকাংশেই 'নারী' উপস্থিতি অত্যন্ত প্রবল। সেক্ষেত্রে নারী কবি রচিত বর্ষা বিষয়ক কবিতায় 'পুরুষ' উপস্থিতি অত্যন্তই কৃপণ। সেখানে প্রকৃতিদৃশ্যই উঠে আসছে বেশি। কবিতায় ভুলে যাওয়া হয় 'পুরুষ'সত্তা যে প্রকৃতির মোটেও বাইরের কোনও সত্তা নয়। সে যেভাবে প্রকাশিত সেটা যে প্রকৃতির স্বরূপেই প্রকাশিত এবং যেভাবেই প্রকাশিত সেভাবেই যে তা কবিতার বিষয়বস্তু হয়ে উঠতে পারে, বাংলা কবিতায় যেন তা বেমালুম ভুলে যাওয়া হয়েছে। ফলত বর্ষা বিষয়ক অধিকাংশ কবিতায় যা উঠে এসেছে তার অধিকাংশই মূলত আরোপিত ও বহু কষ্টকল্পিত ভাবোদ্রেক বিশেষ। যে কারণে বর্ষা বিষয়ক কবিতার সামগ্রিক পাটাতনটি এখনও পর্যন্ত বাংলা কবিতায় সহজাত হয়ে উঠতে পারেনি। কারো কারো কবিতায় 'পুরুষ' উঠে আসতে দেখা গেছে চটুল ও বিকৃতরূপে। সহজাত রূপে নয়। স্বয়ং কবিও নিশ্চয় যেটির সাথে বিশ্বস্ত তো ননই, বরং সে কবি'র সাথে যোগাযোগ ঘটলে দেখা যাবে এ আসলে প্রতারণার মোড়কে ঢাকা। যেন সেই বৃষ্টির মতো এ এক অবিশ্বস্ত কবি, যেমন কোথাও হঠাৎ 'এসিড বৃষ্টি' বর্ষিত হলো, ফসলের অনেক ক্ষতিসাধন করলো, সেরকম প্রকৃতিবিরুদ্ধ প্রকৃতি যে কবি'র কবিতায় দেখা দেয় তা কারো কাছে তথ্যের জন্য চকিত চমকপ্রদ হলেও নিশ্চয় সহজ ও স্থায়ী প্রীতিকর কোনও সৃষ্টিশীলতা নয়। ফলে এহেনকার কবিতায় কান্তা যেভাবেই হোক, আছে যদ্যপি, কিন্তু কান্ত দূর অস্ত অপসৃত। সৈয়দ আলী আহসান 'আমার পূর্ব বাংলা' নামে যে অনবদ্য কবিতাটি রচনা করেছেন, সেটি সমগ্র বাংলা কবিতায় অন্যতম প্রধানের একটি। বর্ষার যে সহজাততা, বর্ষাপ্রাণের মধ্যদিয়ে প্রকৃতি যেভাবে বাঙ্ময় ও লালিত্যাভিসারী হয়ে উঠে চির জাগরুক থাকে, তার শ্যামল চিত্রালেখ্যই 'আমার পূর্ব বাংলা'। কবিতায় প্রকৃতির সাবলীল সুরটি সৈয়দের কবিতায় এতাবৎ সুচারুরূপে অঙ্কিত ও প্রতিবিম্বিত হয় যে, বাংলা কবিতায় এর দৃষ্টান্ত বিরল । সহজ ও স্থায়ী প্রীতিকর কবিতা বলতে যা বোঝায় কবিতাটি তারই একটি অনবদ্য পরিচয়। গ্রামবাংলার পরিপ্রেক্ষিতে বর্ষাচিত্র অাঁকার ক্ষেত্রে জসিমউদদীন গ্রামীণ জীবনধারাকে যেরকম সহজাত ও সাবলীলভাবে বিন্যস্ত করতে পেরেছেন, তা বাংলা কবিতায় এখন কষ্টকল্পিত করেও সম্ভব নয়। জীবনানন্দ দাশের 'রূপসি বাংলা'য় চিরায়ত বর্ষাপুষ্ট যে গ্রামীণ পটভূমি উঠে আসে তার সাথেও শহুরে জীবনধারার সাথে ক্রমেই একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও অজিত দত্ত বর্ষাবিদায়ী বেদনারম্য শরতের মধ্যে খুঁজেন বৃষ্টির শৃষ্টিশীল উৎপাদনমুখিতা। সুধীন প্রাণের উৎসে বৃষ্টির যে সার্বভৌম প্রেরণা, তা তিনি তার 'শাশ্বতী' কবিতায় কল্পনার যে পরিপাটীত্ব দেখান, রন্ধ্রে রন্ধ্রে এতো নিবিড় গহীন গভীরতাসঞ্চারী যে, তাতে করে এই শৈলী বাংলা কবিতায় চিরায়তের মর্যাদা বহন করে যাবে। স্মৃতি পিপীলিকা তাই পুঞ্জিত করে আমার রন্ধ্রে মৃত মাধুরীর কণা; সে ভুলে ভুলক, কোটি মন্বন্তরে আমি ভুলিব না, আমি কভু ভুলিব না। শাশ্বতী, অর্কেস্ট্রা অজিত দত্ত বর্ষাশেষে শরতের মধ্যে মৃতের যে পুনঃপ্রাণের আকাঙ্ক্ষা উড্ডীন মেঘের ছায়ায় শীতল হতে চায়, পুনশ্চ পরিক্রমায় ফিরে আসার প্রত্যাশায় তারই এক নিবিড় উদ্ঘাটনা 'মেঘচ্ছায়া' কবিতায় রেখে যায়। শরৎ মেঘের সি্নগ্ধ ছায়াগুলি চলে যায় উড়ে আমার বিশ্রাম হতে, আমার পৃথিবী থেকে দূরে। ...................................................... সেই মৃত্যু কাছে আসে মেঘগুলি যতদূর চলে আমারে বঞ্চিত ক'রে শীতল চঞ্চল ছায়াতলে। মেঘচ্ছায়া, জানালা আল মাহমুদের কবিতায় বর্ষা ও তার পরিপ্রেক্ষিতে যে লোকজীবন, লোকজীবনের সাথে যে নগরজীবনের মিশেল তাও বেশ সহজাত হয়ে দেখা দেয়। কবিতায় তিরিশোত্তর, চলি্লশোত্তর কবিদের পর যাঁরা আন্তরিক তিনি থাকবেন তাঁদের শিরোভাগে। কবিতার যে ভাষিক প্রগাঢ় নিবিড়িত্ব, তাঁর কবিতায় সেটা লক্ষ করলেই সে আন্দাজ হতে পারে। কবিতার মেজাজ ও রুচি এখন দ্রুত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীল ঠিক নয়, আরোপিত পরিবর্তনশীল। কিন্তু বর্ষা তো আর আরোপিত হতে পারে না। ফলে চাইলেও যেন কবিতা থেকে বর্ষা সরানো যাচ্ছে না। ঘুরে ফিরে যেভাবেই হোক কবিতায় বর্ষা আসছেই। বর্ষার ওপর সাবলীল কবিতা লেখার ক্ষেত্রে প্রকৃতপ্রস্তাবে বিষয় বা চিত্রকল্পের ওপর কবির আন্তরিকতাই মুখ্য শর্ত। সেই সঙ্গে কবির জীবনযাপনের ধরনটির প্রতিফলন তো থাকবেই। এই আন্তরিকতার বিষয়টি জসিমউদদীনের কবিতায় সহজ প্রাপণীয়। চলমান সময়ের ওপর দিয়ে যাওয়া কবির জীবনধারা বদলালেও বর্ষা বা প্রকৃতির প্রকাশ কিন্তু সেই আগের মতোই আছে। ফলে এই কবিতায় এই দুয়ের সাম্য বজায় রাখা মোটেও সহজসাধ্য নয়। কাঁচের ভিতর থেকে, বা চশমার ভিতর থেকে বর্ষা দেখার প্রকৃতি যে রকম রোমান্টিক হবে, কাঁচের বাইরে সে কখনওই হওয়ার নয়। কবিতায় জীবনধারার বাহ্যপ্রভাব ও আন্তঃপ্রভাবের একটা সম্মিলন তো ঘটাতে হবেই। তা-ই যদি না ঘটলো, সেতো আর কবির আন্তরিকতায় বিশ্বস্ততার সাথে উত্তীর্ণ হলো না। ফরহাদ মজহারের ' মেঘ মেশিনের সঙ্গীত' কবিতায় সে আকাঙ্ক্ষারই আকুতি উঠে আসতে দেখা যায়। মেঘ তুমি বালকের ভাষা আদিম উদ্দীপনা মেঘ তুমি আদি স্মৃতি যখন এখানে উৎসাহ ছিল, ছিল পরিকল্পনা ছিল নির্মাণরীতি .................................................. তবে কথা বলো মেঘ, কথা বলো বৃষ্টির অক্ষরে কথা বলো উচ্চাসা মেঘ মেশিনের সঙ্গীত আজকালকার প্রতিনিধিত্বশীল কবিদের অধিকাংশই তো নাগরিক জীবনধারার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ফলে তার কবিতায় সে যাপনধারার বিশ্বস্ততা না থাকে কি করে। বিরেন চট্টোপাধ্যায়ের 'বর্ষা' কবিতায় সে চিত্রটি খুবই সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিশ্বস্ত থাকতে দেখা যায়। আষাঢ় এসে ভীষণ জোরে দুয়ারে দিল নাড়া- শীর্ণ হাতে শিশুরা খোলে খিল বৃষ্টি, লখিন্দর সমকালীন অভিজ্ঞতায় বর্ষার ওপর যেসব বাংলা কবিতা লেখা হচ্ছে, সেখানে কবির সেরকম বিশ্বস্ততা খুব কমই উপস্থিত। স্মরণযোগ্য তো নয়ই, খুব কম লেখাই আছে যেগুলো চকিত আবেদনময় হয়ে উঠতে পারে। কবিতায় কবির আন্তরিকতার সুরটি না থাকাতেই কেমন যেন বেসুরো লাগে। বলতে কি, ষাট উত্তরকালে বাংলা কবিতায় এই আন্তরিকতার সুরটি উঠেই গেছে বলতে হয়। এর প্রভাবটি বর্ষা কেন্দ্রিক কবিতায়ও এসে পড়েছে। তবুও এর মধ্যদিয়েই কিছু কবিতা আছে, যাতে বর্ষার ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। আবিদ আজাদের কবিতা, 'বৃষ্টি'। 'টাপুরটুপুর টাইপরাইটারের শব্দে বৃষ্টি নামলো সারা মতিঝিলে বৃষ্টি নামলো রিমঝিম রিমঝিম কমার্স বিল্ডিংয়ের ছাদে বৃষ্টি নামলো দোতলার তেতলার সারি সারি জানালার শার্সিজুড়ে-' বনতরুদের মর্ম শহুরে জীবনাধায় যেভাবে বৃষ্টি দেখা দেয় তারই চিত্রাবলি আবিদের ওই কবিতাটি। পিচঢালা পথে বৃষ্টিপতনের সাথে কেরানিজীবনের টাইপটারের শব্দের সাথে এই যে সম্প্রীতি, তা এক কথায় অভাবিত। কেরানিজীবনের যেমন কোনো সৃষ্টিশীল উত্থান নেই, তেমনি শহরের পিচঢালা পথে, উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদে বৃষ্টি পতনের সাথেও কোনো সৃষ্টিশীলতার সম্পর্ক নেই। শহরের এই বৃষ্টি স্রেফ গ্রীষ্মের দাবদাহে আইঢাই প্রাণে একটু শীতল পরশ ছুঁয়ে যায় মাত্র। কিছু ক্ষেত্রে অতিরেক দুষ্টতা মেনেও কবিতাটি বৃষ্টিবান্ধব গ্রামীণ কর্মব্যস্ততা, জীবনধারা থেকে বিচ্ছিন্ন এক শহুরে জীবনধারার চিত্রকল্প তুলে আনার মধ্যে কবি যে ভিন্ন মাত্রা সংযোজন করলেন বাংলা কবিতায় তা প্রশংসনীয় হয়ে থাকবে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লিখেছেন, 'বৃষ্টি এবং সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা'। তাঁর কবিতাও আধা গ্রামীণ আবহম-িত বর্ষাজলদ সি্নগ্ধভাষে পূর্ণ। অতি শিক্ষিত নাগরিক চোখে দেখা বর্ষার প্রকৃতি শামসুর রাহমানে যেরকম পরিপাটী হয়ে আসে বর্ষাও নিশ্চয় ততো স্তরে স্তরে পরিপাটীরূপ ফলে না। শহরের জীবনধারার সাথে বৃষ্টি কিভাবে আসতে পারে, তা সৈয়দ শামসুল হকের 'বৈশাখে রচিত পঙ্ক্তিমালা'তেও উঠে আসতে দেখা গেছে। উত্তরকালে এসে বাঙ্গালা কবিদের জীবনধারা হয়ে পড়ে দ্বিধান্বিত। ফেলে আসা গ্রাম তার কাছে আত্মপরিচয়ের সঙ্কট হয়ে উঠছে। সে স্মৃতিও মোটরকারের ওপর বা জানালার শার্সির ওপর পতিত বৃষ্টিদৃশ্যের মতো ঝাপসা। নিকট থেকেই কিছু দেখা যাচ্ছে না বলে দূর থেকে কি আর দেখা যাবে। এভাবে কবিতায় বর্ষার সহজ প্রকাশ হয়ে পড়ে নিরতিশয় খ-িত। 'বর্ষামন' বলে যে গূঢ়ৈষা থাকবে কবিতার কানায় কানায়, তা অনুপস্থিত। নিরেট বায়বীয় মনস্ক এসব কবিতায় রাধা'র অগণন নয়া উপস্থিতি আছে বটে, এবং তা যতোটা প্রকট, ততোটা সহজ কিন্তু 'কাহ্নু' নেই। এই বায়বীয় মনস্ক 'কাহ্নু' কবি নিজেই। এক ধরনের টেকনোপোয়েট্রি বিন্যাসের মধ্যদিয়ে যেখানে 'কবিপুরুষ' নিজেই নিজের 'প্যারোডি' হয়ে আসছেন বারবার। এই পীড়ন কতো আর সহ্য করা যায়। কবিতায় কবির কোনো দ্বিতীয়, তৃতীয় 'পুরুষ' নেই। 'ব্যক্তি'র ভিতরে অবজেক্টিভিটি বা 'সমগ্রতা' দেখতে চাওয়ায় এক রকম মাত্রা আর 'সমগ্রতা'র মধ্যে 'ব্যক্তি'কে সন্ধান করার ভিতরে যে আরেক রকম মাত্রা উঠে আসবে সেটাই তো মূলক। উৎকট ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পীড়নে কবিতায় এ দু'টোর মেলবন্ধনই যদি অনুপস্থিত থাকে, তো সে কাব্যভাষ খ-িত না হয়ে উপায় আছে? কি করে সে কবিতা প্রকৃতই বর্ষাবান্ধব হয়ে উঠবে? ফলে বলতে হচ্ছে এ বয়ানই বাড়তি, যে এধরনের কবিতায় নতুন কোনো মাত্রা বয়ে আনতে পারেনি।ুদ

যাচ্ছে উড়ে কবির খাতা

আল মাহমুদের কবিতা যাচ্ছে উড়ে কবির খাতা | তারিখ: ১৩-০৭-২০১২ কোথায় যেন যাচ্ছি একা—কোন দিগন্তে ফিরে তাকাই পেছনে নাই অন্য কেহ হাওয়ায় দুলছি—হাওয়ায় ফুলছি, তোমার স্নেহ যেন আমায় জড়িয়ে আছে। পা দু’খানি কাঁপছে ভীষণ থরথরিয়ে ঝরঝরিয়ে ঝরছে পাতা, চোখের সামনে যাচ্ছে উড়ে আমার খাতা। কাব্য লেখায় নাব্য আমি আর কিছুকাল আমার গেল ছেলেখেলায় সন্ধ্যা-সকাল এখন হাতের মুঠো খুলে দেখছি রে ভাই কেবল আছে আয়ুরেখা আর কিছু নাই। সোনার টাকার গন্ধ তো নাই, ছন্দে জাগা— হাওয়ার কাছে যেন হাওয়ায় ভিক্ষা মাগা। টাকা তো নয় হাতের তালু—গাছের পাতা, ঝরঝরিয়ে থরথরিয়ে কবির খাতা। কাঁপছে এমন অসম্ভবের সামনে যেমন দাঁড়ায় কবি দাঁড়ায় ছবি হাওয়ার ভেতর, আমিই দেখি; দৃশ্যটা হোক শিক্ষা আমার। সামনে আমার নৌকাখানি ভাসছে জলে আমি যাব বহুদূরের চরাঞ্চলে। সেখানে কি আমার তবে শেষ ঠিকানা? হয়তো আছে আমার গৃহ আর বিছানা।

আত্মজীবনী লেখার সাহস হয় না

সা ক্ষা ৎ কা র আত্মজীবনী লেখার সাহস হয় না | তারিখ: ১৩-০৭-২০১২ আল মাহমুদ বাংলা ভাষার সেরা কবিদের একজন। ১১ জুলাই ছিল তাঁর ৭৭তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে কবির মুখোমুখি হয়েছিলেন মাসউদ আহমাদ ও আবিদ আজম প্রশ্ন: মানুষ তো অসম্ভব স্মৃতিধর। ৯০ বছর বয়সের মানুষও তাঁর প্রথম জীবনের কথা হুবহু মনে করতে পারেন। ১১ জুলাই আপনার জন্মদিন। জীবনের এই গোধূলি সন্ধ্যায় এসে আপনার অনুভূতি কেমন? আল মাহমুদ: এখন তো আবেগ তেমন নেই। অতীত স্মৃতি-বিস্মৃতি—এসব আছে। অনেক পরিচিত মানুষের মুখ মনে পড়ে। জন্মদিনে মানুষ আসে, শুভেচ্ছা জানায়। আমার ভালোই লাগে। একটা ব্যাপার মনে হয়, আমি যে সাহিত্যের চর্চা করেছি, এত দূর এসেছি, আল্লাহর অশেষ করুণা। মানুষ আমাকে ভালোবাসে। ভালো লাগে। অনেকে এই ভেবে বিস্মিত যে আমি এখনো বেঁচে আছি। প্রশ্ন: গোটা জীবন তো আপনি কবিতা নিয়েই কাটিয়ে দিলেন, এটা কীভাবে সম্ভব হলো? আল মাহমুদ: এটা খুব স্বাভাবিক কারণেই হয়েছে। কারণ, আমি তো কবিতাই লিখি। কবিতা নিয়ে চিন্তা করতাম, কবিতা ভাবতাম। আমার সমস্ত অনুরাগ জড়িয়েছিল কবিতার পেছনে। কবিতা আমাকে খ্যাতি দিয়েছে। সম্মান দিয়েছে। আর কী দেবে? কবিতা অর্থবিত্ত সেভাবে দেয় না হয়তো, কিন্তু আমি যা পেয়েছি, তা অনেক বেশি পেয়েছি। প্রশ্ন: আপনি একসময় বলেছিলেন কবিরা পরাজিত হয় না। আল মাহমুদ: হ্যাঁ, এটার ব্যাখ্যা করতে গেলে অনেক কথা বলতে হবে। কবিরা তো প্রকৃতপক্ষে কখনো হার মানে না। যত দিন সে বেঁচে থাকে, তত দিন সে লিখতে চায়। লেখেও। তার সঙ্গী-সাথিরা হয়তো ঝরে যায়। মরে যায়। এই পরাজিত না হওয়াটা কেবল জীবনের কাছেই নয়, সব ব্যাপারেই। প্রশ্ন: আপনি গ্রামের ছেলে, মোড়াইল নামের এক অখ্যাত গ্রাম থেকে কবি হতে ঢাকায় পালিয়ে এসেছিলেন; তারপর আপনার খ্যাতি, সুনাম ও সৃজনশীল প্রজ্ঞার অলৌকিক ঐশ্বর্য বিশ্বময় ছড়িয়ে গেল। এই মাধুরী-সৌভাগ্যকে কীভাবে দেখেন? আল মাহমুদ: মোড়াইলটা একেবারে গাঁ নয়, আধা গ্রাম, আধা শহর বলতে পারো। আমি কবি হওয়ার জন্য সাধনা করেছিলাম। এক হিসেবে বলা যায়, আমি জেনেশুনেই এই জগতে এসেছিলাম। এটা এ কারণে যে আমি কী করতে পারব আর কী পারব না, সেসব আমার জানা হয়ে গিয়েছিল। এবং আমি যা করতে পারব না ভেবেছিলাম, সেটাও আমি করে ফেলেছি। আর সেটা হচ্ছে সাহিত্য—সাহিত্যের জন্য খ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠা লাভ। একটা পরিচিতি বলতে যা বোঝায়, সেটা বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে হয়েছে আমার। এটাকে আমার খুব বড় পাওয়া মনে হয়। মানুষের ভালোবাসার চেয়ে বড় পাওয়া আর কী আছে? প্রশ্ন: কবি না হলে অন্য কী হতেন? আল মাহমুদ: কবি না হলে আমি হয়তো কিছুই হতাম না। কবি হওয়ার কারণে একবার আমার বিয়ে ভেঙে গিয়েছিল। ওই ঘটনা আমার এখনো মনে পড়ে। ভাবি ওই ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাও নিশ্চয়ই এখনো বেঁচেবর্তে আছে এই সংসারে। প্রশ্ন: পরে স্ত্রী হিসেবে যাঁকে পেলেন, দীর্ঘ একটা জীবন কেটেছে তাঁর সঙ্গে...। আল মাহমুদ: আমার স্ত্রীর কথা আমার মনে পড়ে। খুব মনে পড়ে। আমার জীবনে, আমার অগোছালো কবিজীবনকে দারুণভাবে বেঁধে রেখেছিলেন তিনি। একধরনের পরিতৃপ্ত জীবন পেয়েছিলাম। আমার তেমন কোনো অতৃপ্তি ছিল না। প্রশ্ন: এখন আপনি একধরনের নিঃসঙ্গই...কোনো অতৃপ্তি বা বেদনা কাজ করে? আল মাহমুদ: আমি হয়তো মনের দিক থেকে একা। সারা দিন আমার কাছে নানাজন ছুটে আসে। শরীর ভালো থাকলে একটা-দুটো অনুষ্ঠানে যাই। তবে এখন আমার জীবনে তেমন কোনো বৈচিত্র্য নেই। আর অতৃপ্তি কিছু তো আছেই। মানুষের অনেক কিছু চাওয়ার থাকে, মানুষ প্রতিনিয়তই চায়; মনে মনে চায়। না পেলে চুপ করে থাকে। আমিও সেই—যাকে বলে না-পাওয়ার বেদনাটা চুপ করে কাটিয়ে দিয়েছি। এখন আর এসব নিয়ে তেমন ভাবি না। প্রশ্ন: কবি পরিচয়কে সামনে রেখেও গল্প-উপন্যাস এবং অন্যান্য রচনায়ও আপনি বিপুল শক্তিমান। জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসে আত্মজীবনী লেখার কথা মনে হয়নি, কবি হিসেবে আপনার জীবন তো কম বর্ণাঢ্য নয়? আল মাহমুদ: সাহিত্যের সব শাখাতেই লিখতে চেষ্টা করেছি, লিখেছি। আত্মজীবনী লেখার কথা মনে আসে, কিন্তু সাহস হয় না। এত খুঁটিনাটি লিখতে হবে, লিখেও হয়তো শেষ করতে পারব না। এমন একটা ভয়ও আছে। আমি তো গদ্য-পদ্য পাশাপাশি লিখে গেছি। সবাই বলত, আমার গদ্যও ভালো। আমার একটা গল্পের বই আছে—পানকৌড়ির রক্ত; এটা লিখতে আমার খুবই ভালো লেগেছিল। এবং গদ্যটা বেশ ভালোই লিখেছিলাম। আমার অন্যান্য গদ্যের তুলনায় আমি মনে করি সেটি অতুলনীয় ছিল। প্রশ্ন: আপনার গল্প নিয়ে কলকাতা থেকে সিনেমা এবং নাটক হচ্ছে, জানেন? আল মাহমুদ: কলকাতা থেকে আমার ‘জলবেশ্যা’ গল্প নিয়ে সিনেমা হচ্ছে। সম্ভবত এতদিনে শেষও হয়ে গেছে। একটা ফুললেন্থ সিনেমা। হ্যাঁ, আমার গল্প নিয়ে অনেকগুলো নাটকও হয়েছে। ওই আর কি। নতুন কিছু হলে ভালো লাগে। প্রশ্ন: আপনি তো এখন ডিকটেশন দিয়ে লেখান। কাজেই এমন কি হয় না যে আপনার লেখার খুব ইচ্ছে করছে, কিন্তু কাউকে দিয়ে যে লেখাবেন সেরকম কেউ নেই কাছে? আল মাহমুদ: সাধারণত এমন হয় না। আমি যখন লিখতে চাই, লেখার মানুষও পেয়ে যাই। তবে কোনো কোনো সময় যায় ঘুম আর জাগরণের মধ্যে, তখন কিছু মাথায় এলেও তা আর লেখা সম্ভব হয় না। জেগে ওঠে মনে করতে পারি না। প্রশ্ন: আপনি বলেন—কবি হতে গেলে গোটা জীবনটাই উৎসর্গ করতে হয়, আপনি নিজে তা করেছেনও; কিন্তু শুধু কবিতা নিয়েও থাকেন নি গল্প বা উপন্যাস লিখেছেন? আল মাহমুদ: গদ্য লেখাতেও যেহেতু আমার উৎসাহ ছিল, হাতও ছিল ভালো, তাই লিখে গেছি আর কি। আমার মনে হয় খুব খারাপ লিখিনি। কবিরা ভালো গদ্য লিখতে পারে, আমি বোধ হয় তার প্রমাণ কিছুটা দিতে পেরেছি। তবে এই পেরে ওঠাটা একটা বড় ব্যাপার। আমার উপমহাদেশ বা কাবিলের বোন—এসব আমার একধরনের সার্থক রচনা আমি মনে করি। উপমহাদেশ লেখা হয়েছে আমার মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি আলাদা বই লেখার ইচ্ছা ছিল, এখনও আছে, জানি না কতটুকু পারব। প্রশ্ন: কবিতার সঙ্গে সারা জীবন বসত করে গেছেন, আপনার নিজের বিবেচনায় কবিতা আসলে কী? আল মাহমুদ: কবিতা হচ্ছে মানুষের স্বপ্ন। স্বপ্নের ভেতরে কিছুটা পরিভ্রমণ। বাস্তবতার সঙ্গে এই স্বপ্নের সম্পর্কটা হতে পারে—বাস্তবতায় পা রেখে স্বপ্নের ভেতর উড়াল দেওয়ার মতো। কবির প্রকৃত কাজ হলো মানুষকে, তাঁর জাতিকে স্বপ্ন দেখানো। এটা আমি সব সময় বলেও এসেছি। আমি এই স্বপ্নটা দেখাতে চেষ্টা করেছি। এখনকার কবিরা এ কাজটি করতে পারছে কি না, নিশ্চিত করে বলতে পারব না।

আত্মজীবনী লেখার সাহস হয় না

প্রশ্ন: একদিন কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, এখনকার কবিরা কোথায়? এই অভিব্যক্তির তাৎপর্যটা একটু খুলে বলবেন? আল মাহমুদ: কথাটা বলেছি—কারণ কবিদের কোলাহল তো শুনি না। নিশ্চয়ই তাঁরা আছেন। কিন্তু আগে যেমন আমি আজিজ মার্কেটে ঘুরে কিংবা নানা জায়গা থেকে কবিতার বই সংগ্রহ করে নিয়ে আসতাম, লিটল ম্যাগাজিন পড়তাম, এখন তো সেসব পারি না। আমার বয়স হয়েছে। বৃদ্ধ মানুষ। আমি চোখেও দেখি না। যাইও না কোথাও। একসময় আমরা বন্ধুরা, যেমন—শহীদ কাদরী, শামসুর রাহমান ও ফজল শাহাবুদ্দীন বিউটি বোর্ডিংয়ে আড্ডা দিয়েছি, দাপিয়ে বেড়িয়েছি গোটা শহরটায়। তখন আমাদের শোরগোলটা কিন্তু ছিল চারদিকে। এখন কি কবিদের সেরকম সদর্প পদচারণা আছে! বুঝতে পারি না। প্রশ্ন: বাংলা ছোটগল্প অনেক দূর এগিয়েছে। তবু এখনো, রবীন্দ্রনাথের ছোটপ্রাণ ছোট ব্যথাকে গল্পের পরিচয় নির্ণয়ে সামনে আনা হয়। আপনি, কবি আবার গল্পকার আল মাহমুদও কম শক্তিশালী নয়; ওই সংজ্ঞা আজও কতটুকু প্রাসঙ্গিক মনে করেন? আল মাহমুদ: (মৃদু হেসে) না, আমি কবি হিসেবেই কাজ করেছি। গল্পকার হিসেবে যারা বড় করে দেখে আমাকে, তারা ভালোবেসে বলে। তবে রবীন্দ্রনাথের সেই কথাকে এখন আর আমি মানি না। তিনি ছোটগল্পের যে ফর্মের কথা বলেছেন, এটা তো মানা যায় না। এটা এখন আমাদের ওপর চাপানো উচিত না। উনি আমার প্রিয় লেখক, তাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রাচুর্য আছে। নজরুলও আমার প্রিয়। বাংলা ভাষার জন্য অত্যন্ত দরকারি ছিল কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব। এটা আমি অনুভব করি। তাঁর একটা কবিতা আছে—‘বল বীর, বল উন্নত মম শির...’; কবিতাটির সমতুল্য কবিতা ওই সময়ে বা পরেও দেখা যায় না। এসব একবারই হয়। বাংলা সাহিত্যে এটা অসাধারণ সৃষ্টি। প্রশ্ন: কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা কতখানি? আল মাহমুদ: আরে, ছন্দ ছাড়া কি কবিতা হয়? আমি তো লিরিকের মানুষ। গীতিপ্রবণতা আমার স্বভাবগত। আমি আসলে ছন্দে আছি, গন্ধেও আছি। প্রশ্ন: কবির জীবন কি হবে শুধু উদাসীন, ছন্নছাড়া আর পাগলটে? আল মাহমুদ: কবিদের জীবনযাপন পাগলের মতো কেন হবে? তারা তো পাগল না। হ্যাঁ, বড়জোর বলতে পারো—উদাসীন। উদাসীনতা কবিদের স্বভাবের মধ্যেই পড়ে। এটাকে আমি ইতিবাচকভাবেই দেখি। কবিতার কারণে জীবন সফল হয় না, তা নয়। আমি একবার বলেছিলাম, যারা সাহিত্যচর্চা করে, আমি তো দেখি না কেউ খালি হাতে ফিরেছে। একটা প্রাপ্তি নিশ্চয়ই আছে। প্রশ্ন: সোনালি কাবিনে আপনি বলেছেন—পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয় না কবিরা। আবার আপনার একটা বইয়ের নাম—সৌরভের কাছে পরাজিত! আল মাহমুদ: সৌরভের কাছে পরাজিত বইটি ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে। না হলে তো গোলমাল হয়ে যায়। আগেই বলেছি, পরাজিত হয় না কবিরা। আমার সব সময় তা-ই মনে হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, আমি পরাজিত নই। আই অ্যাম নট ডিফিটেড। সত্য-সুন্দর ও কল্যাণের পথেই তো কবিরা হাঁটেন। প্রশ্ন: কবিতায় গল্প-উপন্যাসে আপনি প্রেমের নানা রকম চিত্রায়ণ করেছেন। প্রেম বা ভালোবাসাটা কী ব্যাখা করতে পারেন? আল মাহমুদ: ভালোবাসা কী—এটা তো আমি ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারব না। এটুকু বুঝি ভালোবাসা একটা অবস্থা। যখন মানুষ কাউকে ভালোবাসে, তখন সেই ভালোবাসার মধ্যেই জিনিসটা উপলব্ধি করা যায়। প্রশ্ন: কবিরা তো ভালোবাসা ভাঙিয়েই খান, এটাই তাঁদের মূল শক্তি। এটা কতখানি সত্য? আল মাহমুদ: একটা কবিতা আছে—‘গাছ তোলে বুক ফুল তোলে বুক, সন্ধ্যা ভোরের আলোর বীণায়; সবাই মিলে গান ধরেছে, প্রেমের মতো আর কিছু নয়।’ এটা আমার মনে হয়। ভালোবাসার অপর নাম। জীবনে, এখন কবিতাই আমার একমাত্র ভালোবাসা। প্রশ্ন: আপনি এখনো তো প্রেমের কবিতা লিখছেন। এই বয়সে আপনার কি প্রেমে পড়তে বা ভালোবাসতে ইচ্ছে করে? আল মাহমুদ: এটা তো ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে না, অবস্থার ওপর হয়ে থাকে (স্বতঃস্ফূর্ত দীর্ঘ হাসি)...। এটা আসলে অনুভবের বিষয়। কেউ কেউ এখনো এসে বলে, ‘আপনাকে ভালোবাসি।’ কী আশ্চর্যের বিষয়! প্রশ্ন: সাহিত্যে—কবিতা বা গল্পে নিরীক্ষার যে প্রয়াস, এটাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? আল মাহমুদ: নিরীক্ষা-ফিরিক্ষা কী আবার? নিরীক্ষার ধার ধারি না আমি। সাহিত্য হচ্ছে চর্চার বিষয়। চর্চা করে যারা, তারা এর স্বাদ গ্রহণ করে। ভেতরে কী আছে, সেটা তারা উপলব্ধি করে। আর কবিতার জন্য পুরো জীবন কাজ করে যেতে হয়। আমি মনে করি সাহিত্য হচ্ছে মানুষের জন্য। সাহিত্য ব্যক্তিজীবনের জন্য স্বপ্ন। আমি সব সময় জীবন, মানুষ ও স্বদেশকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছি। আমি কল্যাণ চাই। চাই সুন্দর-স্বপ্নময় স্বদেশ। আমার লেখা পড়লেও সেটাই বোঝা যাবে। প্রশ্ন: আপনার অনেকগুলো কবিতার বই বেরিয়েছে। কিন্তু মানুষ কেবল সোনালি কাবিন-এর কথাই বলে। এটাকে আপনি কীভাবে বিবেচনা করেন? আল মাহমুদ: এটা তো হতেই পারে। এটার সঠিক ব্যাখ্যা দেওয়া মুশকিল। প্রশ্ন: কিছু লিখছেন? সময় কাটে কীভাবে? আল মাহমুদ: এই তো, ঘরে বসে থাকি। বাইরে তেমন যাই না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকি। শুয়ে থাকি। এই তো।

আমার আব্বা ড. শহীদুল্লাহ্র শেষ দিনগুলি

মা হ্ যূ যা হ ক ১৯৬৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর পবিত্র রমজান মাসের শেষ সপ্তাহে আব্বার ইতেকাফে যাওয়ার দিন। তাই আব্বা ব্যস্ততার সঙ্গে সিএসপি পরীক্ষার খাতা দেখা শেষ করে নম্বর উঠিয়ে খামে ভরে সিল দিয়ে সফীকে বুঝিয়ে দিলেন যথাস্থানে পৌঁছানোর জন্য। আল্লাহর মর্জি, তিনি অসুস্থ হওয়ার আগেই এ কাজটি সমাধান করতে পেরেছিলেন। আমার মামাতো ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে। মেয়ের চাচাতো ভাই এসে তাকে জানালো, ‘দাদা আপনি বিয়ের উকিল হবেন।’ ছেলের তরফের লোক জানালো, ‘নানা আপনি বয়রাত যাবেন ছেলের সঙ্গে, যেহেতু আপনি ছেলের নানা।’ তিনি খুব খুশি হলেন। এর মধ্যে তাদের উপদেশ দিলেন, ‘তোমরা মোহাজের মানুষ, বিয়েতে কার্ড ছাপিয়ে টাকা নষ্ট করেছো কেন? লাল কালি দিয়ে হাতে লিখলেই তো পারতে!’ ওরা বললো, ‘আজকাল কেউ লাল কালি দিয়ে বিয়ের চিঠি লেখে না। বিয়েতে তো খরচ হবেই। তাতে আর কটা টাকা না হয় বেশি খরচ হবে।’ তিনি শুনে আর কিছু বললেন না। আছরের সময় হলে তিনি মাকে বললেন, ‘আমার বেডিংঝাঁপি গুছিয়ে রাখ। বাইরের পায়খানা ঘর পরিষ্কার করতে বলবে।’ তিনি এসব বলে বেগমবাজার মসজিদে চলে গেলেন। কতক্ষণ পর একজন মুসল্লি দৌড়ে এসে খবর দিল, ‘ডক্টর সাহেব নামাজের মধ্যে পড়ে গেছেন, আপনারা শিগগির আসুন।’ ভাইরা দৌড়ে গিয়ে ওঠানোর সময় তিনি বেআবরুর ভয়ে সামনের কাপড় চেপে রাখলেন। ভাইরা তাকে ঘরে আনলে তাকে চেয়ারে বসিয়ে তার মুখে পানি দেয়ার সময় ইশারায় দেখালেন তিনি রোজা আছেন। কথা বলতে পারলেন না। খবর পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার নূরুল ইসলাম সাহেব এলেন। তিনি তাকে হাসপাতালে নেয়ার কথা বললেন। প্রথমে তিনি যেতে চাচ্ছিলেন না। তার মুখ দেখে বোঝা গেল। পরে মায়ের অনুরোধে রাজি হলেন। অসুস্থ হয়ে তিনি নীরবে মেনে নিলেন তার অসুস্থতাকে। চোখের পানি ফেললেন না বা বেশি অসহায় বোধ করলেন না। ওইদিন রাতের বেলায় দেখলেন তাঁর সেবকরা নিচে শুয়ে আছে আর তিনি পালংয়ে। তিনি জিদ ধরলেন—জড়িয়ে জড়িয়ে বললেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে শোব, ওপরে শোব না। তোমরা নিচে শুয়ে আছো, আর আমি ওপরে শোব? তা হতে পারে না। এটা অন্যায়।’ তিনি দু’রাত নিচে শুলেন। সফী এটা দেখে বুদ্ধি বের করলো, ‘বাবু এখানে অনেক ইঁদুর। আপনাকে তো কামড়ে দিতে পারে। আপনি অসুস্থ, আপনি ওপরে শোন। ইঁদুর কামড়াতে পারবে না।’ আব্বা বললেন, ‘আচ্ছা।’ জানুয়ারি মাসে রেজিস্ট্রার সাহেব এলেন তার পে বিল নিয়ে। তার পে বিলে দস্তখত নিতে। তিনি পে বিলে দস্তখত করতে পারলেন না। রেজিস্ট্রার সাহেব বললেন, ‘ঠিক আছে। আপনি টিপ দিলেই হবে।’ তিনি রাগত স্বরে বললেন, ‘টিপ দিয়ে আমি টাকা নেব না। আমার টাকার দরকার নেই। আমাকে সরকার খাওয়াচ্ছেন। হাসপাতালে আছি, আমার টাকার কিসের দরকার?’ তিনি টিপ দিলেন না। আস্তে-ধীরে বললেন, ‘ভালো হয়ে নিই। বাম হাতে লেখার অভ্যাস করব।’ তিনি হাসপাতালে একাধারে আট মাস থাকাকালীন আমার মা হঠাত্ হার্টফেল করলেন। ডাক্তার নূরুল ইসলাম সাহেবকে জানানো হলে তিনি বললেন, ‘অবশ্যই তাকে এ খবর জানাতে হবে, তবে আস্তে আস্তে। তাকে ওষুধ খাওয়াতে হবে, ইনজেকশন দিতে হবে, তার পরে।’ আমার ভাই সফী হাসপাতালে গেল। অসময়ে সফীকে হাসপাতালে দেখে তিনি ঘড়ি দেখে বললেন, ‘তুমি অসময়ে হাসপাতালে কেন?’ সফী বলল, ‘মায়ের শরীর খারাপ। সেজন্য ডাক্তারের কাছে এসেছি।’ সফীকে অনেকক্ষণ হাসপাতালে দেখে তিনি রাগ করে বললেন, ‘তোমার মায়ের অসুখ, তুমি হাসপাতালে ঘোরাফেরা করছো? যাও তাড়াতাড়ি তোমার মাকে দেখ গিয়ে।’ আস্তে আস্তে তার মৃত্যুর খবর তাকে জানানো হলে তার চোখ পানিতে ভরে গেল। বললেন, ‘ও! শি ওয়াজ এ পায়াস লেডি। ডাক্তার যদি যেতে দেন, তবে আমি তার জানাজায় শরিক হবো। এটা আমার কর্তব্য।’ ডাক্তার তাকে অনুমতি দিলেন, তিনি মায়ের জানাজায় শরিক হলেন এবং দাফনেও শরিক হয়েছিলেন। তার অসুস্থ অবস্থায় চোখের পানি দেখিনি। নীরবে মেনে নিয়েছিলেন। মাঝে মাঝে বলতেন, ‘বিশ্রাম নিইনি, তাই এমন হয়েছে।’ চেনা লোক দেখলে খুশি হয়ে তার হাত ধরে চুমো দিতেন। খুলনা থেকে তার আপন মামাতো বোন এলে তিনি তাকে ঠিকই চিনেছেন। তাকে বলেছেন, ‘তুমি আমার আপনজন, আমার বাড়িতে থাক, ওখানে খাওয়া-দাওয়া কর।’ তিনি হাসপাতালে থাকাকালে আমার ছোট মেয়ে ডলি লেবার ওয়ার্ডে ছিল। তাকে তিনি হুইল চেয়ারে করে দেখতে যেতেন। আমার পোতার পটকা ফুটে হাত জখম হয়ে হাসপাতালে ছিল। তিনি জানতে পেরে তাকেও হুইল চেয়ারে করে দেখতে গেছেন। আমি হাসপাতালে তাকে দেখতে যেতাম। ফেরার সময় তার কদমবুসি করতে গেলে আমি কেমনভাবে ফিরব, তা তিনি চিন্তা করতেন। বলতেন, ‘সফীকে ফোন কর, গাড়ি পাঠালে যেও।’ নামাজের সময় হলে অজু করে চেয়ারে বসে থাকতেন। তার মাথায় সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস হয়েছিল। তিনি সম্পূর্ণ জ্ঞান হারাননি। জ্ঞানের ঘাটতি হয়নি, তা তার কার্যকলাপে বোঝা যেত। তিনি নিজেই বুঝেছেন, তিনি কলেমা ভুলে গেছেন। তিনি আমার ভাইদের বলে দীনিয়াত আনিয়ে নিয়ে সবসময় দীনিয়াত হাতে করে পড়তেন। আমি গেলে আমার হাতে দীনিয়াতখানা দিয়ে বলতেন, ‘দেখো তো ভুল হয় কি-না।’ দেখে তিনি ঠিকই পড়তেন। না দেখে পড়তে পারতেন না। অবাক হয়ে বলতেন, ‘আগে তো এমন ছিল না!’ অনেক ছাত্রছাত্রী তাকে দেখতে গেলে তাদের নাস্তা দিতে বলতেন। মেয়েরা মাথায় কাপড় না দিয়ে গেলে মাথায় কাপড় দিতে বলতেন। আমার এক বান্ধবীর অপারেশনের সময় আব্বার কাছে দোয়া নিতে এলে তাকে তিনি দোয়া করে সান্ত্বনা দিয়েছেন। আমি তাকে দেখতে গেলে তিনি তার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, কেমন আছে জানতে চাইতেন। হাসপাতালে থাকতে যখন তিনি জানতে পারলেন মওলানা আকরম খাঁ সাহেব হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে ভর্তি হয়েছেন, তাকেও তিনি দেখতে গেছেন হুইল চেয়ারে বসে। আমি গেলে আমাকে বলেছেন, মওলানা সাহেব অসুস্থ, দেখে আস। তিনি ১৮ নং কেবিনে আছেন।’ তিনি কাগজ পড়ে জানতে পারলেন—তার বন্ধু সুশীল দে মারা গেছেন। আমি গেলে বললেন, ‘আমার বন্ধু সুশীল দে মারা গেছে।’ একবার কাগজে পড়লেন, বিড়াল ছোট বাচ্চাদের কামড়ে দিচ্ছে। তিনি আমাকে সাবধান করে বলেছেন, ‘জানালা বন্ধ রেখো। বিড়াল ছোট বাচ্চাদের কামড়িয়ে দিচ্ছে।’ তার মৃত্যুর এক মাস আগে বাংলা বিভাগের প্রফেসর মুহম্মদ আবদুল হাই সাহেব ট্রেনের নিচে পড়ে মারা গেছেন শুনে মর্মাহত হয়ে বলেছেন, ‘আবদুল হাই আমার ছাত্র ছিল। সে এমনভাবে মারা গেল কেন?’ তিনি অসুস্থ থেকেও সবার খোঁজ-খবর নিতেন এবং কর্তব্যবোধে সচেতন ছিলেন। সফীর মেয়ে চম্পার বিয়ে এবং আমার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে মিলুর বিয়েতে কী দেবেন, সফীর সঙ্গে তা নিয়ে তিনি পরামর্শ করেছেন। যদি বলতাম, ‘আপনি অসু্স্থ, আপনি অনুষ্ঠানে না গেলেও চলবে।’ তিনি বললেন, ‘না না, আমার ভাই নেই, তার পোতার বিয়েতে আমার যাওয়া কর্তব্য।’ চম্পার বিয়েতে তিনি উপস্থিত ছিলেন কর্তব্য মনে করে। ১৯৩৭ সালে আমার দাদি মারা গেলে নীলক্ষেতের মসজিদের পাশে জমি কিনে তাকে দাফন করা হয়। পরে আব্বা তার মায়ের কবরের পাশের জমি নিজের জন্য কিনে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি তার মায়ের কবর জিয়ারত করতে যেতেন এবং বলতেন, ‘আমি আমার জন্য মায়ের কবরের পাশে একখণ্ড জমি কিনে রেখেছি। আমার কবর মায়ের কবরের পাশেই হবে।’ কিন্তু তার কবর তার মায়ের কবরের পাশে হয়নি। দু’টি জিনিস মানুষকে তার দিকে জোরে টানে। একটা দানাপানি আরেকটা কবরের মাটি। আমার আব্বার ঢাকায় দানাপানি ছিল। তাই তিনি সুদূর ২৪ পরগণা থেকে ঢাকার দানাপানি খেলেন এবং ১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই সকাল সাড়ে নয়টায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। এখানে তার মাটি ছিল, তাই তার পারিবারিক গোরস্থান থাকতেও এবং নিজের কেনা জমিতেও তার কবর না হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্জন হলের প্রাঙ্গণে মুসা খাঁ মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হলো। তার দাফনের সঙ্গে একটা বিরাট জ্ঞানভাণ্ডারকেও দাফন করা হলো। তার স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ঢাকা হলের নাম শহীদুল্লাহ হল রাখা হয়েছে। তিনি দীর্ঘ ৪৮ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং নানা ধরনের পদ অলঙ্কৃত করেছেন। ঢাকা তাকে ঢেকে রাখলো চিরতরের জন্য। তার কর্মব্যস্ত জীবনে তিনি কখনও কারও আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেননি। কোনো অসুস্থ আত্মীয় কুটুম্ব তার সাহায্য ও সহানুভূতি থেকে বিমুখ হয়নি। তিনি কাউকে নিরাশ করতেন না। তিনি বলতেন, ‘দিও কিঞ্চিত, না করিও বঞ্চিত।’ তিনি কত দেশে গেছেন। কত লোকের সঙ্গে মিসেছেন। তার শেষজীবনে সাদাসিধে পোশাক ছিল। তাকে অনেকেই চিনতে পারত না। তার রীতিনীতিতে আজীবন ইসলামী ভাবধারা বিরাজমান ছিল। তিনি জাতীয় জীবনে একটি আদর্শের উত্স। ফুলের সৌরভ কুলের গৌরব থাকে না চিরদিন। হে জ্ঞান সাধক! তোমার স্মৃতি তোমার গৌরব, চিরদিন রবে অমলিন। আমীন, সুম্মা আমীন। হ লেখিকা কর্তৃক ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ : পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে গ্রন্থ থেকে

ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

ড. কা জী দী ন মু হ ম্ম দ ১ বিংশ শতাব্দী বাংলার মুসলমানের রেনেসাঁর যুগ। একালে যে সকল মনীষী মুসলিম জাগরণের জন্য নানাভাবে সাধনা করে গেছেন তাঁদের মধ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অন্যতম অগ্রগণ্য। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সে কালে মুসলিম রক্ষণশীল ও সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পড়তে গিয়ে তিনি অসুবিধায় পড়েন। সংস্কৃতের এমএ পাঠক্রমে বেদ-শাস্ত্রও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বেদ পড়াতেন বিখ্যাত বৈদিক পণ্ডিত সত্যব্রত শামশ্রমী। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান প্রাচীনপন্থী গোঁড়া পণ্ডিত ছিলেন। মুসলমান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ছাত্র হবেন এবং তিনি তাঁকে বেদ পড়াবেন—এ হয় না। এ সম্বন্ধে তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন যে, ‘বিধর্মী’কে তিনি বেদ পড়াবেন না। ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ অনুরোধেও তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না; বরং তিনি পদত্যাগের হুমকি দিলেন। এ ব্যাপারে সে সময় কলকাতায় বিশেষ আন্দোলন হয়। বিশেষ করে তখনকার দিনের বিখ্যাত মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলী, যিনি সে সময় উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য তাঁর সুপরিচিত ইংরেজি পত্রিকা কমরেড (ঈড়সত্ধফব) প্রকাশ করতেন, তিনি ঞযব ঝযধযরফঁষষধয অভভধরত্ শীর্ষক কতকগুলো জোরালো প্রবন্ধ লেখেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এভাবে লোকের চোখের সামনে এসে পড়েন। এ নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার, বিলেতে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা ইত্যাদি কারণে তরুণ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নাম বাংলার ঘরে ঘরে শিক্ষিত মহলে বহুল আলোচিত হওয়ার সুযোগ পায়। ভাইস চ্যান্সেলর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এ ব্যাপারে বিব্রতবোধ করেন এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁকে ঈড়সঢ়ধত্ধঃরাব চযরষড়ষড়মু বা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে এমএ পড়ার পরামর্শ দেন। তখন বিভাগটি সবেমাত্র খোলা হয়েছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার পরামর্শ মেনে নেন। তিনি ১৯১২ সালে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে যথারীতি এমএ পাস করেন। এ সঙ্গে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৪ সালে তিনি আইন পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। এরও প্রায় এক যুগ পরে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি ডি-লিট এবং ধ্বনি-বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ডিপ্লোফোন লাভ করেন। এরপর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাতক্ষীরায় ওকালতি আরম্ভ করেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল বিদ্যাচর্চার দিকে, পঠন-পাঠন ও গবেষণার দিকে। ওকালতিতে তিনি মন বসাতে পারেননি। স্যার আশুতোষ তাঁর গুণগ্রাহী ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে নিজের হিতৈষী গুরুর মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা ও মান্য করতেন। স্যার আশুতোষ তাঁকে আইন ব্যবসা ছেড়ে বিদ্যার সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে উপদেশ দেন। মূলত তাঁরই উত্সাহে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লক্ষ্মীর রত্নভাণ্ডার ত্যাগ করে সরস্বতীর পুষ্পোদ্যানে স্থান লাভ করেন এবং তাঁর কালে বাংলা তথা ভারতবাসী হিন্দু-মুসলমানের মানসিক উত্কর্ষের পক্ষে বিশেষ লাভ ও উপকার হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঐঁসধহরঃরবং বা ‘মানবিকী’ বিদ্যায়, অর্থাত্ ভাষা-সাহিত্য-ইতিহাস-সমাজনীতি-অর্থনীতি-রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন-আধ্যাত্মিকতার সাধন এবং রস অর্থাত্ শাশ্বত সত্তার মধ্যে নিহিত যে আনন্দের অনুভূতি—এসব বিষয়ে তিনি একজন ‘সর্বন্ধর’ আচার্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন।

ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

২ পণ্ডিতমহলে অনেকেই বলে থাকেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন গড়ারহম ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ—চলন্ত বিশ্বকোষ বা জীবন্ত অভিধান। অনেকের ধারণা যে, তিনি প্রায় দুই কুড়ি ভাষা জানতেন। একবার কারো কোনো লেখায় ‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঊনচল্লিশটি ভাষা জানেন’ বলে উল্লিখিত হয়। আমরা কয়েকজন এদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন : তারা অতিরিক্ত বাড়িয়ে বলেন। আসলে তিনি খুব ভালো করে পড়তে, লিখতে ও বলতে পারতেন বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহট্ট, উর্দু, হিন্দি, সিংহলি, কাশ্মীরি, নেপালি, অহমিয়া, ওড়িয়া, পোশতু এবং আরো কয়েকটি ভাষা। আর পড়তে ও বুঝতে পারতেন আরো দু’ডজনের মতো ভাষা। এক কথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন ইংরেজিতে যাকে বলে চড়ষুমষড়ঃ—বহুভাষিক। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ও ভাষা বিশ্লেষণে বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান, বিশেষ করে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার তাত্পর্য ব্যাখ্যায় তাঁর তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান সমৃদ্ধ করেছিল—যা তাঁর তাত্ত্বিকতার মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। বস্তুত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞানপরিধির বিস্তার আমাদের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে এ কথা নিশ্চিত বলতে পারি, এ এলাকায় যে ক’জন ভাষাতত্ত্বের অনুশীলনে নিয়োজিত হয়েছেন, তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে তাঁর কাছে ঋণী। তাঁরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেরণায় তারা ভাষাতত্ত্ব আলোচনায় আত্মনিয়োগে সমর্থ হয়েছেন। আমার নিজেরও ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র উত্সাহ ও প্রেরণায়ই হয়েছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমাদের দেশ-জাতি-ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। গবেষণা ছাড়া সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মে তাঁর অগাধ জ্ঞান, কোরআন, হাদিস ও ফিকহ বিষয়ক তাঁর সুবিজ্ঞ আলোচনা সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। তিনি ফরাসি, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ইত্যাদি নানা ভাষায় বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রণয়ন করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র অবদান সম্বন্ধে আলোকপাত করতে প্রয়াস পাব। ৩ ভাষাতত্ত্বমূলক আলোচনা আমাদের দেশে নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব তিন-চার শতকে যাস্ক, পাণিনি প্রভৃতি ভাষাবিজ্ঞানী বিবৃতিমূলক ভাষাতত্ত্বের প্রথম সূত্রপাত করেন। পাণিনি ছিলেন পাকিস্তানি। পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে কালাতুর গ্রামে তিনি বাস করতেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মী ও উত্তরসূরিরা সে অঞ্চলে প্রচলিত প্রাচীন কথা আর্য ও সংস্কৃত ভাষার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাদের আলোচনার পদ্ধতি ও ধারা আজও বিবৃতিমূলক ভাষাবিজ্ঞানের আদর্শস্থানীয় হয়ে রয়েছে। বর্তমানের ইউরোপ ও আমেরিকার আধুনিক ভাষাতত্ত্বেও আলোচনা তাঁরই আদর্শ অনুসরণ করে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ যুগেও পাশ্চাত্য দেশে পাণিনির ব্যাকরণকে মানুষের জ্ঞানের চরম নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়ে থাকে। পাণিনির পরেও অনেক দিন পর্যন্ত পাক-ভারতে এই ধারায় ভাষা-বিষয়ের আলোচনা অব্যাহত ছিল। পাণিনির মতো পতঞ্জলি প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানী এই উপমহাদেশে বর্ণনাভিত্তিক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। এরপর কিছুকাল আমরা আমাদের নিজেদের ভুলে গিয়েছিলাম। তাই বোধকরি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মতোই ভাষাতত্ত্বের আলোচনায়ও ভাটা পড়ে। ইউরোপ তথা পশ্চিম গোলার্ধ ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অনুশীলনীতে হাত দেয় আরো অনেক পরে। পশ্চিমের চোখে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলির আবিষ্কার এক মহাবিস্ময়। আধুনিক ভাষাতত্ত্বের মূল সূত্রটি এখান থেকেই নিয়ে তারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিজেদের ভাষার বিশ্লেষণ শুরু করলেন। কিন্তু কিছুদিন আগ পর্যন্তও ভাষাকে তুলনামূলক বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই দেখা হতো। সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার শব্দসম্ভারে সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্য, মিল-গরমিল বিশ্লেষণ করে অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের ভাষাগুলোর স্বরূপ নির্ণয়ই ছিল তখনকার দিনের মোটামুটি ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা। আজ আবার পুরনো ধারার নবজাগৃতির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাই বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের দিকেই আবার সবার নজর ফিরেছে। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় দেশি ও বিদেশি মনীষীর অবদানের ইতিহাস বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের আওতার বাইরে। কিন্তু তাদের বিচার-বিশ্লেষণের স্বরূপ বোঝার জন্য তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিঞ্চিত্ আলোচনার অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কেননা ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহেক বুঝতে হলেও এদের সামগ্রিক আলোচনার একটি মোটামুটি আভাস জানা থাকা একান্ত প্রয়োজন। এর আগে ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলে নিলে আমাদের আলোচনার সুবিধা হবে। ভাষাতত্ত্বে তিন ধারার ভাষা সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে—প্রথমত, বর্ণনামূলক ধারা। একে ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ও বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এবং তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব। বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বে ভাষাতাত্ত্বিক কোনো বিশেষ ভাষার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আলোচনার সুবিধার জন্য এই কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন : ১. ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) ২. ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology) ৩. রূপতত্ত্ব (Morphology) ৪. পদক্রম বা বাক্যরীতি (ঝুহঃধী) ৫. বাগর্থ বিজ্ঞান (Semantics) এবং ৬. অভিধান বিজ্ঞান (Lexicography)| বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের মূল কথা হলো, যে কোনো একটি ভাষার বিশেষ কালের বিশেষ রূপের বর্ণনা করা। তা করতে হলে সেই বিশেষ ভাষাভাষী লোকের মধ্য থেকে নির্বাচিত যে কোনো একজনের মুখের ভাষাই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। এভাবে একেকটি উপভাষার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সাহায্যে সেই ভাষার সামগ্রিক বর্ণনা সম্ভব হয়। মানুষের মুখের ভাষা যেমন ব্যবহৃত হয়, তারই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে সূত্র নির্ণয় করতে হয়। এই ধরনের বর্ণনায় ভাষার কোন নিয়ম আছে আর কোন নিয়ম নেই, তারই উল্লেখ থাকে; ভাষায় কী হওয়া উচিত আর কী হওয়া উচিত নয়, সে ধরনের বিধি-নিষেধের স্থান সেখানে নেই। এমনকি কেন এমন হয়, কেন এমন হয় না, তারও বিশ্লেষণ সেখানে অসঙ্গত। ভাষায় ব্যবহৃত নানা উপাদানকে একটা বিশেষ সংজ্ঞার মাধ্যমে একটা পদ্ধতির বন্ধনে আবদ্ধ করে যে বিশ্লেষণ শাস্ত্র গড়ে ওঠে, তাকেই তখন বলা হয় সেই ভাষার ব্যাকরণ।

ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্

এভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য ভাষাবিজ্ঞানী তার আলোচনাকে উল্লিখিত কয়েক ভাগে ভাগ করে থাকেন। ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) শাখায় ভাষার ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ পদ্ধতি, তাদের ব্যবহার ও স্থানভেদে তাদের উচ্চারণে তারতম্য, উচ্চারণের ব্যবহার-সঙ্গতি, সন্ধি ও বণ্টন, যতি ও ছন্দোবিন্যাস, এমনকি লিখনপদ্ধতিতে তাদের রূপায়ণ ইত্যাদির যথাযথ আলোচনা হয়। উচ্চারণের স্থান ও রকম, এমনকি তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও বিশদ আলোচনা সাধারণ ধ্বনিতত্ত্বের পর্যায়ভুক্ত। ধ্বনিবিজ্ঞানের আলোচনায় বিশ্লিষ্ট বর্ণনাকে যখন গাণিতিক সংকেতে আবদ্ধ করা হয়, তখনই একে ধ্বনিতত্ত্ব নাম দেয়া হয়। অর্থাত্ ধ্বনিবিজ্ঞানে যা ছিল বস্তুসম্পৃক্ত (পড়হপত্বঃব), ধ্বনিতত্ত্বে তা হয়ে ওঠে নির্বস্তুক (ধনংঃত্ধপঃ)। বিজ্ঞানের আলোচনায় এই জগতের নানা পদার্থেরই স্বভাব, গতি, শক্তি ও গুণ নানা সংকেতে ধরা যায়। যেমন অংকশাস্ত্রে—১ (এক), ২ (দুই) অথবা (বর্গমূলক), . (দশমিক বিন্দু), + (যোগ চিহ্ন), - (বিয়োগ চিহ্ন), – (পূরণ চিহ্ন), % (ভাগ চিহ্ন) ইত্যাদি মাধ্যমে অনেক কিছু বোঝানো হয়। ধ্বনিবিজ্ঞানের (Phonetics) বিশিষ্ট রূপও সেইরূপ নানা সংকেত ও চিহ্নের সাহায্যের ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) বিধৃত হয়। এক কথায় ধ্বনিবিজ্ঞানে (Phonetics), যার বিশ্লেষণ, ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) তারই গাণিতিক প্রকাশ। তাই ধ্বনিবিজ্ঞানে যাকে নানা কথায় বিশ্লেষণ করা হয়, ধ্বনিতত্ত্বে তাই হয় সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত কতকগুলো সংকেত বা সূত্রের (Formula) সমষ্টি। বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের এই দুটি শাখাকে একই বিভাগের দুটি স্তর বা পর্যায় মনে করা যেতে পারে। রূপতত্ত্ব (Morhphology) বিভাগে পদ ও শব্দসাধন পদ্ধতি অর্থাত্ পদ ও শব্দগঠন সম্পর্কিত নিয়মাবলি আলোচিত হয়। এতে সাধিত শব্দ বা পদের ধাতু, প্রত্যয়, অনুসর্গ, বিভক্তি প্রভৃতি ক্ষুদ্রতম অংশ নির্ণীত হয়। সমাস, অব্যয়, নিপাত ইত্যাদির আলোচনাও রূপতত্ত্বের প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্র। পদক্রম ও বাক্যরীতি (Syntax) বিভাগে আলোচিত হয় বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ ও পদগুলোর ক্রম আর বাক্য-বিশ্লেষণ পদ্ধতি। মূলত রূপতত্ত্ব (Morphology) ও পদক্রম (Syntax) একই বিভাগের দু’টি স্তর বা পর্যায়। কেননা, শব্দ ও পদের অংশ নিরূপণ বাক্য মধ্যে শব্দের অবস্থান ও কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। তাই কেউ কেউ এই দু’টি শাখাকে মিলিতভাবে ব্যাকরণও বলে থাকেন। কিন্তু ব্যাকরণের কার্যবিধির ধারায় ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম—এই সমুদয়ের পর্যায়ক্রমে পৃথক পৃথক ও সম্মিলিত এবং সামগ্রিক আলোচনা ও বিশ্লেষণই বাঞ্ছনীয়; তাই একটিকে ছেড়ে অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। চারটি বিভাগের বিশ্লেষণই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারো কারো ধারণা এই যে, যেহেতু ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম যথাক্রমে পরপর আলোচিত হয়, তাই এদের আলোচনার ধারাক্রমে এদের স্থান নির্ণীত হবে; যেমন ধ্বনিবিজ্ঞান নিম্নস্তরের, ধ্বনিতত্ত্ব তার পরের, রূপতত্ত্ব তারও পরের এবং পদক্রম সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু এরূপ ধারণা ভুল। আসলে এটি আলোচনার সুবিধার্থে এক ধরনের বিভাগ মাত্র, এতে স্তরের উচ্চতা-নিম্নতার প্রশ্ন নেই। বাগর্থ বা শব্দার্থ-বিজ্ঞানে (Semantics) বাক্যমধ্যে ব্যবহৃত শব্দ, শব্দসমষ্টি, বাক্যাংশের ও বাক্যের অর্থ নির্ধারণ ও তার প্রক্রিয়া নিরূপণ করা হয়। কালের ও স্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দার্থ কীরূপ বিকৃত, পরিবর্তিত ও অভিযোজিত হয়, তার বিস্তারিত আলোচনাও এর অন্তর্ভুক্ত। অভিধান-বিজ্ঞান বা অভিধানতত্ত্ব (Lexicography) বিভাগে বিশেষ ভাষার শব্দসম্ভার আর তার বিভিন্ন রূপ ও আকৃতি অনুযায়ী শৃঙ্খলা ও তার সঙ্গে অর্থের বিভিন্নতা ও প্রয়োগবিধি ইত্যাদি আলোচিত হয়। দেশি ও বিদেশি শব্দবিভাগ এবং কথায় ও সাহিত্যে এদের ব্যবহারবিধি—এসব এ বিভাগের আলোচ্য। দ্বিভাষিক বা ত্রিভাষিক অভিধানে শব্দ ও বাক্যাংশের প্রতিশব্দ ও অনুবাদ উল্লিখিত হয়। কেউ কেউ মনে করে, ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) হলো ভাষা বিশ্লেষণের পূর্ববর্তী স্তর (Prelinguistics) আর বাগর্থ-বিজ্ঞান (Semantics)-এর পরবর্তী স্তর। তাদের মতে যে কোনো ভাষা বিশ্লেষণে ধ্বনিতত্ত্বও বাগর্থ-বিজ্ঞান ভাষা বিশ্লেষণের স্তরবহির্ভূত। কিন্তু এসব আলোচনার স্থান এটি নয়। যে কোনো ভাষার বর্ণনামূলক আলোচনায় এই নিয়মে বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়। এই আলোচনায় বিভিন্ন ভাষার আকৃতি ও প্রকৃতি এমন নিখুঁতভাবে বিবৃত হয় যে, প্রত্যেকটি ভাষার স্বাতন্ত্র্য কেবল ভাষাবিজ্ঞানী কেন, সাধারণের কাছেও স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। ভাষার এই আশ্চর্য ক্ষমতা ও সমাজ-জীবনে তার অদ্ভুত প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণই ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অন্যতম উদ্দেশ্য। তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে একই ভাষার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কালের ধ্বনি, উচ্চারণ, শব্দরূপ, পদক্রম, শব্দসম্ভার ও অর্থ কী ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে, তার বর্ণনা থাকে। একই ভাষার বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাষার একই সময়ে অথবা বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন সময়ে যে মিল-গরমিল ধরা পড়ে, তারও বিশদ বর্ণনা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। আগে গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃতের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে তুলনা করাই ছিল ভাষাবিদদের কাজ। এখন একই ভাষার বিভিন্ন উপভাষাও তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষিত হতে দেখা যায়। ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের মাধ্যমে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের সহায়তায় বিশেষ কোনো ভাষার উচ্চারণ, ধ্বনি, শব্দ, পদক্রম ও বাক্যের ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করা হয়। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব—এ দুই শাখার আলোচনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর নির্ভর করে। আর যেহেতু প্রাচীন ভাষাগুলোর ধ্বনি হুবহু রক্ষিত হয়নি, তাই সেসব ভাষার আলোচনাও বেশিরভাগই অনুমানভিত্তিক, কাজেই দুর্বল। সেই কারণে অধুনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর সবার নজর পড়েছে। আগেই উল্লেখ করেছি যে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলি—এদের পরও কিছুদিন পর্যন্ত ভাষাতত্ত্বের আলোচনা এ উপমহাদেশে অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাস প্রায় শূন্য। বিংশ শতাব্দীতে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ইউরোপ ও আমেরিকা উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করে। এতে বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষা আলোচনা সেখানে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। আমাদের দেশেও বিগত শতাব্দীতে কিছু ভাষাবিদ ভাষা নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের প্রায় সব আলোচনাই প্রধানত তুলনামূলক ও ইতিহাসভিত্তিক। এদের মধ্যে বিমসের তত্ত্বের ÔComparative Grammar of Modern Indian Language’, রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকারের ÔWilson Phonological Lectures’, nibwji ÔComparative Grammar of the Indian Languages’, গ্রিয়ারসনের ‘Linguistic Survey of India’, কেলগের ‘Hindi Dialects’, Ges ট্রামপের ‘Sindhi Grammer’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষা সম্বন্ধে যেসব কাজ হয়েছে তার মধ্যে বিজয় চন্দ্র মজুমদারের The History of the Bengali Language, ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের Origin and Development of Bengali Language (vol. I & II)Õ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ এবং ডক্টর সুকুমার সেনের ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ই প্রধান। এছাড়া দেশি ও বিদেশি নানা পত্র-পত্রিকায় এদের এবং আরো অনেকের আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এদের প্রায় সব আলোচনাই ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের আওতায় পড়ে। আমাদের দেশের আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার সূচনা হয় এই শতাব্দীতে গ্রিয়ারসন সাহেবের খরহমঁরংঃরপ ঝঁত্াবু ড়ভ ওহফরধ-এর াড়ষ. ঠ-এ ‘শব্দকথা’ (১৭১০ খ্রি.), প্রবন্ধ সংগ্রহে সংকলিত এবং সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় (১০০৭-১৯০৭ খ্রি.) প্রকাশিত ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’, ‘বাঙ্গালা কৃত্ ও তদ্ধিত্’, ‘না’, ‘কারক প্রকরণ’ এবং ‘ধ্বনি বিচার’—এই বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য আলোচনা। এরপর ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'Bengali Phonetic Reader' (1928) Ges 'A Brief Sketch of Bengali Phonetics (1928), W. Sutton Page-Gi 'Introduction of Colloquial Bengali' (1934) প্রকাশিত হয়। এসবই বাংলা ভাষা সংক্রান্ত বর্ণনাত্মক আলোচনার এক রকম দিকদর্শন। আমরা মূল আলোচনা থেকে একটু দূরে চলে এসেছি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় কী কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা-ই আমাদের দ্রষ্টব্য। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে ভাষাতত্ত্বের মূলতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় যেসব মনীষী আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের কথা এসে পড়েছে। হ (সংক্ষেপিত)

কালের ডানায় সোনালি রোদ্দুর

আধুনিক কবি কালের ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন; কিঞ্চিত্ প্রভাবিত। সমকালের বিভিন্ন প্রপঞ্চ আধুনিক মন ও মননকে বিমোহিত করে সত্য; কিন্তু তাতেই শৃঙ্খলিত করে না। বিশেষত কবি ঘটনার ফল নন; ঘটনার দ্রষ্টামাত্র। শব্দের অর্থ কবির হাতে পড়ে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। মানবমন বস্তুনিরপেক্ষ নয়। ফলে নিষ্প্রাণ বস্তুরাশিও সময়ে প্রাণবন্ত ও সজীব হয়ে ওঠে। সচেতন প্রয়াসেই কবি তার প্রতিবেশ নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যক্তিমানুষের ক্ষোভ, প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা, ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের বহুরৈখিক রূপ অঙ্কন করেন। আধুনিক কবি সমাজ নয়; ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, মনোবিকার ও তাত্ক্ষণিক অনুভূতির বহুমাত্রিক চিত্র আঁকার চেষ্টা করেন গভীর মনোনিবেশে। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে আধুনিক বাংলা কবিতা উত্কর্ষে ও প্রাচুর্যে অনন্য। নিসর্গ চেতনা ও মানবজাতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌনচেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আল মাহমুদের কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। প্রকৃতি ও নারী আল মাহমুদের চেতনায় একই প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। সেখান থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন না। অথবা সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টাও করেন না। পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রের পুনর্জীবনের কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও সাম্যবাদের বিকিরণ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞ, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজাতির জ্ঞানকাণ্ডে সিঞ্চনের জন্য শীতল জলের যে আধার তা কতটা নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ, তার যৌক্তিক স্বপ্নকল্প নির্মাণ করার দায় একা কবির? তা হলে সে দায় এবং স্বাপ্নিক বিরোধে তর্কলিপ্ত হতে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিঃশঙ্ক। জীবনানন্দ দাশে দেখি ইতিহাস চেতনা, ভৌগোলিক ধারণার সঙ্গে মানুষের মনোবিকার একই সমতলে অঙ্কন করতে। জীবনানন্দ দাশ চিত্রকল্প নির্মাণে নৈসর্গিক আবহকে প্রাধান্য দিয়েছেন; ফলে তার কবিতা চিত্রকল্পপ্রধান এবং গ্রামীণ অনুষঙ্গে বিভাসিত হতে দেখা যায়। তবে তার কণ্ঠে জটিল সারল্য ছিল। এক ধরনের কমনীয়তাও লক্ষ করা যায় দাশকাব্যে। অন্যদিকে একেবারেই গ্রামীণ জীবনে উচ্চারিত শব্দ সমবায়ে গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার চিত্র অঙ্কন করেছেন জসীমউদ্দীন। জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ দু’জনই আধুনিক চিত্রকলার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জসীমউদ্দীনকে অনুপ্রাণিত করেছে আবহমান বাংলার জীবনযাত্রা নিয়ে অঙ্কিত চিত্রকর্ম আর জীবনানন্দ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আধুনিক চিত্রকলার ইঙ্গিতময়তার দ্বারা। আর তাদের দু’জনের মিশ্র প্রভাব লক্ষ করি আল মাহমুদে। মাত্র উপমা নির্মাণ কিংবা চিত্রকল্প নির্মাণের নৈপুণ্যই কবিতা নয়, তা হলে কলাকৈবল্যবাদীরাই কবি অভিধায় অভিষিক্ত হতেন। বাকিরা থাকতেন চির উপেক্ষিত। তবু কবিমাত্রই ছন্দে সিদ্ধহস্ত। ছন্দমাত্রাজ্ঞানহীন ব্যক্তির পক্ষে আর যাই হোক, কবিতা লেখা সম্ভব নয়। প্রকৃত কবিতার শরীরের কোষে কোষে ছুটে চলা রক্তকণিকার মতো ছন্দের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি বিদ্যমান। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ কবি শুরু করেছেন শঙ্কাহীন পৌরুষ এবং শর্তহীন আত্মনিবেদনের ভাবাবেগ দ্বারা। আত্মনিবেদনের এমন বিলোড়িত ও শৈল্পিক ভঙ্গি এর আগে বাংলা কবিতার পাঠক প্রত্যক্ষ করেছেন মর্মে কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। নতজানু পুরুষ তার চিরকাঙ্ক্ষিত রমণীর সামনে, এরকম দৃশ্য আর কেউ আঁকেননি। এখানে রমণীর কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কোনোরূপ উল্লেখ করা হয়নি। তবু কবি কী কারণে কাঙ্ক্ষিত রমণীর কোনো বিশেষ গুণটির জন্য নিজেকে এভাবে সমর্পণ করলেন, তার সদুত্তর পাওয়া মুশকিল। তা হলে রমণীর কোনো রূপ জ্ঞান কিংবা সৌন্দর্য ব্যতিরেকেও অন্য কোনো অনুল্লেখ্য সাধারণ কিংবা অব্যাখ্যেয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিও কবিপুরুষ বিমোহিত হন কখনও-কখনও? সোনার দিনার নেই দেনমোহর চেয়ো না হরিণী যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি। [১নং সনেট] কবিতা জ্ঞানের বস্তু নয়; অনুভবের এবং পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গমাত্র। কবিতা ইতিহাস নয়; ইতিহাসের নির্যাস কবিতায় প্রচ্ছন্ন। আল মাহমুদ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দকে এসব অভিজ্ঞতার স্মারক হিসেবে গ্রহণ করে শব্দ ব্যবহারের একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রকরণের প্রচলন করেছেন। এটি তার নিজস্ব ঢং, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তার শব্দ নির্বাচন, নতুন শব্দ গঠন এবং উপমা প্রয়োগে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য পরিশ্রমের স্বাক্ষর মেলে। ভাবালুতা-সর্বস্ব চিত্রকল্প কিংবা তরল বাক্য বিন্যাসের বিলসিত আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে মেলে না। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের আটপৌরে শব্দরাজির সঙ্গে আধুনিক মননজাত শব্দ সমবায়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্বয়সাধন তার কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে, জীবনানন্দ দাশের ইউরোপীয় আধুনিক চেতনা এবং জসীমউদ্দীনের পল্লীর সাদামাঠা ভাবালুতাময় শব্দ থেকে। সম্ভবত এ কারণে আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠক আল মাহমুদকে গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠকালে জসীমউদ্দীন পল্লীর সাধারণ মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে এবং জীবনানন্দ দাশ তার অন্তহীন বিগলিত ইউরোপীয় আধুনিকতার তাত্পর্যময় অনন্ত বিষণ্নতাসহ উপস্থিত হন

কালের ডানায় সোনালি রোদ্দুর

মো হা ম্ম দ নূ রু ল হ ক আধুনিক কবি কালের ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন; কিঞ্চিত্ প্রভাবিত। সমকালের বিভিন্ন প্রপঞ্চ আধুনিক মন ও মননকে বিমোহিত করে সত্য; কিন্তু তাতেই শৃঙ্খলিত করে না। বিশেষত কবি ঘটনার ফল নন; ঘটনার দ্রষ্টামাত্র। শব্দের অর্থ কবির হাতে পড়ে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। মানবমন বস্তুনিরপেক্ষ নয়। ফলে নিষ্প্রাণ বস্তুরাশিও সময়ে প্রাণবন্ত ও সজীব হয়ে ওঠে। সচেতন প্রয়াসেই কবি তার প্রতিবেশ নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যক্তিমানুষের ক্ষোভ, প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা, ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের বহুরৈখিক রূপ অঙ্কন করেন। আধুনিক কবি সমাজ নয়; ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, মনোবিকার ও তাত্ক্ষণিক অনুভূতির বহুমাত্রিক চিত্র আঁকার চেষ্টা করেন গভীর মনোনিবেশে। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে আধুনিক বাংলা কবিতা উত্কর্ষে ও প্রাচুর্যে অনন্য। নিসর্গ চেতনা ও মানবজাতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌনচেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আল মাহমুদের কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। প্রকৃতি ও নারী আল মাহমুদের চেতনায় একই প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। সেখান থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন না। অথবা সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টাও করেন না। পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রের পুনর্জীবনের কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও সাম্যবাদের বিকিরণ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞ, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজাতির জ্ঞানকাণ্ডে সিঞ্চনের জন্য শীতল জলের যে আধার তা কতটা নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ, তার যৌক্তিক স্বপ্নকল্প নির্মাণ করার দায় একা কবির? তা হলে সে দায় এবং স্বাপ্নিক বিরোধে তর্কলিপ্ত হতে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিঃশঙ্ক। জীবনানন্দ দাশে দেখি ইতিহাস চেতনা, ভৌগোলিক ধারণার সঙ্গে মানুষের মনোবিকার একই সমতলে অঙ্কন করতে। জীবনানন্দ দাশ চিত্রকল্প নির্মাণে নৈসর্গিক আবহকে প্রাধান্য দিয়েছেন; ফলে তার কবিতা চিত্রকল্পপ্রধান এবং গ্রামীণ অনুষঙ্গে বিভাসিত হতে দেখা যায়। তবে তার কণ্ঠে জটিল সারল্য ছিল। এক ধরনের কমনীয়তাও লক্ষ করা যায় দাশকাব্যে। অন্যদিকে একেবারেই গ্রামীণ জীবনে উচ্চারিত শব্দ সমবায়ে গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার চিত্র অঙ্কন করেছেন জসীমউদ্দীন। জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ দু’জনই আধুনিক চিত্রকলার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জসীমউদ্দীনকে অনুপ্রাণিত করেছে আবহমান বাংলার জীবনযাত্রা নিয়ে অঙ্কিত চিত্রকর্ম আর জীবনানন্দ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আধুনিক চিত্রকলার ইঙ্গিতময়তার দ্বারা। আর তাদের দু’জনের মিশ্র প্রভাব লক্ষ করি আল মাহমুদে। মাত্র উপমা নির্মাণ কিংবা চিত্রকল্প নির্মাণের নৈপুণ্যই কবিতা নয়, তা হলে কলাকৈবল্যবাদীরাই কবি অভিধায় অভিষিক্ত হতেন। বাকিরা থাকতেন চির উপেক্ষিত। তবু কবিমাত্রই ছন্দে সিদ্ধহস্ত। ছন্দমাত্রাজ্ঞানহীন ব্যক্তির পক্ষে আর যাই হোক, কবিতা লেখা সম্ভব নয়। প্রকৃত কবিতার শরীরের কোষে কোষে ছুটে চলা রক্তকণিকার মতো ছন্দের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি বিদ্যমান। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ কবি শুরু করেছেন শঙ্কাহীন পৌরুষ এবং শর্তহীন আত্মনিবেদনের ভাবাবেগ দ্বারা। আত্মনিবেদনের এমন বিলোড়িত ও শৈল্পিক ভঙ্গি এর আগে বাংলা কবিতার পাঠক প্রত্যক্ষ করেছেন মর্মে কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। নতজানু পুরুষ তার চিরকাঙ্ক্ষিত রমণীর সামনে, এরকম দৃশ্য আর কেউ আঁকেননি। এখানে রমণীর কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কোনোরূপ উল্লেখ করা হয়নি। তবু কবি কী কারণে কাঙ্ক্ষিত রমণীর কোনো বিশেষ গুণটির জন্য নিজেকে এভাবে সমর্পণ করলেন, তার সদুত্তর পাওয়া মুশকিল। তা হলে রমণীর কোনো রূপ জ্ঞান কিংবা সৌন্দর্য ব্যতিরেকেও অন্য কোনো অনুল্লেখ্য সাধারণ কিংবা অব্যাখ্যেয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিও কবিপুরুষ বিমোহিত হন কখনও-কখনও? সোনার দিনার নেই দেনমোহর চেয়ো না হরিণী যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি। [১নং সনেট] কবিতা জ্ঞানের বস্তু নয়; অনুভবের এবং পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গমাত্র। কবিতা ইতিহাস নয়; ইতিহাসের নির্যাস কবিতায় প্রচ্ছন্ন। আল মাহমুদ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দকে এসব অভিজ্ঞতার স্মারক হিসেবে গ্রহণ করে শব্দ ব্যবহারের একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রকরণের প্রচলন করেছেন। এটি তার নিজস্ব ঢং, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তার শব্দ নির্বাচন, নতুন শব্দ গঠন এবং উপমা প্রয়োগে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য পরিশ্রমের স্বাক্ষর মেলে। ভাবালুতা-সর্বস্ব চিত্রকল্প কিংবা তরল বাক্য বিন্যাসের বিলসিত আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে মেলে না। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের আটপৌরে শব্দরাজির সঙ্গে আধুনিক মননজাত শব্দ সমবায়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্বয়সাধন তার কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে, জীবনানন্দ দাশের ইউরোপীয় আধুনিক চেতনা এবং জসীমউদ্দীনের পল্লীর সাদামাঠা ভাবালুতাময় শব্দ থেকে। সম্ভবত এ কারণে আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠক আল মাহমুদকে গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠকালে জসীমউদ্দীন পল্লীর সাধারণ মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে এবং জীবনানন্দ দাশ তার অন্তহীন বিগলিত ইউরোপীয় আধুনিকতার তাত্পর্যময় অনন্ত বিষণ্নতাসহ উপস্থিত হন
আবহমান বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, প্রথাগত ধারণাকে গভীরভাবে আত্মস্থ করে আধুনিক জীবনের, যুগযন্ত্রণার অভিজ্ঞতাকে নির্মম বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করেছেন। কামহীন প্রেমকে কবি সন্দেহের চোখে দেখেছেন এবং প্রেমহীন কামকে কবি ঘৃণার্হ করে তুলেছেন শব্দের পর শব্দ নির্বাচন, গঠন ও প্রয়োগের মাধ্যমে। তার পর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী ক্ষেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ [১০নং সনেট] মিথ এবং উপকথার প্রতি কবির অমোঘ আকর্ষণ লক্ষণীয়। পুরাণের বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ড তার মন ও মননে গভীর রেখাপাত করেছে; নয়তো পুরুষ তার নারীকে প্রলুব্ধ করার জন্য বিভিন্ন চরিত্রের উদাহরণ টেনে আনবেন কেন! তার কাছে শাস্ত্রীয় ধর্মের চেয়ে মানবধর্ম বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষের ধর্ম মানেই ফসলের সুষম বণ্টন হবে—এই প্রত্যয় নিয়ে কবি তার দয়িতাকে আলিঙ্গনে আহ্বান করেন। কোনো সংঘ কবির আরাধ্য নয়। কারণ কবিমাত্রই বাঁধনহারা, দৃঢ়চেতা এবং সত্ সাহসী। কবিরা কোনো সংঘের শরণ নেয়ার চেয়ে দরিদ্র বাউলের বাউণ্ডুলেপনাকে শ্রেয় বোধে লালন করেন। পূর্বপুরুষরা কবে ছিল কোন সম্রাটের দাস বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড় সেই অপবাদে আজও ফুঁসে উঠে বঙ্গের বাতাস মুখ ঢাকে আলাউল রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার এর চেয়ে ভাল নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল? [৬নং সনেট] শব্দকে একটি শান্ত ও গম্ভীর প্রবহমান নদীর মতো প্রয়োগ করতে পারার মধ্যে শিল্পীর নান্দনিক ও তাত্পর্যময় ভূমিকা রয়েছে, যার মাধ্যমে কবি নিজের ব্যক্তিত্ব, মনন ও রুচিকে সংক্রমিত করেন তার পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যেও। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দের যুক্তিগ্রাহ্য ও নান্দনিক চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে পুরাণ ও মিথকে আশ্রয় করেছেন। এই প্রবণতা তাকে বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে তার পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক অন্য কবিদের কাব্যভাষা থেকে। ফলে তার কণ্ঠস্বরটি স্বতন্ত্র মর্যাদা পেয়েছে—যথার্থ ও অনিবার্য কারণেই। ছন্দ নির্বাচনে কবি আঠারো মাত্রার সমিল অক্ষরবৃত্তকে বেছে নিয়েছেন—বোধ হয় এই ছন্দের প্রবল গাম্ভীর্যময় চারিত্র্যের জন্যই। নিরূপিত ছন্দোপযোগী শব্দ নির্বাচনে আধুনিক কবির স্বাধীনতা সামান্যতম হলেও ক্ষুণ্ন হয় বলে মনে করি। কারণ যথেচ্ছ শব্দ নির্বাচন ও গঠনের সুযোগ নিরূপিত ছন্দে নেই বললেই চলে। এর কারণ বাক্যস্থিত শব্দ সমবায়ের বিন্যাস হতে হয়—অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য পরম্পরায়। এর ব্যতিক্রমে ছন্দপতন ও বিষয়ের বোধগম্যতায় জটিলতা দেখা দিতে পারে। ফলত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। প্রস্তর যুগের এই সর্বশেষ উলাসের মাঝে কোথায় পালাবে বলো কোন ঝোপে লুকাবে বিহ্বলা? স্বাধীন মৃগের বর্ণ তোমারও যে শরীরে বিরাজে আমাদের কলা কেন্দ্রে আমাদের সর্ব কারুকাজে অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা। [১১নং সনেট] এই অস্তিবাদী জিরাফেরা তাদের ব্যক্তিগত গলা অহরহ বাড়ায়। আজকের অশান্ত বিশ্বের প্রতিটি অশুভ কর্মযজ্ঞের নেপথ্যে রয়েছে এই অস্তিবাদী জিরাফেরা। এই যে বিষয়ের সঙ্গে ছন্দোপযোগী শব্দ ও পর্ববিন্যাস এবং উপমার যে অভিনবত্ব দেখি, তা অনস্বীকার্যভাবে উজ্জ্বল। বাংলার কৃষকসমাজের উত্থান-পতন যেমন জসীমউদ্দীন এঁকেছেন তার স্বভাব সারল্যে; আবহমান বাংলার মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিল রূপ যেমন এঁকেছেন জীবনানন্দ দাশ তার দীর্ঘ বিষণ্নতার ঘোর রহস্যময় সম্মোহনে; তেমনি আল মাহমুদ এঁকেছেন তার মননশীলতার সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির অন্বয়সাধনের মাধ্যমে। সোনালি কাবিন বিষয় নির্বাচন, শব্দ প্রয়োগ, উপমা-চিত্রকল্প নির্মাণ, ছন্দের প্রয়োগ, পদবিন্যাসের স্বতন্ত্র কৌশলের কারণে বিশিষ্ট। সুলুক সন্ধানী পাঠকমাত্রই আবিষ্কার করবেন এই সনেটগুচ্ছে প্রকৃতি ও মানুষের এক ঘোর রহস্যময় সারল্যের ভাষাচিত্র। স্বাপ্নিক বিরোধ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে নেই সত্য; কিন্তু অন্তহীন রহস্যময় দিগন্তরেখার মোহনীয় উদ্ভাস লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্বোধ্যতা ভর করেনি, সারল্যও নেই; আছে বিমূর্ত আবহের চেতনা। আধুনিক বাংলা কবিতা অনুভবের জন্য শিক্ষিত পাঠকমন প্রয়োজন। কবিতা শুধু বুদ্ধিপ্রধান বাক্যবন্ধের সমষ্টি নয়; ভাবালুতাসর্বস্ব তরল শব্দ সমবায়ে রচিত বাক্যাবলিও কবিতা নয়। কবিতা যদি মানবজীবনের যাপিত অংশের শৈল্পিক ধারাভাষ্য কিংবা নান্দনিক প্রতিচ্ছবি না হয়, তাহলে পাঠক সেটাকে গ্রহণ করে না। আবার গতানুগতিক বিষয়ের প্রথাগত বুননও কবিকণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করি। কাব্য-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কবির দীর্ঘদিনের অভ্যাস, অর্জিত জ্ঞান, মনীষা, আত্মোপলব্ধিজাত অন্তর্নিহিত তাত্পর্যময় চিত্রকল্প, উপমা, উেপ্রক্ষা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কালই শেষ পর্যন্ত কবিতার শ্রেষ্ঠ পাঠক ও বিচারক। বাংলা কবিতার ইতিহাসে সোনালি কাবিন একাধারে বুর্জোয়া, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ। সোনালি কাবিনে ব্যবহৃত শব্দরাজি বাঙালির যাপিত জীবনের প্রতিদিন উচ্চারিত শব্দরাজি থেকে আহরিত। সোনালি কাবিন নিখিল নাস্তির দলিল নয়; নয় প্রবল বিশ্বাসের খতিয়ানও। হ

বাংলাভাষা বাংলাদেশেরই আত্মা, কলকাতায় সব হিন্দি আর ইংরেজি : আল মাহমুদ

সাক্ষাত্কার : হাসান হাফিজ/আহমদ বাসির # ৭৭-এ পা দিচ্ছেন, কেমন বাংলাদেশ আপনি দেখতে চান? — স্বাধীন, সার্বভৌম, শান্তিময় বাংলাদেশ দেখতে চাই, সুখী বাংলাদেশ। # আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবের বাংলাদেশের মধ্যে ফারাকটা কতখানি? — বেশ ফারাক আছে। কারণ কবি যে কল্পনা করে, আমরা একটু বেশি আশা করি, সে রকম তো আর হয় না, আমরা যা আশা করি। তবু পায়ের নিচের মাটিটা তো বাংলাদেশ। তাই না? এক ভালোবাসার টান। # একটা রক্তের প্লাবনের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন আমরা জানি। সে সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলেন। — স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমরা প্রকাশ্যে ছিলাম না, কিন্তু আশপাশে ছিলাম, তাদের সঙ্গেই। # এবং তারও আগে থেকেই বাংলাদেশের সত্তা যখন গঠিত হচ্ছিল, আপনার বিভিন্ন লেখার মধ্যে এসেছে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এসেছে, ভাষা আন্দোলন এসেছে। বাংলাদেশের মাটিকে, এদেশের জলকে, হাওয়াকে, লোকজ জীবনকে তুলে এনেছেন—এসবের পেছনে আপনার কী দর্শনটা কাজ করেছিল? — বাংলার মাটি! একটা কথা আছে না—‘বাংলার মাটি বাংলার জল/পুণ্য হউক পুণ্য হউক...’ এই। # কবিতা ও নারী—কে বেশি রহস্যময়ী? — সন্দেহ নেই, এ দু’জনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ব নেই, কারণ কবিরা যেখানে শুতে যায় সেই জায়গাটার একদিকে নারী, আরেক দিকে বই থাকে। এই দুটোকে সরিয়ে কবিকে বিশ্রাম নিতে হয়। আশা করি কথাটা বুঝেছ। # আপনি তো একজন ঘোরতর আস্তিক মানুষ। এই বিশ্বাস, এই রহস্যময়তা আপনার বিপুল রচনাসম্ভারে নানা মাত্রিকতায়, নানা অবয়বে প্রতিফলিত। এই মরমিয়াবাদ সম্পর্কে পাঠকদের কিছু বলুন। — আমি বিশ্বাসী। বিশ্বাসী মানুষ কী করে? বিশ্বাসী মানুষ সবসময় একটা কাজ করে। সেটা কী করে? সে সেজদা করে অদৃশ্যের দিকে এবং সে প্রার্থনা করে, অ্যান্ড হি প্রেজ, প্রার্থনা করতে থাকে। এটা আমার একটা ধারণা। ধারণা কী? এটা সত্য। # আপনার লেখালেখির শুরুটা কেমন করে হয়েছে? — আমি মফস্বল শহরে থাকতাম। খুব পড়তাম আমি। পড়তে পড়তে একদিন মনে হলো—আচ্ছা, আমিও তো এরকম লিখতে পারি। লেখা শুরু করলাম। আশ্চর্য যে, আমার লেখা তখন এদেশের শ্রেষ্ঠ কাগজগুলো খুবই অনায়াসে ছেপে দিল। # সেটা তো বিস্ময়কর! — আমার কাছেও বিস্ময়কর! # এখনও? — এখনও লাগে। # আপনার জীবনে এমন কোনো স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা আছে কী, যেটা এখনও পূর্ণ হয়নি? — এটা তো তুমি একটা খুব জটিল প্রশ্ন করলে। আমি তো পূর্ণতা এবং অপূর্ণতার মধ্যে বাস করি। কিছু পাই, কিছু পাই না। এই হাতড়ে বেড়াই। এটা হলো জীবন। # ‘লোক লোকান্তর’ থেকে ‘পাখির কথায় পাখা মেললাম’ এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আপনার যে বাঁকবদলগুলো হয়েছে, তার পেছনে কোন ফ্যাক্টরগুলো কাজ করেছে বলে আপনি মনে করেন? — আমার জীবনই একটা আশ্চর্য জীবন। কত ঘাটে ভিড়তে হয়েছে। কত কিছু দেখলাম, জানলাম। সবকিছুর মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে, দেশে যা কিছু ঘটেছে। আমি তো এদেশ থেকে পালিয়ে যাইনি। আমি দেশে থেকে দেশের সব কিছুতে অংশগ্রহণ করেছি, দেখেছি, মুভ করেছি এবং আরেকটা কী ব্যাপার—কেঁদেছি। আই ওয়েপ্ট। # নানা ধরনের লেখা আপনি লেখেন। কথাশিল্প, কলাম, কবিতা, আত্মজৈবনিক—কোন শাখায় লিখতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, কেন? — আসলে ওই অতীত নিয়ে লিখতে ভালোই লাগে। কিন্তু অতীত বেশিদিন দেখা যায় না। আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু বর্তমানটা যে এতই বাস্তব এবং এতই রূঢ় যে, এর মধ্যে বসবাস করতে হলে সাহস, শক্তি এবং কাব্যগুণ লাগে। সেটা মনে হয় আমারও কম-বিস্তর আছে। # কেউ কেউ বলে, অদূর ভবিষ্যতে ‘বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হবে ঢাকা’। — এটা কেউ কেউ নয়, আমিই বলেছি প্রথম। # এ কথার বাস্তব ভিত্তি কতটা মজবুত হয়েছে? — বাংলা ভাষাই বাংলাদেশের আত্মা। এই ভাষার সঙ্গে অন্য কিছুকে বাংলাদেশ মিশ্রিত করে না। এক দিগ্বিজয়ী ভাষা। শব্দের তরঙ্গ বাংলাদেশেই বইছে। বাংলাদেশ ছাড়া এটা আর কোথাও সম্ভবপর হয়নি। কলকাতা গেলে তুমি দেখবে, সব হিন্দি আর ইংরেজি। # সেখানে বাংলা ভাষা মরে যাচ্ছে, ওরা টিকিয়ে রাখতে পারছে না। — না, পারছে না। # গদ্য কিংবা কবিতা লেখার পরবর্তী যে অনুভব কিংবা সাফল্যের শিহরণ—দুয়ের মধ্যে মৌল কোনো পার্থক্য আছে কি? — আমি সব সময় ভাবি যে, আমার খাপে তো দুইটা তরবারি আছে—একটা গদ্যের, একটা পদ্যের। যখন যেটা আমার প্রয়োজন, সেটা ব্যবহার করেছি। # তরুণ কবিদের জন্য আপনার কোনো উপদেশ আছে কি? — কথা হলো যে, উপদেশ দেয়া আমার জন্য ঠিক না। তরুণরা ইচ্ছানুযায়ী চলবে—এটাই আমরা চাই। তবে একটা কথা বলব। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। জ্ঞান না হলে কিছুই হয় না। বলা হয় না, জ্ঞানবৃক্ষের ফল না খেলে সে তো কিছুই জানে না? জ্ঞানবৃক্ষের ফল একবার যে খেয়েছে, তাকে পৃথিবীতে আসতে হয়েছে স্বর্গ ছেড়ে। স্বর্গ থেকে তাকে বের করে দেয়া হবে, সে পৃথিবীতেই চলে আসবে। পৃথিবীতে এসে নিজের পরিশ্রমের অন্ন নিজে খাবে। # দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতা প্রকৃত সাহিত্যচর্চায় কতটা অবদান রাখতে পারছে? — আমাদের দেশে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পৃষ্ঠা আমাদের সাহিত্যের জন্য সাহায্যকারী হয়েছে। অন্য দেশে এটা হয়নি, আমাদের দেশে হয়েছে। # মানসম্পন্ন সাহিত্য কাগজের অভাবের কারণে হয়েছে? — তাই, তাই তো দেখতে হবে। নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা নেই। লিটলম্যাগ আছে। # বাংলা কবিতার ভবিষ্যত্ কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়? — এটা বলা উচিত না। কারণ, আধুনিক বাংলা কবিতা হলো আধুনিক জাতীয় জীবনের একটা দৃষ্টান্ত। আধুনিক বাংলা কবিতা এতই পরিপকস্ফ এবং এতই ডালপালা মেলে দিয়েছে, যদিও গদ্যকে আমরা আধুনিক বলি, এটা অন্য কোনো সাহিত্যে ঘটেনি যে, কবিতাই বিজয়ী হয়েছে। # সাধারণভাবে বলা হয়, বাংলাদেশে কবিতার পাঠক ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এর কারণটা কী? — আশ্চর্য কথা—বাংলাদেশে কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে। দল বেঁধে কেউ কবিতা (৭-এর পৃষ্ঠার পর) পড়ত নাকি? কোনো সময় পড়েনি। দলবদ্ধভাবে কাব্যচর্চা করেছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। কেউ কেউ করেছে—এরাই তো বাঁচিয়ে রাখে সব। # আমাদের সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা বিশ্বমানের বিচারে কোন অবস্থায় আছে? — আধুনিকতার দিক দিয়ে প্রায় জগতের সাহিত্যের সমকক্ষ। আমাদের কবিতা যদি ব্যাপক অনুবাদ হয় তাহলে বোঝা যাবে, কী আশ্চর্য কাজ হয়েছে বাংলা ভাষায়! # স্বাধীনতার চল্লিশ বছর হয়ে গেল, অনুবাদের ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য কিন্তু সেভাবে আসেনি। — না, অনুবাদ করার মতো লোক আসেনি। এটা ঠিকই কথা। # বাংলা একাডেমীর একটা ভূমিকা, দায়িত্ব কি এক্ষেত্রে ছিল না? — কার কার ভূমিকা বা দায়িত্ব ছিল এটা বলে কোনো লাভ নেই। এটা ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। একজন লোক যদি থাকে, তাহলে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেয়। # কেউ যদি বলে, আপনার ইদানীং কালের লেখায় আগেকার সেই লাবণ্য ও মাধুর্য কিছুটা গরহাজির—এ অভিযোগের বিপরীতে আপনার বক্তব্য কী হবে? — আমার পক্ষ থেকে এর কোনো জবাব নেই। তবে কী কারণে বলে, তা কিন্তু উল্লেখ করা হয় না। তারা ভ্রান্ত কিনা, নাকি আমি ভুল করছি সেটা বোঝার মতো ব্যাখ্যা হয়নি এখনও। # বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে সমকালীন কাব্যধারা কিংবা প্রবণতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যগুলো কী কী? — আমি পশ্চিমবঙ্গের কবিতা সম্পর্কে কম জানি। আমার পড়া হয়ে উঠছে না। এ ব্যাপারে জ্ঞান অপেক্ষাকৃত কম আমার। কে লিখছে, কী লিখছে এটা আমি জানি না, তখন একটা আন্দাজি মন্তব্য আমি করতে পারি না। তবে একথা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের কাব্যের শক্তি এবং ঐশ্বর্য অনেক বেশি। বিশেষ করে এর যে লোকজ গ্রাউন্ড, সেটা অনেক উর্বর বলে আমি মনে করি। # আপনার মায়াবি কলমে শিশু-কিশোরদের জন্য বেশকিছু মূল্যবান ফসল ফলেছে। কারও কারও অভিযোগ, আপনি এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনোযোগ ও সময় দেননি। আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনার বক্তব্য কী হবে? — হয়তোবা। যারা আমার এ খুঁতটা ধরতে পেরেছে তারা আমার অনুরাগী। তাদের উচিত ছিল একটা পরামর্শ দেয়া, কিন্তু তারা তো সেটা করেননি। করা উচিত ছিল। এটা তারা যদি বলে দিতেন, তাহলে আমি সেভাবে চলতাম। # বলা হয়, আমাদের কবিতাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ কখনও নেয়া হয়নি। এই ক্ষতির জন্য কে বা কারা দায়ী? — কেউ দায়ী নয়। ভালো ট্রান্সলেটরের অভাব— যে একই সঙ্গে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী হবে। তাদের আবির্ভাব হয়নি। এটা একটা দুর্ভাগ্য বলা যেতে পারে। # একজন খাঁটি কবি হওয়ার ক্ষেত্রে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা কতটা জরুরি? — আমি আস্তিকতাকে খুব মূল্য দিই। কারণ, বিশ্বাস হলো একটা হাতল। এটা ধরতে হয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। বিতণ্ডা করে কোনো লাভ নেই। # মহাকালের বিচারে আপনার কবিতা কতটা টিকে থাকবে বলে আপনার ধারণা? — আমি তো ভবিষ্যত্ বক্তা নই। যে কারণে বলতে পারব না। মহাকালের বিচারে টিকে থাকে না অনেক কিছুই। তুমি চর্যাপদ দেখ, চর্যাচর্যাবিনিশ্চয়। এটা কীভাবে আছে? ‘শাশুড়ী নিদ গাএ বউড়ি জাগত্র কানেট চোরে নিল কাগই মাগত্র’ # প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলী আকবর খান একবার বলেছিলেন যে, নিবিড় সঙ্গীত সাধনার এক পর্যায়ে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য অনুভব করা যায়। কবিতা রচনার কোনো পর্যায়ে এমন ধরনের কোনো ঐশী বোধ কি কখনও আপনাকে আচ্ছন্ন করেছে? — তিনি তো বলেছেন সঙ্গীত সম্পর্কে; কিন্তু আমি যে জিনিস চর্চা করি এটার নাম হলো আধুনিক কবিতা। কবিতার মধ্যেও সঙ্গীত আছে। আমি লিরিকটা পছন্দ করি। আমি একটু লিরিক্যাল লোক এবং লিরিক হলো সবকিছু পাওয়ার একটা পথ। এটাই অনুসন্ধান করতে হবে।

বাংলাভাষা বাংলাদেশেরই আত্মা, কলকাতায় সব হিন্দি আর ইংরেজি : আল মাহমুদ

# বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে আপনি প্রায়ই বলতেন, চিত্রকল্পই কবিতা। ত্রিশের দশকের খ্যাতিমান এক কবি বলে গেছেন, উপমাই কবিতা। এ ব্যাপারে বিশদ বলবেন কি? — আমি কেন যে চিত্রকল্পকেই কবিতা বলেছিলাম, সেটা একটু ভেবে দেখতে হবে। আমার কবিতায় তো আমি এটা ত্যাগ করিনি। চিত্রকল্প তো প্রায় কবিতারই সমার্থক। কবিতায় একটা চিত্রকল্প লাগে। # আমরা জানি, কবিতা পড়তে গিয়ে ভালো লাগার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারপর আসে উপমা, চিত্রকল্প, উেপ্রক্ষা, প্রতীকের দক্ষ শৈল্পিক প্রয়োগের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি ছন্দের ব্যাপারটিও জরুরি, তাই নয় কি? — সবচেয়ে বড় কথা হলো ছন্দ। একজন কবিকে জানতে হয়—মিলটা কীভাবে সংঘটিত হয়। অনুপ্রাস জানতে হবে। এটা জানলেই তার মনে দারুণ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এটা না জানলে কিন্তু অনেক অসুবিধা। # দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় আপনার সৃজিত কবিতাগুচ্ছে বিধৃত হয়েছে সমকাল, বাংলাদেশের লোকজীবন, দেশ, সমাজ, জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য, অহং, ঐতিহ্য ইত্যাদি। সফল সাহিত্য সৃষ্টির প্রশ্নে এসবের প্রতিফলন অত্যন্ত জরুরি। এগুলো কেন জরুরি বলবেন কি? — তুমি নিজেই তো বললে জরুরি। জরুরি এজন্য যে, একটাকে বাদ দিলে খুঁত থেকে যায়। এই খুঁত ভরাট করার আর কে আছে, কিছু তো নেই। কবিতার জায়গাটা কবিতা দিয়েই ভরাট করা দরকার, অন্য কিছু দিয়ে হয় না। # উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানতে চাই। — এটা হলো—দার্শনিকরা যেটা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছে, সেটা ঘাড়ে তুলে নেয়া। # উত্তর আধুনিকতা বলতে পশ্চিমে আধুনিকতা-পরবর্তী কালটাকে বোঝানো হয়। কিন্তু ভারতে বা বাংলাদেশে এটাকে প্রাচীন ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া বোঝাচ্ছে—এ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন? — আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশটা প্রাচীন ঐতিহ্য ছাড়া ঘটেনি। কবিতা কিন্তু মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ কারণেই, যেখানে পায়ের তলায় মাটি আছে সেখানে সবসময় প্রাচীন ঐতিহ্য আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে তো থাকা যায় না। মানুষকে সামনের দিকে এগোতে হয়। পুরনো ঐতিহ্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, কিন্তু কবিতা হয়ে উঠতে হলে আধুনিকতা দরকার। # এবার একটু ম্যাজিক রিয়েলিজম সম্পর্কে আলাপ করতে চাই। রিয়েলিজম ও ড্রিমের মধ্যে সেতু তৈরি করাকেই আমরা ম্যাজিক রিয়েলিজম বলে বুঝি। এ নিয়ে লাতিন ও ক্যারিবিয়ান কথাশিল্পীরাই বেশি কাজ করে থাকেন। পরে এই জাদুবাস্তবতার ধারণা বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। কবিতায়ও এর প্রতিফলন ঘটে। আপনার কবিতায়ও আমরা এর লক্ষণ দেখছি। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতার বইতে এই বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই আছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন। — এটার মধ্যে যা বক্তব্য সেটা ঠিক খোলাসা করা যায় না। তবে এটুকু বলতে পারি—সবগুলো জটিলতার জট খুলে যায় যখন মিল বোঝে কবি—ছন্দের দোলায় যখন পৌঁছে। ছন্দ, গন্ধ এবং স্পর্শের যে আনন্দ; এটা একজন কবিকে সামনে ঠেলে দেয়। ভবিষ্যতের দিকে দারুণভাবে ঠেলে দেয়। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়। # আপনার কাব্য-সহযাত্রী কবি শামসুর রাহমান এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন—সেটাই কবিতা যা প্রথম পাঠে ভালো লাগে। এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী? — তিনি কী বলেছিলেন সেটা আমি বলতে পারব না। তবে প্রথম পাঠে অনেক কিছুই ভালো লাগে। এটা কি যুক্তিসঙ্গত কথা হলো? প্রথম পাঠে অনেক অকবিতাও ভালো লাগে, তাই না? প্রথম পাঠে আমার ভালো লাগে গদ্য। কারণ গদ্য আধুনিক। এটা তো বলা যায় না—আমার প্রথম পাঠে যেটা ভালো লাগে সেটাই কবিতা। এর সঙ্গে ঠিক আমি একমত হতে পারি না। # আপনি কি বলতে চাচ্ছেন—একটা কবিতা প্রথম পাঠে ভালো লাগল, কিন্তু আপনি যখন কয়েকবার পাঠ করলেন তখন মনে হলো—না, ভালো লাগার আসলে কারণ নেই। — হ্যাঁ, কোনো কারণ নেই দেখা যাচ্ছে। # আনন্দ ও বেদনা—কবিতার কাছে আপনি কোনটা বেশি পেয়েছেন? — আমার মনে হয়, আনন্দ-বেদনা—এই দুইটাই সমভাবে আমাকে অভিভূত করেছে। # একজন লেখকের বিকাশের জন্য সংঘ বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি? — কোনো কোনো ক্ষেত্রে আছে। কিন্তু দল বেঁধে কাব্য হয় না। # এই যে জাতীয় কবিতা পরিষদ হয়েছে, কেউ বলেন এটা এখন খুব স্তিমিত হয়ে আছে—এগুলো কি চূড়ান্ত বিচারে আমাদের সাহিত্যের কোনো উপকার করেছে? — কবিতার যে কোনো সংগঠন বা কবিতার জন্য যারা কাজ করে, তারা কিছু না কিছু কাজ তো করেই—এটুকু শুধু বলতে পারি। # মৃত্যুচিন্তা কি আপনাকে কখনও আচ্ছন্ন করে? এ অনুভূতিটা কেমন? — যেহেতু আমি জন্মেছি, মৃত্যু হবেই। এটা যখন আমি নিশ্চিতভাবে জানি, তখন মৃত্যুর ভয়টা হয়তো ঈষত্ কমে আছে—কিন্তু মৃত্যুর যে ভয়, বিস্ময়, মৃত্যুর যে একটা স্বাদ আছে এটা আমি কখনও গ্রহণ করিনি। এটা একবারই মানুষ গ্রহণ করে, যখন সে মরে যায়। ফিরে এসে আর কিছু বলতেও পারে না। # বিশ্ব সমাজে সমাজতন্ত্র যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা আপনাকে ব্যথিত করে কি? — সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা কিন্তু বলা যাবে না। আসলে সমাজতন্ত্রের কথা আজকাল আর কেউ বলে না। কারণ, পুঁজিবাদ এত প্রবল ও পরাক্রান্ত হয়েছে যে, সমাজতন্ত্রীরা মুখ খুলতে পারছে না। পুঁজিবাদ যতই বৃহদাকার ধারণ করুক—পুঁজিরও একটা পরিসমাপ্তি আছে। # আপনার রাজনৈতিক চিন্তায় আমরা ব্যাপক পরিবর্তন দেখি। বামধারা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় আপনি আস্থাশীল হয়েছেন সময়ের পরিক্রমায়। এই পরিবর্তনের অনিবার্যতা কী ছিল? আপনার সাহিত্যচিন্তা ও লেখালেখিতে এর কেমন প্রভাব পড়েছে বলে আপনি মনে করেন? — আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বাম ঘরানা, যতই বলে না কেন, মানুষের বিশেষ করে কবির স্বাধীনতা হরণ করে। # বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত লেখালেখিকে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই। — এ কথাটা আংশিক সত্য। কিন্তু আমি তো লিখেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছি—আয়-রোজগার যাই বলো, এই লেখা থেকেই। # আপনি তো অন্যান্য চাকরিও করেছেন। সেগুলো যদি করতে না হতো... — সেটা করেছি, কিন্তু লেখালেখি থেকেই আমাকে আয়-রোজগার বেশি করতে হয়েছে। তবে একটা কথা বলি—যেটা ঘটে না, সেটা ঘটবে না বলেই ঘটে না। এটা সত্য। # কবিরা সত্যদ্রষ্টা হয়ে থাকেন বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে বর্তমান কবিদের কবিতায় তার কেমন প্রতিফলন আছে? — সব কবি সত্যদ্রষ্টা কিনা জানি না। তবে আমি বলি—কবিরা দ্রষ্টা। সে দেখে। # আপনি এক সময় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা বৃত্তি কতটা উপকারী কিংবা অপকারী বলে আপনার মনে হয়েছে? — এটা নিজের ওপর নির্ভর করে। আমি সাংবাদিকতা করেছি। কেন করেছি? আমার পেটের জন্য করেছি। বেঁচে থাকার জন্য করেছি। সেটাও প্রয়োজন ছিল। # কবিতার কাছে আপনার ঋণ কতখানি? — যা কিছু নিয়েছি, কাব্যের কাছ থেকেই নিয়েছি। তবে দিয়েছিও, শোধ করার চেষ্টাও আমি করেছি। # কেউ কেউ বলে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে শক্তিমান লেখক আর আসছেন না। আপনি কি এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত? — আমি ঠিক একমত নই। তবে সব সময়ই দেখা যায় যে, প্রকৃত লেখক যারা, তারা বেশ একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে আসেন, প্রতিদিন তো আর আসেন না। # আপনার প্রথম প্রেমের অনুভূতি, রোমাঞ্চ—নারী প্রেম অর্থে, এ সম্পর্কে কিছু বলবেন কি? — আমারও এমন একটা মুহূর্ত এসেছিল। কৈশোর উত্তীর্ণ সময় যেটা, যেটাকে আমরা যৌবন বলি, তার প্রারম্ভে। এ সম্পর্কে আর কিছু বলার নেই, বলা উচিতও নয়। # কবিদের মধ্যে ক্ষুদ্র দলাদলির ব্যাপারটি কি আপনাকে পীড়িত করে? একজন খাঁটি কবি দলভুক্ত না হলে ন্যূনতম স্বীকৃতিও পান না। এ ব্যাপারে কী বলবেন আপনি? — এটা আমি ঠিক মানি না, কারণ কবিতা একটি ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। কবিতা নীরবে লিখতে হয় এবং কবি একা, কবি নীরব সব সময়। # কিন্তু দল না করলে পুরস্কার পাওয়া যায় না। বাংলা একাডেমী পুরস্কার নিয়েও এটা হয়ে থাকে। — এগুলো বাস্তবতা। এগুলো আমি অস্বীকার করে চলে এসেছি। # ইদানীংকালে আপনার দিনগুলো কেমন করে কাটছে? — আমি তো চোখে-টোখে দেখি না। দৃষ্টি তো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মোটামুটি বসে থাকি। পড়তে খুব ইচ্ছা করে। আমার পড়ে শোনানোর লোকও আছে। নাতি-নাতনিরা আছে। তারা জরুরি বিষয় যেটা সেটা পড়ে শোনায়। পত্রিকা শোনায়। আমি মাঝে মাঝে গান শুনতে ভালোবাসি। # আপনার প্রিয় শিল্পী কে? প্রিয় গান সম্পর্কে বলুন। — আমি তো এদেশের শ্রেষ্ঠ যারা গায়ক-গায়িকা, তাদের সবারই গান শুনি। # আপনি তো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখেছেনও। শিল্পকলা একাডেমী থেকে আপনার বইও হয়েছে। — আছে। আব্বাসউদ্দীনকে নিয়েও আমি একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছি। # আপনার প্রিয় গান কোনটা—রবীন্দ্র, নজরুল? — ক্লাসিক্যাল মিউজিক আমার প্রিয়। এছাড়া আমার একটা স্বতন্ত্র পড়াশোনা ছিল পশ্চিমা মিউজিকের ওপর। এটা খুবই আমার কাছে লেগেছিল। আমি এদেশীয় সঙ্গীত বুঝতে পেরেছি। যাকে বলে পশ্চিমা সঙ্গীত, সেটারও ধ্বনি তরঙ্গ আমি অনুভব করতে পারি। এর ওপর আমার কিছু বক্তৃতাও ছিল। আমি মাঝে মাঝে এ সম্পর্কে বলতাম। আমি প্রায়ই একটা কথা বলে থাকি—যদি আমি কবি না হতাম, তাহলে আমি অবশ্যই সঙ্গীতজ্ঞ হতাম

বাংলাভাষা বাংলাদেশেরই আত্মা, কলকাতায় সব হিন্দি আর ইংরেজি : আল মাহমুদ

# দেশে এবং বিদেশে আপনার প্রিয় লেখক কারা? — অনেক নামই তাহলে বলতে হয়। আমাদের দেশে আমার প্রিয় লেখক কাকে বলব—সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একজন, রবীন্দ্রনাথ... # রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তো আপনার অনেক লেখা আছে— গদ্য, পদ্য... — আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিশাল ভাণ্ডার। সেখান থেকে অনেক কিছু নেয়ার আছে। আর নজরুলকে আমি অনেক ভালোবাসি। তার কারণ হলো—তিনি নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন, বিদ্রোহ করেছিলেন এবং একটিমাত্র কবিতা তার আছে—‘বল বীর/ চির উন্নত মম শির’—যার সমতুল্য কাব্য বাংলা ভাষায় আর নেই। # জীবনানন্দ দাশকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? — জীবনানন্দ তো নির্জনতার কবি। তাঁর একটা কবিতায় আছে—উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে—এটাই জীবনানন্দ সম্পর্কে আমি বলি। # সাম্প্রতিককালে কী লিখছেন? — কলাম-টলাম তো লিখছি। দু’একটা কবিতা হয়তো লিখছি। আরও কিছু লিখতে পারলে হয়তো ভালো হতো। আমার তো বয়স হয়ে গেছে আসলে আশি। এ বয়সে মানুষ আর লেখে না, ছেড়ে দেয়, কিন্তু আমি তো এখনও ছাড়িনি। # বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থা, এটা নিয়ে কি আপনি আশাবাদী? দেশটা কি সত্যিকার একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপনীত হবে? — আমি অবশ্য আমাদের জনগণকে অধিক মূল্য দান করি। আমি শুধু বলব যে, আমাদের জনগণ নির্বোধ নয়। তারা সবই বুঝতে পারে। # আপনার প্রিয় সুগন্ধি কী? আপনি তো সুগন্ধি ভালোবাসেন। আপনার গল্পও আছে—সৌরভের কাছে পরাজিত। — আতর আমার প্রিয় সুগন্ধি। সবচেয়ে ভালো লাগে গোলাপি আতর। অসাধারণ। মানুষ আসল গোলাপি আতর পায় না। কিন্তু আসল গোলাপি আতর এক ধরনের পানির মধ্যে ভেসে ওঠা তেলের মতো। খুবই মধুর। একদিন লাগালে দু’তিন দিন থাকে। # আপনার সংগ্রহে আছে? — ছিল, এখন আর নেই। # আপনার প্রিয় খাবার কী? — আমার প্রিয় খাবার সাধারণত কোর্মা-পোলাও। এখনও এটা আমি ভালোবাসি, খেতেও পারি। # আপনি একটা কথা বলেছেন, সমাজতন্ত্রের কথা এখন আর কেউ বলে না কারণ সাম্রাজ্যবাদের পরাক্রম বেড়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে যে আরব বিশ্বে ইসলামী গণজাগরণের ঢেউ উঠেছে, এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন? — এটা আমি একবার বলেছিলাম কিন্তু। একটা বিষয় আসছে, পৃথিবীতে যেটা সম্পূর্ণ নতুন এবং তার কোনো কামান-বন্দুক নেই। সে অস্ত্রশূন্য হাতে একটি পুস্তক নিয়ে আসছে—তার নাম হচ্ছে ইসলাম। এর হাতে হলো পবিত্র কোরআন শরীফ। এটা পুঁজিবাদের সঙ্গেও মিলে না, সমাজতন্ত্রের সঙ্গেও না। এটা হলো আধুনিক জগতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ব্যাপার। এটা ব্যবসাকে হালাল করে, সুদকে হারাম করে দেয়। যে সমাজে সুদ আছে সে সমাজে সুখ নেই। সুদের সঙ্গে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই। সুদ তো হারাম করে দিয়েছে। আমার মতে যারা সুদ খায়—আমাদের বইপত্রে আছে যে, যারা সুদ খায় তারা উঠে দাঁড়াতে পারে না। # লেখালেখির ব্যাপারে আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে? — এক সময় তো আমার স্ত্রীই ছিলেন এবং আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। এখন এই যে নিঃসঙ্গ আমি, এই ক্ষতি তো আর পূরণ হবে না, হয়ও না। # এক সময় তো কবি হওয়ার জন্য লেখালেখি শুরু করেছেন। এখন কেন লিখছেন—এটা কি কোনো দায়বোধ? — আমরা তো কোথাও পৌঁছতে চাই। ঠিক কোথায় পৌঁছতে চাই, সেটা আমি এখন বলছি না। তবে একটা কথা হচ্ছে—ইসলাম আসছে। ভবিষ্যত্ হলো ইসলামের হাতে। # এখন যদি আপনার হাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হয়, আপনার প্রথম কাজ কী হবে? — প্রথম কথা হলো—এ দায়িত্ব আমি নিতে চাই না। # আপনি চান না, কিন্তু যদি কোনোভাবে এমনটা হয়? — তাহলে তো প্রথমে জনগণের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এটাই আমি করব। # আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানাই সময় দেয়ার জন্য। ‘কবি ছাড়া আমি আর কিছুই নই’— এ কথা কবি আল মাহমুদের। যদিও তিনি ছোটগল্প, উপন্যাস, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, সাংবাদিক হিসেবে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা, তথাপি তাঁর কবি পরিচয়ই তাকে বর্ণময় ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত করেছে। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর সমৃদ্ধিসাধনে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন অগুনতি পাঠকের কাছ থেকে। হাজার বছরের বাংলা কাব্যধারায় অবগাহন করে আল মাহমুদ বাংলাভাষী পাঠককে উপহার দিয়েছেন প্রায় তিনডজন কাব্যগ্রন্থ। কবিতায় তিনি বাঁকের পর বাঁক বদল করে ক্রমাগত ছুটেছেন সমুদ্রের দিকে। তাঁর অতৃপ্ত কবিপ্রাণ এখনও ধাবমান। বয়স আশির কাছাকাছি হলেও প্রাণে তার তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। কবিতায় তিনি ধারণ করেছেন এই বাংলাদেশের আত্মা। ‘আজানের শব্দে কুপির শিখার পাশে অবগুণ্ঠিত কিষাণীর মুখ’ তিনি দেখেছেন। গ্রাম বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যে জারিত লোকজজীবনের অনুষঙ্গ তার কবিতাকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা, বিশেষ মহিমা। লোক লোকান্তর, সোনালি কাবিন, কালের কলস, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহরান্তের পাশফেরা, বখতিয়ারের ঘোড়া, একচক্ষু হরিণ, আমি দূরগামী, দোয়েল ও দয়িতা, দ্বিতীয় ভাঙন, বিরামপুরের যাত্রী, উড়ালকাব্য, বরুদগন্ধী মানুষের দেশ কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, ডাহুকী, পুরুষ সুন্দর, যে পারো ভুলিয়ে দাও, কবি ও কোলাহল, আগুনের মেয়ে, চেহারার চতুরঙ্গ তার আলোচিত উপন্যাস। ছোট্টগল্প লিখেও চমকে দিয়েছেন তিনি পাঠকদের। পানকৌড়ির রক্ত, গন্ধবণিক, সৌরভের কাছে পরাজিত, ময়ূরীর মুখ, নদীর সতীন ইত্যাদি তার ছোট্টগল্প গ্রন্থ। যেভাবে বেড়ে উঠি, বিচূর্ণ আয়নার কবির মুখ—তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন বেশ ক’টি গ্রন্থ। লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী, সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম বিষয়ক এবং আত্মগত অসংখ্য প্রবন্ধ ও কলাম। গত ১১ জুলাই ছিল এই মহান কবির জন্মদিন। এ উপলক্ষে গত ১০ জুলাই সন্ধ্যায় কবির বাসায় হাজির হয়েছিলাম আমরা। মগবাজারের আয়শা-গোমতী ভিলায় কবির ফ্ল্যাটে যখন আমরা পৌঁছি তখন তিনি একটি পত্রিকার প্রতিনিধিকে সাক্ষাত্কার দিচ্ছিলেন। আমাদের ডাকলেন তাঁর শোয়ার ঘরে। কবিকে মনে হলো বেশ চঞ্চল ও উত্ফুল্ল। সাক্ষাত্কার দিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। কথা বললেন বিভিন্ন বিষয়ে। তার এই সাক্ষাত্কারটি এখানে পত্রস্থ হলো।

Tuesday, 3 July 2012

আমি দিনকে দেখেছি ঠিক রাতের কাছে

আমি দিনকে দেখেছি ঠিক রাতের কাছে তার সব ভালোবাসা শোমাড়পোণ করে দেয় আর সূর্য ঠিক তার কাছে এসে বিদায় জানায়