নুরুল করিম নাসিম
তখন ষাট দশকের শেষ প্রহর। সত্তর দশক উদ্বোধন হওয়ার অপেক্ষায়। কলকাতা থেকে কোনো বাংলা বই কিংবা সাহিত্যপত্রিকা এ দেশে আসত না। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে রক্তহীন এক বিপ্লবে তদানীন্তন পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন, দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ।তারপরও সীমান্তের কাঁটাতারের শাসনকে উপেক্ষা করে কী এক জাদুবলে কলকাতার পূজা সংখ্যা ‘দেশ’ ও দু’তিনটি লিটল ম্যাগ সাংবাদিকদের হাতে পৌঁছে যেত।
এরকম একটি পূজা সংখ্যা ‘দেশ’ হাত বদলে আমাদের কাছে এলো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অতিন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়Ñ তাদের লেখা আমরা পড়তাম। পূজা সংখ্যায়ও এদের লেখা ছিল। এর মধ্যে সুনীলের লেখাটি মনে হয়েছে অন্য রকম।
সুনীলের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ নিজের জীবন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস। খুবই সাহসী এবং সময়োপযোগী একটি আখ্যান। আমেরিকান কবি সিলভিয়া প্লাথের ‘বেলজার’ উপন্যাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যদিও দু’টি দুই ভিন্ন ধারার উপন্যাস।
সুনীলের সাথে এভাবে আমাদের পরিচয়। যা কিছু পেয়েছি, কবিতা কিংবা উপন্যাস গোগ্রাসে গিলেছি। এক বিমুগ্ধতা আমাদের পেয়ে বসেছিল। একটা ঘোরের ভেতর আমরা চলে যেতাম তার উপন্যাস পড়তে পড়তে। তিনি জনপ্রিয় ধারার লেখক হয়েও বেশ কিছু অবিস্মরণীয় উপন্যাস আমাদের উপহার দিয়েছেন।
নোবেল বিজয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ তার একটি গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন। তিনি স্বপ্নে গল্প পেতেন। রাতে দেখা স্বপ্নগুলো কাটছাঁট করে গল্প লিখেছিলেন গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ। সুনীলও স্বপ্ন নিয়ে, স্বপ্ন থেকে গল্প আহরণ করতেন।
সুনীল একজন সিরিয়াস পাঠকও বটে। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আবার এমনও হয় আমার খুব এলোমেলো বই পড়ার স্বভাব, যখন তখন যেকোনো একটা বই পড়ি। এ রকম যেকোনো একটা বই পড়তে পড়তেও চিন্তা আসে। সেই সব চিন্তা কখনো কখনো লেখার বিষয়বস্তুও হয়ে দাঁড়ায়।
ষাট দশকের শেষ প্রহরে এবং সত্তর দশকের শুরুতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় ছাপা হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তখন সাগরময় ঘোষ। সুনীলকে তার লেখার জন্য সব ধরনের পত্রপত্রিকায় তাকে গদ্য জোগান দিতে হয়েছে।
‘কৃত্তিবাস’ ছিল তার যৌবনের স্বপ্ন। এই লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে তিনি ও তার কবিতাপ্রেমিক বন্ধুরা একটি কবিতা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কবি বুদ্ধদেব বসুর যেমন ছিল ‘কবিতা’ পত্রিকা। আমাদের দেশে কবি শামসুর রাহমান ও কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের যৌথ উদ্যোগে যেমনÑ তেমনি সুনীলের ‘কৃত্তিবাস’।
সুনীলের একাধিক ছবির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন।
তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থ প্রণেতা। শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে, তার প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই ‘একা এবং কয়েকজন’, পরে একই নামে একটি বিশাল উপন্যাসও লেখেন, আর পরে গদ্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বলা চলে, জীবন-জীবিকার জন্য নিয়মিত রুটিন করে তাকে গদ্য লিখতে হতো। এই লেখার টাকা দিয়ে তার সংসার চলত। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নিয়মিত লিখতেন, সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে কফি হাউজে আড্ডা দিতেন।
বিটলসদের দলপতি কবি অ্যালেন গিনসবার্গ যখন কলকাতায় আসেন, সুনীলের সাথে গভীর অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। সেটা ষাট দশকের কথা। আমেরিকার আইওয়াতে কবিতার আন্তর্জাতিক উৎসব ও ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর। প্রতিষ্ঠানের আয়োজকেরা সুনীলকে আমন্ত্রণ জানালেন এক বছরের জন্য সেখানে। চমৎকার সময় কাটল। সবটাই ছিল কবিতার দিনরাত্রি। তখন তিনি তরতাজা যুবক। চোখে স্বপ্ন, মনের ভেতর কবিতার আনাগোনা নিঃসঙ্গ একাকী জীবনে শুধু কবিতার একমাত্র আশ্রয়। সেই ভিনদেশে দেখা হলো তার সাথে এক কবিতাপাগল ফরাসি যুবতীর। মেয়েটির নাম মার্গারিট। সুনীলের ‘কবিতার দেশে গানের দেশে’ বইটিতে সেই অনিন্দ্য সুন্দরী নারীর কথা বিস্তারিত লেখা আছে। তাকে নিয়ে ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’ উপন্যাসও লিখেছেন। আরো একটি উপন্যাসে এ প্রসঙ্গ এসেছে। মার্গারিট ছিল তার অনুপ্রেরণা। ফরাসি কবিতা ফরাসি ভাষায় সে আবৃত্তি করত, আর সুনীল বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাকে শোনাতেন। এভাবে আমেরিকার আইওয়াতে কবিতাময় দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন দেশে ফেরার সময় এলো। ইচ্ছে করলে আরো এক বছর থাকতে পারতেন সেখানে। কিন্তু বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার জন্য দেশে ফিরে এলেন। দেশে চাকরি পাওয়া এতটা সহজ ছিল না সেই ষাট-সত্তর দশকে। টিউশনি করে জীবন শুরু করেছিলেন, আবার কি তবে পুরনো পেশায় ফিরে যাবেন? না, সে রকমটি হয়নি। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ সুনীলের ভেতর সম্ভাবনাময় এক তরুণ কবি ও ঔপন্যাসিককে আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাকে স্বনামে এবং কিছু ছদ্মনামে ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় কলাম লিখতে দিলেন। সনাতন পাঠক, নীললোহিত, নীল উপাধ্যায়Ñ এসব ছদ্মনামে তিনি অবিশ্রান্ত লিখতে শুরু করলেন।
তার আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’-এ এসব কথা খোলাখুলি লিখেছেন। তিনি জীবন ধারণের প্রয়োজনে গদ্য লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন।
তার রক্তের সাথে গভীরভাবে মিশে ছিল ভ্রমণ। যখনই কিছু টাকা হাতে আসত, দু-তিনজন বন্ধু মিলে চলে যেতেন কলকাতার বাইরে। নতুন জনপদ দেখতেন, বিচিত্র সব মানুষ দেখতেন, দেশকে বুঝতে চেষ্টা করতেন। তার ‘যুবক যুবতীরা’ উপন্যাসটি এই ভ্রমণের ফসল। জ্যাক কেরুয়াক, বিটলসদের আর এক খ্যাতিমান লেখক, ‘অফ দ্য রোড’ লিখেছিলেন তিন সপ্তাহে একটি ভ্রমণকে পুঁজি করে, তেমনি সুনীলও পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের বিশাল ও বিচিত্রসব জনপদ, সংস্কৃতি ও মানুষের কথা তার অসংখ্য উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।
তার সহধর্মিণী স্বাতীর সাথে বিয়েটাও উপন্যাসের মতো চমকপ্রদ। তখন সুনীল কবি ও গদ্যকার হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। হঠাৎ একদিন এক নারী তাকে টেলিফোন করে দেখা করতে চাইলেন। সুনীল রাজি হলেন। নারীটি কবির সাথে দেখা করলেন এবং সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।
সুনীলের তখন চালচুলো কিছু নেই। স্থায়ী কোনো চাকরিও নেই। আছে শুধু চমৎকার গদ্যের একটি হাত। রিস্ক নিলেন উভয়ে, হয়ে গেল বিয়ে। সুনীল এসব কথা তার আত্মজীবনীতে চমৎকার গদ্যে লিখেছেন।
বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদ ও প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল সুনীলের। কবি রফিক আজাদ ‘কোনো খেদ নাই’ আত্মজীবনীতে অনেক অকথিত গল্প বলেছেন এই কবি সম্পর্কে।
‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে সুনীল লিখেছেন : কেন লিখি, এই প্রশ্ন যদি আমার চব্বিশ-পঁচিশ বছরে করা হতো, তাহলে উত্তর একরকম হতো। চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছরে অন্যরকম। এখন হয়তো আরেক রকম। এ ব্যাপারে কোনো স্থির সত্য নেই।
সুনীল চলে গেলেন।
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে যার জন্ম, ২৩ অক্টোবর ২০১২ সালে কলকাতায় তার মৃত্যু। শিক্ষা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেছেন।
জীবনে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৩ সালে পান বঙ্কিম পুরস্কার। ভারতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে।
তার লেখা, বিশেষত উপন্যাস ও কবিতা, ইংরেজিসহ একাধিক বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, তা সহজে পূরণ হবে বলে মনে হয় না। তিনি বিদেশী কবিতাও অনুবাদ করেছেন বিস্তর। তার ‘কবিতা কার জন্য’, ‘কবিতার জন্য সারা পৃথিবী’, ‘সাহিত্যের কোনো শর্ত নেই’ বাঙালি পাঠকদের কাছে অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি একজন ভালো বক্তাও ছিলেন। তার লেখায় যেমন, কথাতেও হাস্যরস থাকত, ব্যঙ্গ থাকত।
‘সেইসময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘প্রথম আলো’, ‘জীবন যে রকম’ বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী উপন্যাস। জনপ্রিয় ধারার লেখক হয়েও কয়েকটি অবিস্মরণীয় উপন্যাসও আমাদের জন্য তিনি রেখে গেছেন।
No comments:
Post a Comment