ভারতে হিন্দু মৌলবাদ কুিসতভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বয়স যখন ৭০, সে বছর ২০০৩ সালে তিনি এসেছিলেন
বাংলাদেশে। গিয়েছিলেন মাদারীপুরে, জন্মভিটায়। তখন নেয়া সাক্ষাত্কারের
পুনর্মুদ্রণ।
- বি. স.)
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ভারতে হিন্দু মৌলবাদ কুিসতভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে। আমৃত্যু এর বিরুদ্ধে বলে যাব। একে আক্রমণ করব। মৌলবাদ দমনের জন্য যতটা চেষ্টা দরকার, ততটা হয় না। মুসলমানদের মধ্যেও মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা আছে। ও বিষয়ে আমি কিছু বলব না। আমি চাইব, মুসলমান লেখকরা তার বিরুদ্ধে বলুক। আমি নিজে বলে যাব হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে।
নিজের পৈতৃক ভিটা, জন্মগ্রাম মাদারীপুরের মাইজপাড়া ও আমগ্রাম দেখার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সস্ত্রীক বাংলাদেশে আসেন গত ২৩ এপ্রিল ২০০৩ সালে। কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগে নয়াপল্টনের একটি হোটেলে ২ মে বৃষ্টিমুখর এক সকালে তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতার সুযোগ হয়। তাঁর সঙ্গে বহু বিষয়ে কথা, মতবিনিময় হলো। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আমি আগেও বলেছি এখনও বলি, ভবিষ্যতে ঢাকাই হবে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী। কারণ বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ও অন্যান্য কারণে প্রকাশনার মূল কেন্দ্রই হবে ঢাকা। এক সময় কলকাতা ছিল এই কেন্দ্র। শিক্ষার জন্য, চাকরির জন্য কলকাতায় ছুটতে হতো সবাইকে। এখন হলো তার উল্টা স্রোত। প্রকাশনার জগত্ ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও ছড়িয়ে যাবে। প্রবাসী বাংলাভাষী লেখকরাও চাইবেন, ঢাকা থেকেই তাদের লেখা বই বের হোক।
সামপ্রতিক বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে শঙ্কিত, উত্কণ্ঠিত। বললেন, ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ আক্রমণ একটা ঘৃণ্য ব্যাপার। আমেরিকা বিশ্বজনমত, রাষ্ট্রসংঘকে গ্রাহ্য না করে যেটা করেছে, তা তিন শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে করেছে। তখন ছিল জোর যার মুল্লুক তার। এভাবে জয়ী হওয়া যায় না। আমেরিকাকে হারতেই হবে। হয়তো সময় লাগবে এতে। বিশ্বব্যাপী এই আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। নীতিগত প্রতিবাদ, সশস্ত্র নয়। খোদ আমেরিকায় হয়েছে, ইংল্যান্ডেও। জর্জ বুশ কোনো দিনই শান্তি পাবে না। ইতিহাস বুশকে আর্বজনায় নিক্ষেপ করবে।
বাংলাদেশের জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, হুমায়ূনকে তার ঔদার্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি এ প্রস্তাবের কথা পড়ে অভিভূত হয়েছি। আমাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিলে তো বেশ ভালোই হয়, তখন আরও বেশি বেশি এ দেশে আসতে পারব। ঘরবাড়ি তুলে হয়তো বাস করব না এখানে, অভ্যেসটভ্যেস অনেকটা পাল্টে গেছে তো! নাগরিকত্ব যদি হয়, তো সেটা মাথায় করে রাখব।
ভারতীয় উপমহাদেশে সামপ্রদায়িকতা, মৌলবাদ, উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ও বিকাশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমাকে অত্যন্ত পীড়া দেয়, বিষণ্ন করে। ছোটবেলায় ভাবতাম, ২৫-৩০ বছর পর নতুন প্রজন্মের কেউ হয়তো এসব গ্রাহ্যই করবে না। কিন্তু তা হয়নি। কমে যাওয়ার বদলে ধর্মান্ধতা বরং বেড়েছে। এটি মনুষ্যসমাজকে পেছনে নিয়ে যায়। মানুষ যুক্তি হারিয়ে ফেলছে। সভ্যতাকে আমরা পিছিয়ে দিচ্ছি, এ কথাই মনে হয় বারবার। হয়তো আমার জীবদ্দশায় এর থেকে উত্তরণ দেখব না, কিন্তু আশা রেখে যেতে পারি যে, পরিস্থিতি একসময় বদলাবে। এ ব্যাপারে শুধু আশাই করতে পারি। আমি নিজে পরজন্ম, ভূত-ভগবান আর হোমিওপ্যাথিতে কোনো বিশ্বাস করি না।
মাদারীপুরের জন্মগ্রাম তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন ১০ বছর বয়সে, সেটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। তারপর এবার গেলেন সেখানে। এতকাল পর জন্মভূমিতে গিয়ে কেমন লেগেছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, অনুভূতিটা মিশ্র। নিজের গ্রামের স্মৃতি আমার বেশ ভালোই মনে আছে। এবার গিয়ে কখনও মনে হয়েছে, ফিরে গিয়েছি বাল্যকালে। আবার কখনও মনে হয়েছে, বয়স্ক চোখে পরিবর্তন দেখছি। সব মিলিয়ে ভালো লাগার অনুভূতিটাই প্রধান। আমার কোনো আত্মীয়স্বজন এখন সেখানে নেই। এবার গিয়ে দেখলাম এলাহী আয়োজন। দেখে তো আমি ঘাবড়ে গিয়েছি। মনে হয়েছে, ওখানে অনেক আত্মীয়স্বজন আমার। তারা থাকতে বলেছেন, খেতে বলেছেন। তারা যে আন্তরিক ব্যবহার করেছেন, তাতে আমি অভিভূত, মুগ্ধ।
এবার মাদারীপুরের গ্রামে গিয়ে বড় ধরনের কী পরিবর্তন আপনার চোখে পড়ল? জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, অনেক বছর বাদে গেলাম তো! প্রায় অর্ধশতাব্দী। প্রধান পরিবর্তন হলো পরিবহন। আমরা জলপথে যেতাম, স্টিমারের পর নৌকায়। এখন সব রাস্তা হয়ে গেছে, সেতুও। দূরত্ব কমে গেছে। ছোটবেলায় মনে হতো, যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, পথ বুঝি আর শেষ হবে না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, বিশ্বায়ন মানুষকে সঙ্কুচিত করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আগে অনেক দেশে যেতে ভিসা লাগত না। এখন কত কড়াকড়ি, নানারকম কাঁটাতারের বেড়া। এগুলো কী বিশ্বায়নের নমুনা? ভারত ও বাংলাদেশ কি আমেরিকা, কানাডার মতো প্রতিবেশী দেশ হতে পারত না? হয়নি। আমি যদি ভিসা ছাড়া আমার জন্মস্থানে আসতে পারতাম, কত খুশিই না হতাম।
এমন কোনো স্বপ্ন কি আপনার আছে, আজও যা পূর্ণ হয়নি? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আছে। তা হলো, অন্তত একটা ভালো লেখা। এ পর্যন্ত যা লিখেছি, তার কোনোটাই ভালো হয়নি। জানতে চাই, আপনার প্রকাশিত গ্রন্থ এখন পর্যন্ত কত? মৃদুু হেসে স্বভাবরসিক সুনীল বলেন, তিন শ’র বেশি হবে শুনেছি। শুনেছি বলছি, কারণ আমি নিজে জানি না। আমার স্মৃতিকথা ‘অর্ধেক জীবন’ এ বাংলাদেশের প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে।
‘ছেলেবেলায় নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম’
গত ২ মে ২০০৩ বৃষ্টিমুখর সকালবেলায় কথা হচ্ছিল সমকালীন বাংলা সাহিত্যের পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক, কবি, কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নয়াপল্টনের হোটেল অরচার্ড প্লাজায় উঠেছিলেন তিনি সে যাত্রা। বাংলাদেশে সস্ত্রীক এসেছিলেন মাদারীপুরে নিজের গ্রাম দেখতে। দেখার পর এসেছিলেন ঢাকায়। ওই সকালবেলাতেই তার বেশ কয়েকজন ভক্ত, অনুরাগী ভিড় জমিয়েছিলেন হোটেলে। তাদের সঙ্গ দিতে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। সে জন্যে বিস্তারিত আলাপচারিতার সুযোগ ঘটেনি। ফাঁকে ফাঁকে যেটুকুই কথা হয়েছে, তা তুলে ধরা হলো টুকরো ধরনের এই সাক্ষাত্কারে। তাঁর বয়স ৭০ পূর্ণ হলো এ বছর, অর্থাত্ ২০০৩ সালে।
প্রশ্ন : আপনার চোখে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কবিতার মৌলিক পার্থক্যগুলো কী?
উত্তর : বাংলাদেশে কবিতা নিয়ে উত্সাহ-উদ্দীপনা বেশি। বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটেছে। কবিতায় সমসাময়িক ঘটনার ছাপটা বেশি। আর পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ঝোঁকটা বেশি। বাংলাদেশের অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের কোন কোন কবির কবিতা আপনার ভালো লাগে?
উত্তর : অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে। দু-চারজনের নাম বাদ পড়ে গেলে সেটা ঠিক হবে না। তারা দুঃখ পাবেন। সেজন্য নির্দিষ্ট করে কারও নাম উল্লেখ না করাই ভালো। আমি নিয়মিত বাংলাদেশের কবিতা পড়ি। খোঁজ রাখি।
প্রশ্ন : আমরা পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের লেখা সম্পর্কে যতটা জানি, খোঁজখবর রাখি, তার বিপরীতে কিন্তু ওরা এ ব্যাপারে আশ্চর্যরকম উদাসীন। দুই দেশের মধ্যে বই বাণিজ্যেও বড় ধরনের অসমতা আছে। এ প্রসঙ্গে আপনি কী বলবেন?
উত্তর : এই অভিযোগের খানিকটা সত্য। তবে ব্যবধান আস্তে আস্তে কমে আসছে। এই দ্যাখো না, সত্তর দশকের কবিদের দল উত্সব করেছে কলকাতায়, ঢাকায়। সেটার নাম সৌহার্দ্য কবিতা উত্সব। দুই দেশের আশির দশকের কবিরাও উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রশ্ন : আপনারা ষাটের দশকের কবিরা সে রকম কোনো উত্সবের উদ্যোগ আয়োজন করছেন না কেন?
উত্তর : ষাটের দশকের কবিরা বুড়ো হয়ে গেছে হে! উদ্যম কম তাদের মধ্যে।
প্রশ্ন : টেলিভিশন সাহিত্যের কতটা শত্রু, কতটা মিত্র? আপনার কী মনে হয় বলুন না!
উত্তর : টেলিভিশন একটা অবধারিত ব্যাপার। একে ফেরানোর উপায় নেই কোনো। কমিকস একসময় তোলপাড় তুলেছিল। বাবা-মা, অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাচ্চারা কমিকস পড়ত। টেলিভিশনের ব্যাপারটাও অনেকটা সেই রকমই। এটাকে সবার মেনে নিতে হবে। আর এর মধ্যেই এসে গেল কম্পিউটার। এ থেকেও মুক্তি নেই আমাদের। আসলে সাহিত্যকে এসবের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে।
প্রশ্ন : ক্রমাগত ব্যাপক কম্পিউটারায়ন কী বইয়ের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে?
উত্তর : আগে আমাকে বলো, ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোয় শতকরা কতজনের কম্পিউটার আছে? বড়োজোর, শতকরা তিনজনের বাড়িতে। বেশি বেশি কম্পিউটার থাকলে না হয় এ প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হতো। কম্পিউটারের ব্যাপক বিস্তারের ফলে কী হবে না হবে, এটা হলো পশ্চিমী জগতের চিন্তা। ভবিষ্যতে যদি দেশ সফল হয়, সবাই খেতে-পরতে পায়, দু’টি করে মোটরগাড়ি চড়তে পারে, তখন এ ভীতির প্রশ্ন আসবে। তার আগে নয়।
প্রশ্ন : আপনি কবি ও কথাশিল্পী। এই দুই সত্তার মধ্যে কি কোনো দ্বন্দ্ব আছে?
উত্তর : ঠিক জানি না। গল্প-উপন্যাস লিখতে পরিশ্রম বেশি হয়। অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও লিখতে হয় আমাকে। গদ্য, ইচ্ছে না থাকলেও লেখা যায়। কবিতার ব্যাপারটি ভিন্ন। যখন ইচ্ছে হলো, লিখলাম। কবিতা লিখতেই খুব বেশি আনন্দ পাই। আর গদ্য লেখা শেষ হলে স্বস্তি।
প্রশ্ন : পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত্ কী? সেখানে কী কোনোদিন ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন হবে?
উত্তর : হলেও হতে পারে। আমাদের দেশ ভারতে শিক্ষার বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নয়। প্রত্যেক রাজ্যে শিক্ষার ব্যাপারটি তাদের নিজস্ব নীতিতে চলে।
প্রশ্ন : ছেলেবেলায় কী ভাবতেন, বড় হয়ে কী হবেন?
উত্তর : ছেলেবেলায় লেখক হবো ভাবিনি। নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। নাবিক হওয়ার মধ্যে রোমান্টিক একটা ব্যাপার আছে। আমাদের ছোটবেলায় অনেক জাহাজ চলত। নাবিকদের সে জায়গা কিন্তু এখন পাইলটরা নিয়ে নিয়েছে।
প্রশ্ন : কলকাতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যত্ কী?
উত্তর : বাংলা ভাষা অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। নতুন প্রজন্ম বাংলা শিখতে চাইছে না। পড়তে চাইছে না। আমরা এ অবস্থা পাল্টাতে আন্দোলন শুরু করেছি। তাতে আমরা দাবি করছি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে চাকরি দেবে, তাতে বাংলা জানাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আরও বলছি, বাংলায় চিঠি দিলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বাংলায়ই তার উত্তর দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এটা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গত পয়লা বৈশাখে বলেছেন, সরকারি কাজ সব বাংলায় চলবে।
- বি. স.)
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ভারতে হিন্দু মৌলবাদ কুিসতভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে। আমৃত্যু এর বিরুদ্ধে বলে যাব। একে আক্রমণ করব। মৌলবাদ দমনের জন্য যতটা চেষ্টা দরকার, ততটা হয় না। মুসলমানদের মধ্যেও মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা আছে। ও বিষয়ে আমি কিছু বলব না। আমি চাইব, মুসলমান লেখকরা তার বিরুদ্ধে বলুক। আমি নিজে বলে যাব হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে।
নিজের পৈতৃক ভিটা, জন্মগ্রাম মাদারীপুরের মাইজপাড়া ও আমগ্রাম দেখার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সস্ত্রীক বাংলাদেশে আসেন গত ২৩ এপ্রিল ২০০৩ সালে। কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগে নয়াপল্টনের একটি হোটেলে ২ মে বৃষ্টিমুখর এক সকালে তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতার সুযোগ হয়। তাঁর সঙ্গে বহু বিষয়ে কথা, মতবিনিময় হলো। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আমি আগেও বলেছি এখনও বলি, ভবিষ্যতে ঢাকাই হবে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী। কারণ বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ও অন্যান্য কারণে প্রকাশনার মূল কেন্দ্রই হবে ঢাকা। এক সময় কলকাতা ছিল এই কেন্দ্র। শিক্ষার জন্য, চাকরির জন্য কলকাতায় ছুটতে হতো সবাইকে। এখন হলো তার উল্টা স্রোত। প্রকাশনার জগত্ ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও ছড়িয়ে যাবে। প্রবাসী বাংলাভাষী লেখকরাও চাইবেন, ঢাকা থেকেই তাদের লেখা বই বের হোক।
সামপ্রতিক বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে শঙ্কিত, উত্কণ্ঠিত। বললেন, ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ আক্রমণ একটা ঘৃণ্য ব্যাপার। আমেরিকা বিশ্বজনমত, রাষ্ট্রসংঘকে গ্রাহ্য না করে যেটা করেছে, তা তিন শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে করেছে। তখন ছিল জোর যার মুল্লুক তার। এভাবে জয়ী হওয়া যায় না। আমেরিকাকে হারতেই হবে। হয়তো সময় লাগবে এতে। বিশ্বব্যাপী এই আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। নীতিগত প্রতিবাদ, সশস্ত্র নয়। খোদ আমেরিকায় হয়েছে, ইংল্যান্ডেও। জর্জ বুশ কোনো দিনই শান্তি পাবে না। ইতিহাস বুশকে আর্বজনায় নিক্ষেপ করবে।
বাংলাদেশের জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, হুমায়ূনকে তার ঔদার্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি এ প্রস্তাবের কথা পড়ে অভিভূত হয়েছি। আমাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিলে তো বেশ ভালোই হয়, তখন আরও বেশি বেশি এ দেশে আসতে পারব। ঘরবাড়ি তুলে হয়তো বাস করব না এখানে, অভ্যেসটভ্যেস অনেকটা পাল্টে গেছে তো! নাগরিকত্ব যদি হয়, তো সেটা মাথায় করে রাখব।
ভারতীয় উপমহাদেশে সামপ্রদায়িকতা, মৌলবাদ, উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ও বিকাশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমাকে অত্যন্ত পীড়া দেয়, বিষণ্ন করে। ছোটবেলায় ভাবতাম, ২৫-৩০ বছর পর নতুন প্রজন্মের কেউ হয়তো এসব গ্রাহ্যই করবে না। কিন্তু তা হয়নি। কমে যাওয়ার বদলে ধর্মান্ধতা বরং বেড়েছে। এটি মনুষ্যসমাজকে পেছনে নিয়ে যায়। মানুষ যুক্তি হারিয়ে ফেলছে। সভ্যতাকে আমরা পিছিয়ে দিচ্ছি, এ কথাই মনে হয় বারবার। হয়তো আমার জীবদ্দশায় এর থেকে উত্তরণ দেখব না, কিন্তু আশা রেখে যেতে পারি যে, পরিস্থিতি একসময় বদলাবে। এ ব্যাপারে শুধু আশাই করতে পারি। আমি নিজে পরজন্ম, ভূত-ভগবান আর হোমিওপ্যাথিতে কোনো বিশ্বাস করি না।
মাদারীপুরের জন্মগ্রাম তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন ১০ বছর বয়সে, সেটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। তারপর এবার গেলেন সেখানে। এতকাল পর জন্মভূমিতে গিয়ে কেমন লেগেছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, অনুভূতিটা মিশ্র। নিজের গ্রামের স্মৃতি আমার বেশ ভালোই মনে আছে। এবার গিয়ে কখনও মনে হয়েছে, ফিরে গিয়েছি বাল্যকালে। আবার কখনও মনে হয়েছে, বয়স্ক চোখে পরিবর্তন দেখছি। সব মিলিয়ে ভালো লাগার অনুভূতিটাই প্রধান। আমার কোনো আত্মীয়স্বজন এখন সেখানে নেই। এবার গিয়ে দেখলাম এলাহী আয়োজন। দেখে তো আমি ঘাবড়ে গিয়েছি। মনে হয়েছে, ওখানে অনেক আত্মীয়স্বজন আমার। তারা থাকতে বলেছেন, খেতে বলেছেন। তারা যে আন্তরিক ব্যবহার করেছেন, তাতে আমি অভিভূত, মুগ্ধ।
এবার মাদারীপুরের গ্রামে গিয়ে বড় ধরনের কী পরিবর্তন আপনার চোখে পড়ল? জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, অনেক বছর বাদে গেলাম তো! প্রায় অর্ধশতাব্দী। প্রধান পরিবর্তন হলো পরিবহন। আমরা জলপথে যেতাম, স্টিমারের পর নৌকায়। এখন সব রাস্তা হয়ে গেছে, সেতুও। দূরত্ব কমে গেছে। ছোটবেলায় মনে হতো, যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, পথ বুঝি আর শেষ হবে না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, বিশ্বায়ন মানুষকে সঙ্কুচিত করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আগে অনেক দেশে যেতে ভিসা লাগত না। এখন কত কড়াকড়ি, নানারকম কাঁটাতারের বেড়া। এগুলো কী বিশ্বায়নের নমুনা? ভারত ও বাংলাদেশ কি আমেরিকা, কানাডার মতো প্রতিবেশী দেশ হতে পারত না? হয়নি। আমি যদি ভিসা ছাড়া আমার জন্মস্থানে আসতে পারতাম, কত খুশিই না হতাম।
এমন কোনো স্বপ্ন কি আপনার আছে, আজও যা পূর্ণ হয়নি? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আছে। তা হলো, অন্তত একটা ভালো লেখা। এ পর্যন্ত যা লিখেছি, তার কোনোটাই ভালো হয়নি। জানতে চাই, আপনার প্রকাশিত গ্রন্থ এখন পর্যন্ত কত? মৃদুু হেসে স্বভাবরসিক সুনীল বলেন, তিন শ’র বেশি হবে শুনেছি। শুনেছি বলছি, কারণ আমি নিজে জানি না। আমার স্মৃতিকথা ‘অর্ধেক জীবন’ এ বাংলাদেশের প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে।
‘ছেলেবেলায় নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম’
গত ২ মে ২০০৩ বৃষ্টিমুখর সকালবেলায় কথা হচ্ছিল সমকালীন বাংলা সাহিত্যের পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক, কবি, কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নয়াপল্টনের হোটেল অরচার্ড প্লাজায় উঠেছিলেন তিনি সে যাত্রা। বাংলাদেশে সস্ত্রীক এসেছিলেন মাদারীপুরে নিজের গ্রাম দেখতে। দেখার পর এসেছিলেন ঢাকায়। ওই সকালবেলাতেই তার বেশ কয়েকজন ভক্ত, অনুরাগী ভিড় জমিয়েছিলেন হোটেলে। তাদের সঙ্গ দিতে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। সে জন্যে বিস্তারিত আলাপচারিতার সুযোগ ঘটেনি। ফাঁকে ফাঁকে যেটুকুই কথা হয়েছে, তা তুলে ধরা হলো টুকরো ধরনের এই সাক্ষাত্কারে। তাঁর বয়স ৭০ পূর্ণ হলো এ বছর, অর্থাত্ ২০০৩ সালে।
প্রশ্ন : আপনার চোখে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কবিতার মৌলিক পার্থক্যগুলো কী?
উত্তর : বাংলাদেশে কবিতা নিয়ে উত্সাহ-উদ্দীপনা বেশি। বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটেছে। কবিতায় সমসাময়িক ঘটনার ছাপটা বেশি। আর পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ঝোঁকটা বেশি। বাংলাদেশের অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের কোন কোন কবির কবিতা আপনার ভালো লাগে?
উত্তর : অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে। দু-চারজনের নাম বাদ পড়ে গেলে সেটা ঠিক হবে না। তারা দুঃখ পাবেন। সেজন্য নির্দিষ্ট করে কারও নাম উল্লেখ না করাই ভালো। আমি নিয়মিত বাংলাদেশের কবিতা পড়ি। খোঁজ রাখি।
প্রশ্ন : আমরা পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের লেখা সম্পর্কে যতটা জানি, খোঁজখবর রাখি, তার বিপরীতে কিন্তু ওরা এ ব্যাপারে আশ্চর্যরকম উদাসীন। দুই দেশের মধ্যে বই বাণিজ্যেও বড় ধরনের অসমতা আছে। এ প্রসঙ্গে আপনি কী বলবেন?
উত্তর : এই অভিযোগের খানিকটা সত্য। তবে ব্যবধান আস্তে আস্তে কমে আসছে। এই দ্যাখো না, সত্তর দশকের কবিদের দল উত্সব করেছে কলকাতায়, ঢাকায়। সেটার নাম সৌহার্দ্য কবিতা উত্সব। দুই দেশের আশির দশকের কবিরাও উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রশ্ন : আপনারা ষাটের দশকের কবিরা সে রকম কোনো উত্সবের উদ্যোগ আয়োজন করছেন না কেন?
উত্তর : ষাটের দশকের কবিরা বুড়ো হয়ে গেছে হে! উদ্যম কম তাদের মধ্যে।
প্রশ্ন : টেলিভিশন সাহিত্যের কতটা শত্রু, কতটা মিত্র? আপনার কী মনে হয় বলুন না!
উত্তর : টেলিভিশন একটা অবধারিত ব্যাপার। একে ফেরানোর উপায় নেই কোনো। কমিকস একসময় তোলপাড় তুলেছিল। বাবা-মা, অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাচ্চারা কমিকস পড়ত। টেলিভিশনের ব্যাপারটাও অনেকটা সেই রকমই। এটাকে সবার মেনে নিতে হবে। আর এর মধ্যেই এসে গেল কম্পিউটার। এ থেকেও মুক্তি নেই আমাদের। আসলে সাহিত্যকে এসবের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে।
প্রশ্ন : ক্রমাগত ব্যাপক কম্পিউটারায়ন কী বইয়ের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে?
উত্তর : আগে আমাকে বলো, ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোয় শতকরা কতজনের কম্পিউটার আছে? বড়োজোর, শতকরা তিনজনের বাড়িতে। বেশি বেশি কম্পিউটার থাকলে না হয় এ প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হতো। কম্পিউটারের ব্যাপক বিস্তারের ফলে কী হবে না হবে, এটা হলো পশ্চিমী জগতের চিন্তা। ভবিষ্যতে যদি দেশ সফল হয়, সবাই খেতে-পরতে পায়, দু’টি করে মোটরগাড়ি চড়তে পারে, তখন এ ভীতির প্রশ্ন আসবে। তার আগে নয়।
প্রশ্ন : আপনি কবি ও কথাশিল্পী। এই দুই সত্তার মধ্যে কি কোনো দ্বন্দ্ব আছে?
উত্তর : ঠিক জানি না। গল্প-উপন্যাস লিখতে পরিশ্রম বেশি হয়। অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও লিখতে হয় আমাকে। গদ্য, ইচ্ছে না থাকলেও লেখা যায়। কবিতার ব্যাপারটি ভিন্ন। যখন ইচ্ছে হলো, লিখলাম। কবিতা লিখতেই খুব বেশি আনন্দ পাই। আর গদ্য লেখা শেষ হলে স্বস্তি।
প্রশ্ন : পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত্ কী? সেখানে কী কোনোদিন ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন হবে?
উত্তর : হলেও হতে পারে। আমাদের দেশ ভারতে শিক্ষার বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নয়। প্রত্যেক রাজ্যে শিক্ষার ব্যাপারটি তাদের নিজস্ব নীতিতে চলে।
প্রশ্ন : ছেলেবেলায় কী ভাবতেন, বড় হয়ে কী হবেন?
উত্তর : ছেলেবেলায় লেখক হবো ভাবিনি। নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। নাবিক হওয়ার মধ্যে রোমান্টিক একটা ব্যাপার আছে। আমাদের ছোটবেলায় অনেক জাহাজ চলত। নাবিকদের সে জায়গা কিন্তু এখন পাইলটরা নিয়ে নিয়েছে।
প্রশ্ন : কলকাতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যত্ কী?
উত্তর : বাংলা ভাষা অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। নতুন প্রজন্ম বাংলা শিখতে চাইছে না। পড়তে চাইছে না। আমরা এ অবস্থা পাল্টাতে আন্দোলন শুরু করেছি। তাতে আমরা দাবি করছি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে চাকরি দেবে, তাতে বাংলা জানাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আরও বলছি, বাংলায় চিঠি দিলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বাংলায়ই তার উত্তর দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এটা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গত পয়লা বৈশাখে বলেছেন, সরকারি কাজ সব বাংলায় চলবে।
No comments:
Post a Comment