Tuesday, 6 November 2012

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা : আত্মস্বীকারোক্তির শিল্পিত দলিল

স র দা র আ ব দু স সা ত্তা র
নীরার সামান্য কোনো অসুখের সংবাদ শুনলেই মন খারাপ হয়ে যায় গোটা কলকাতার—সে তো অনেক আগেই আমরা জেনেছিলাম। কিন্তু সেই নীরার স্রষ্টার মৃত্যু-সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে জগত্-সংসারে কতখানি দুঃখের বাতাস আর্দ্র হয়ে ওঠে। কী পরিমাণ বেদনা ও কান্না জমা হতে পারে পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা তাঁর ভক্ত ও পাঠক মহলে—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সে বিষয়ে আমাদের কিছুই জানাননি। তবে কবির ‘মৃত্যু’ কবিতায় ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার বধ্যভূমিতে বাঁধভাঙা ভিড়ের ছবি বেশ যত্ন করেই এঁকেছিলেন তিনি। আর সেই ভিড়ের আকুলতা ও শোকবিহ্বলতার এক নতুন ছবি দেখলাম আমরা ২৫ অক্টোবর। দূরদর্শনের পর্দায় তা দেখা গেল—রবীন্দ্রসদন চত্বরে যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শবাধারে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পালা চলছিল। আঁকাবাঁকা দীর্ঘ লাইন ধরে ক্রমাগতভাবে এগিয়ে চলা জনতার উপচে ওঠা ভিড় নিয়ন্ত্রণে পুলিশ তখন ব্যর্থ এবং অসহায়। অবস্থা সামাল দিতে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ও মন্ত্রীদেরও তখন ভিড় নিয়ন্ত্রণে গলদঘর্ম হয়ে উঠতে দেখা গেল। একজন সাহিত্যিকের অন্তিম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে ঢল নামা সাধারণ মানুষের ভিড় সামলাতে পথে নেমে পড়তে হয়েছে খোদ মন্ত্রীবর্গকে—বিষয়টি ভাবতেও ভালো লাগে। ভালো লাগে দেখতেও।
তবে আমাদের জন্য দেখার তখনও কিছু বাকি ছিল। টেলিভিশনের ক্যামেরা যখন সারবন্দী সাধারণ মানুষের লাইন ছেড়ে মরদেহ রাখার জন্য বিশেষভাবে তৈরি মঞ্চ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ওপর আলো ফেলল, তখন দেখা গেল সেখানে বেশ কাছাকাছি অবস্থানেই বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সবসময়ে যারা একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং সেই কথার তাপ-উত্তাপ দ্বারা প্রভাবিত হয় গোটা রাজ্যের রাজনীতি, সেই দু’জন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রাজনীতিবিদকে এক মঞ্চে দেখা যাবে—চোখে না দেখলে কেউই হয়তো তা বিশ্বাস করতেন না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকাকালীন অবস্থায় কলকাতা শহরে বহু ধরনের কীর্তি কাহিনীর জন্ম দিয়েছেন। অনেক আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। পার্থিব মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সেই আশ্চর্য জাদুকরী ক্ষমতাটি যে নিঃশেষ হয়ে যায়নি, তাঁর শবাধারের পাশে একই বেদনায় বিনম্র হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক মঞ্চে দাঁড় করিয়ে সেই কথাটাই যেন সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন তিনি। তবে এখানেই শেষ নয়। বিস্ময়ের আরও একটা দৃশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আর তা দেখা গেল কেওড়াতলা অভিমুখী শ্মশানযাত্রীদের মিছিলে সবার সঙ্গে হেঁটে চলেছেন ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রীও। একজন সাহিত্যিকের মৃত্যুতে শোককাতর জনতার সারিতে যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সশরীরে যোগ দেন, তাহলে সেটা একটা ভিন্ন মাত্রা পায় বৈকি।
সদ্য প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী নেত্রীর প্রতিনিধিকে দেখেছি। তাদের দেখিনি। দেখলে ভালো লাগত। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ছিল অনেক। কিন্তু চমত্কার বন্ধুত্ব ছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ১৯৬৪ সালে ঘটেছিল এই বন্ধুত্বের গোড়াপত্তন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে বিকশিত করলেও মূলত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই তিনি খুঁজে পান তার প্রাণের মুক্তি। প্রাণের আনন্দ। তাই দু’জনের জীবনের বিভিন্ন ধরনের চড়াই-উত্রাই সত্ত্বেও তাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। শোকে-দুঃখে, আনন্দে-বিষাদে দু’জনেই ছিলেন পরস্পরের কাছাকাছি। ২৩ তারিখ রাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে কলকাতার একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল দিনভর রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জনের যে শোকবার্তা প্রচার করছিল, সেখানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর শঙ্খ ঘোষের দেয়া বাণী দু’টিতে যে তপ্ত প্রাণের উষ্ণতা এবং বেদনার শিশিরবিন্দু জমা হয়েছিল, তা অন্য বাণীগুলোতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বেশ খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গেই আমি তা লক্ষ্য করছিলাম।
কয়েকবছর আগে ২০০৭ সালের মার্চ মাসে নন্দীগ্রাম ট্র্যাজেডি নিয়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গ যখন উত্তাল, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পনীতির বিরুদ্ধে সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ থেকে পেশাদার বুদ্ধিজীবী সবাই সোচ্চার, তখন কী দরদ আর সাহস নিয়েই না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বন্ধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন! আনন্দবাজারের মতো একটি প্রভাবশালী ও কট্টর ডানপন্থী পত্রিকায় সেদিন তিনি দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পনীতির একশো ভাগ সমর্থক। কৃষিতে আনতে হবে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশের উন্নতি নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে। আকবর বাদশার আমলে একজন চাষীর যে রকম চেহারা বা পোশাক ছিল, ঠেঙ্গো ধুতি বা ছেঁড়া লুঙ্গি-গেঞ্জি থাক বা না থাক, খালি পা, রোগা ডিগডিগে চেহারা, এখনও সেই চেহারাই দেখি। সেই লাঙল। চিরকাল এ রকমই থাকবে?... চাষির তিন ছেলের মধ্যে যদি দুই ছেলে কারখানায় চাকরি করতে যায়, তাহলেই আর জমি ভাগ হয় না। তার অবস্থা কিছুটা সচ্ছল হতে পারে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ মার্চ ২০০৭)।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যে শিল্পনীতিকে সেদিন তিনি দুস্থ কৃষক এবং রাষ্ট্রের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেছিলেন, তার সপক্ষে সেদিন তিনি শুধু কলম ধরেই তৃপ্ত হননি, বক্তৃতা বিবৃতি মিছিল মিটিংয়েও সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছিলেন। ফলে বিরোধী শিবিরের নানা ধরনের তির্যক মন্তব্যের ধারালো তীরও তাঁর দিকে ছুটে আসছিল। কিন্তু তিনি তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কোনো টীকা-টিপ্পনিই নীরবে মেনে নেয়ার মানুষ নন। তাই কোনো বিলম্ব না করেই জবাবে সেদিন লিখেছিলেন—‘যারা সরকার-বিরোধী প্রতিবাদে নেমেছেন, তাদের মধ্যে অনেক অগ্রগণ্য ব্যক্তির মনোভাবে বেশ ‘হোলিয়ার দ্যান দাউ’ মনোভাব দেখা যাচ্ছে। তারাই যেন আদর্শবাদী, স্বার্থত্যাগী, সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার বা সুবিধে পাওয়ার তোয়াক্কা করেন না। আর যারা প্রতিবাদের জন্য তাদের পাশে এসে দাঁড়াননি, তারা যেন সরকারের চাটুকার, সুবিধাবাদী ইত্যাদি। এটা বেশ মজার। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তরুণ মজুমদার এমনকি এই অধমেরও সরকারের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই, তা তারা বোঝেন না...।’ এসব তর্ক-বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগুতে এগুতে সুনীল তাঁর নিজের মতো করে একটা চমত্কার উপস্থিতিতে পৌঁছে যান। আর সেই উপলব্ধিত সত্যের আলো দিয়ে সেরা মতামতটি প্রকাশ করতে গিয়ে লিখলেন—“আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বামফ্রন্ট একবার পাঁচ বছরের জন্য বিরোধী আসনে গিয়ে বসলেই বোধ হয় ভালো হয়। তিরিশ বছরে ক্ষমতার একাধিপত্যে তাতে ক্লেদও জমে যায়। তলার দিকে ক্ষমতার ভোগী আস্ফাালন ও অর্থলোভ বেড়ে যায়। সেই সব খারাপ উপাদান থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ হয়ে তাঁরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুন। কিন্তু এই পাঁচ বছর ক্ষমতায় বসবে যারা, সেই বিকল্পের কথা ভাবলেই বিবমিষা হয়।...”
কিন্তু তাঁর এই খোলাখুলি মতামতকে সহজভাবে গ্রহণ করা বাম কিংবা ডান কোনো শিবিরের পক্ষেই সহজ ছিল না। তবু তিনি নিজের মতো করেই সারাজীবন ব্যক্ত করে গেছেন আপন মতামত। কে পছন্দ করল আর করল না—তা নিয়ে বিচলিত হতেন না। কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি নিজেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক আর হৈ-হল্লার মধ্যে সারাক্ষণ ডুবে থাকা—কোনো লেখকের জন্যই কাঙ্ক্ষিত কিংবা শুভ নয়। সব দলাদলি ও ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে লেখকের স্থান, বাগানের মালীর মতো একজন লেখক নিরন্তরভাবে তাঁর কলম থেকে কথার ফুল ফুটিয়ে থাকেন। তার কোনোটিতে অমোঘ সত্য, কোনোটিতে হাসি, কোনোটিতে কান্নাসহ বিবিধ অনুভূতির তাজা রঙ লেগে থাকবে—যা হার মানিয়ে দেবে বাগানের টকটকে রক্তগোলাপটিকে। আর এই উপলব্ধিকে অন্তরে ধারণ করেই তিনি লিখলেন—“আমি ঠিক করেছি, আমি আর কোনওদিন কোনও মিছিলে যাব না। আমি না গেলেও কারও কিছু যাবে আসবে না। আমি বাংলা ভাষার একজন সেবক, এখনও বিবেকের দংশন অসহ্য হলে লেখার মাধ্যমেই প্রতিবাদ জানাব, অথবা সমর্থন জানাব বন্ধুদের, পথে নামার প্রয়োজন নেই আমার।”

No comments:

Post a Comment