রাজিয়া মজিদ
বন এত ছোট কেনে?’সরকারি কোয়ার্টার্সের দোতলার দক্ষিণমুখী জানালা দিয়ে আমি বাইরের দিকে তাকালাম। রোমাঞ্চিত হলাম। শিশুকাল থেকে আমি বাবুই পাখির বাসা নিয়ে খেলতে ভালোবাসি। বড় হয়ে এর নির্মাণ কৌশল দেখে মুগ্ধ। ছোট পাখি অথচ এর বাসার সূক্ষ্ম নির্মাণকাজ অভূতপূর্ব। সুন্দর এবং মনোহর। এই বয়সেও আমার মনে হয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নির্মাণশিল্পীর চেয়ে এই ছোট প্রাণীটির কৃতিত্ব কম নয়। এগুলো নৈপুণ্য এবং দক্ষতার কথা। ঠোঁটে ও পায়ে করে খড়কুটো এনে বাসা তৈরি করে এরা। এখনো ভাবি, কেউ যদি আমাকে দু-একটা বাবুই পাখির বাসা এনে হাতে দেয়, আমি কৃতার্থবোধ করি এবং আমার ড্রইং রুমের কাচের আলমারিতে স্যুভেনির হিসেবে রেখে দিই। ছেলেবেলায় ঝড়বৃষ্টি হলে আমি খুশি হতাম। মা কান মলে দিয়ে বলতেন, এতে খুশি হওয়ার কী আছে? অসময়ে ঝড়বৃষ্টি হলে মানুষের কত কষ্ট বাড়ে। ফসলের ক্ষতি হয়। অতি বৃষ্টি এবং বন্যা হলে মানুষের দুর্গতির অন্ত থাকে না।
আমি কাঁদতাম। মাকে নিষ্ঠুর মনে হতো। মা আমার মনের কথা বোঝে না। আমি তার কথা বুঝি না। চিন্তাধারায় কত ফারাক। ঝড় হলে আমি দৌড়ে চলে যেতাম তালগাছের নিচে, ফাঁকা মাঠে। দু-একটা বাসা নিচে পড়তই। তাই বুকে করে নিয়ে এসে সারা দিন খেলায় মত্ত থাকতাম। মা এবার মারতেন না, শুধু আফসোস করে বলতেন, এই মেয়েটা কোন দিন না মাথায় বাজ পড়ে মারা যায়। অল্প ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে বাজ পড়ে, বললেও বুঝবে না, কথাও শুনবে না। একে নিয়ে আমার শতেক জ্বালা। মায়ের দুঃখ, আমি তার অন্য ছেলেমেয়েদের মতো বুঝদার এবং বাধ্য নই। আমি এতকাল পরে এসব ভাবছি কেন? ভাবনাটাই তো আমার সহজাত প্রবৃত্তি। আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকেই এ কারণে আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। তারা বলেন, নেই কাজ তো খই ভাজ।
কিন্তু আমি নিজেকে তা মনে করি না। পৃথিবীর সব মানুষই কি এক রকম হবে? ভোগবিলাসী, অর্থ এবং ক্ষমতালোভী? আমি তা নই। আমি ব্যতিক্রম সাদাসিধে একটা মানুষ। অল্পতে তুষ্ট। লেখালেখি এবং বই পড়া খুব ভালোবাসি। তাই নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত থাকি। আর্থিক উন্নতি এবং সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তাই আমার পরিবারে আমি একজন বোকা, গবেট এবং দায়িত্বহীন ব্যক্তি।
আবার আমি এসব অতীত চিন্তা নিয়ে, অলস ব্যাপার নিয়ে ভাবছি কেন? বর্তমান বাস্তবতা কী? তা হলো, আমি কয়েক দিন বিছানায় লেপটে আছি। একরত্তি পড়তে পারছি না। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা।
রোজকার মতো একটা সরকারি হাইস্কুলের দুই শিফটের দায়িত্ব পালন করে, ঢাকা এডুকেশন বোর্ডের হেড এক্সামিনারের কর্তব্য পালন করে রাত ১২টায় বাসায় ফিরেছি। এশার নামাজ পড়ে আর রাতের ভোজন দুই টুকরো পাউরুটি খেয়ে শুয়ে পড়েছি। সকালে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য যেই বিছানা থেকে পা নামাচ্ছি অমনি তারস্বরে চিৎকার। এমন চিৎকার যা শুনে মনে হবে, আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, শেষ রাতের হালকা অন্ধকার ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে বাজির ফুলকির মতো।
সবাই ঘুমে অচেতন। শুধু আমার সেজো বোন রেণু নিচতলা থেকে ছুটে এলো। আমার একটা পা বিছানায় অন্যটি নিচে ঝুলছে, কোনো মতেই এ পা’টাকে আর নাড়াতে পারছি না। আমার কষ্টের বর্ণনা শুনে শুধু বলল, ঠিকভাবে বিছানায় পা তুলতেই হবে।
আমি বললাম, অসম্ভব। সে কিছু না বলে সযতেœ সতর্কতার সাথে পা তুলে দিলো বিছানায়। আমার আর্তনাদে কান দিলো না। তার পরে সে আমার ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গেল কোনো কথা না বলে।
আমি হতভম্ব।
ঘণ্টাখানেক পরে সে ফিরে এলো। সাথে এক সুদর্শন যুবক। তার হাতে ডাক্তারি ব্যাগ।
সব রহস্য খোলাসা হলো। রেণু চলে গিয়েছিল পঙ্গু হাসপাতালের সরকারি কোয়ার্টার্সে। যেখানে ডাক্তারেরা বসবাস করেন। ঘুম থেকে ডা: হাসানকে তুলে সাথে নিয়ে এসেছে।
আমার এই বোনের কথায়, আচরণে এবং ব্যবহারে জাদু আছে। সেই আকর্ষণ কেউ এড়াতে পারে না, কিন্তু ডাক্তার হাসান? তখনো অন্ধকার কাটেনি। দিনের আলো ফোটেনি, সেই অস্পষ্ট অন্ধকারে ডাক্তার হাসান কেমন করে এলো একজন রোগীর বাড়ি, সে আমার কাছ থেকে কোনো ফি নেয়নি অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও। তার এই উদারতা, মহত্ত্ব এবং অসাধারণ মানবিক আচরণ আমার মনের কোঠরে আজো জ্বলজ্বল করছে মনুষ্যত্বের মর্যাদায়। ডাক্তার হাসানের অভিমত সংক্ষিপ্ত। সে আমাকে খুব যতেœর সাথে দেখল, তারপর কথা, এক্সরে না করলে সঠিকভাবে কিছু বলা যাবে না। তবে হাড় বেড়ে গেলে এ রকম যন্ত্রণা হয়। সে ক্ষেত্রে অপারেশন করলে ভালো হয়ে যায়। আর যদি হাড় ক্ষয়জনিত ফ্রাকচার হয়ে থাকে অর্থাৎ অস্টিওপরোসিস হয় তাহলে এর কোনো প্রতিকার নেই। তবে ফারদার অর্থাৎ রোগ যাতে আরো বৃদ্ধি না পায় তার জন্য প্রিভেনটিভ অনেক কিছু করতে হবে। আমার মাথা ঘুরছে। অস্টিওপরোসিস, এমন রোগের কথা জীবনেও শুনিনি। এ কেমন রোগ, প্রতিকার নেই। যা ভেঙেছে তা আর কোনো দিন ভালো হবে না। এ কী অসহনীয় যন্ত্রণা। ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগেরও চিকিৎসা আছে, কেমোথেরাপি আর হাড়ের ‘ক্ষয়জনিত’ ফ্রাকচার প্রতিকারহীন। ডা: হাসান বলল, ফুল বেডরেস্ট, পনের দিন।
আমার কোমরের মাপ নিয়ে, ফি না নিয়ে ডা: হাসান চলে যেতে যেতে বলল, পনের দিন পর আবার আমি আসব। হ্যাঁ ভালো কথা, আপনার একটা অভ্যাস আছে, লেখালেখি, রেণু আপা বলেছে, এটাও বন্ধ, ফিজিক্যাল রেস্ট এবং মেন্টাল রেস্ট, আপনার দুটোই দরকার। শুধু হালকা গল্পের বই পড়তে পারেন।
ডা: হাসান চলে গেল। লেখা বন্ধ, কাজ বন্ধ, গুরুতর সমস্যা নিয়ে আলোচনা বন্ধ, নট নড়নচড়ন, তাহলে আমি কী? একটা গাছের গুঁড়ি, একটা মৃতদেহ, একটা পুতুল? আমি কাঁদতে লাগলাম। অনেক দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য লেখক তারাশঙ্করের ‘কবি’ নামে একটা বই পড়েছিলাম। গ্রাম্য কবিদের কবিয়াল লড়াই। একপক্ষ কবিতায় প্রশ্ন করবে, অন্যপক্ষ কবিতায় উত্তর দেবে। তুমুল লড়াই। যে দল জিতবে সেই দল পুরস্কৃত হবে।
একদল প্রশ্ন করছে, কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদো কেন?
অন্যদলের উত্তর মনে নেই। তবে আজ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, হায়, জীবন এত ছোট কেনে? আমার মোটে বায়ান্ন বছর বয়স, এই বয়সে জীবন শেষ। সোজা হয়ে হাঁটতে হবে। নিচু হওয়া যাবে না, ভারী কোনো কিছু তোলা যাবে না, বসে লেখা যাবে না, আরো অনেক বিধিনিষেধ।
দ্য স্প্যান অব লাইফ ইজ সো শর্ট, ইংরেজ কবির আক্ষেপ। আমার আক্ষেপ, আমি এক দম দেয়া পুতুল। হায়, জীবন এত ছোট কেন?
পনের দিন পর ডাক্তার হাসান এলো। হাতে এক অদ্ভুত বস্তু। সে নাম বলল, করসেট। তারপর আমাকে সযতেœ উঠিয়ে কোমরে বেঁধে দিলো। বলল, আপনি চাকরি করেন, বিশেষ করে ছোটাছুটির কাজ। এটা আপনাকে কোমরে ইউজ করতেই হবে। নচেৎ আবার প্রচণ্ড ব্যথা।
করসেট চিরদিনের জন্য আমার সঙ্গী হয়ে গেল। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করি, আমার কর্মঠ কর্মময় জীবন সত্যি কি শেষ? বায়ান্ন বছর বয়সে আমি পঙ্গু, অথর্ব এবং অসহায়?
‘যাহা থাকিবে নসিবে ঘুরে ফিরে আসিবে’Ñ আমার নির্বুদ্ধিতার এই ভাবে ব্যাখ্যা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। আমার এক হিতৈষী আত্মীয়া আমাকে এভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন, মাঝারি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মধ্য বয়সের ডাক্তারকে সব সময় দেখাবে। এদের হাতে সময় আছে, ভবিষ্যতে সুনাম অর্জন ও স্বনামধন্য ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আছে। এরা রোগীকে অনেক সময় নিয়ে আন্তরিকতার সাথে দেখে। যারা ইতোমধ্যে অনেক সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের হাতে সময় কম। রোগীর ভিড় বেশি। তা ছাড়া এসব বয়োবৃদ্ধ ডাক্তারের অনেকের মানসিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া আছে। ইতোমধ্যে আমি একটুখানি সামলে উঠেছি। আমি জীবন সম্পর্কে এত হতাশ কেন? আমি একজন জীবনসৈনিক, সাহিত্যসৈনিক। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিক আহত হলেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আমিও তাই। শুধু প্রেক্ষাপট অন্যরকম। রোগের সাথে যুদ্ধ করেই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি খোঁজ করে একজন বড় অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে হাজির হলাম। তিনি পঙ্গু হাসপাতালের প্রফেসর ছিলেন। কোনো কারণে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। ভদ্রলোক আমার অসুখের বিবরণ শুনে বড় বড় চোখ করে তাকালেন। আমি বুদ্ধিমতী হলে সেই মুহূর্তে বুঝতে পারতাম, তিনি এই অসুখের নাম জীবনেও শোনেননি। ডাক্তারেরা সাধারণত রোগীদের চেয়ে অনেক চালাক এবং বুদ্ধিমান হন। তিনি বোধহয় আমার মতো শাসালো রোগীকে হাতছাড়া করতে চাননি। নিজেও রসিক এবং ভালো বক্তা। কথার জালে আমাকে মুগ্ধ করলেন। আমি তিন-তিনটা বছর তার চিকিৎসায় থেকে গেলাম। এর মধ্যে তিনি শুধু আমাকে পেইন কিলিং ট্যাবলেট এবং ভিটামিন খাইয়ে রাখলেন। এই রোগের আসল ওষুধ যে ক্যালসিয়াম তা আমি যেমন জানি না, এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ ডাক্তারও তেমনি অজ্ঞ। তিন বছর পরে আমার অসুখ চরমে উঠল। শরীরে অসহনীয় ব্যথা এবং প্রায় অনড় অবস্থায় ডাক্তার এবার শেষ নাটক করলেন। দুই হাতের তালু এক করে চাটি মেরে বললেন, আপনার শরীরের হাড় বিশেষ করে পিঠের হাড় একটার সাথে আরেকটা লেগে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। কারোর সাধ্য নেই এগুলো ঠিক করার। যান যান, বিদেশে চলে যান। শেষের কথাগুলো তার কর্কশ, অমার্জিত এবং ভঙ্গি অশালীন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আর এক মিনিটও এখানে নয়। এর অজ্ঞতা এবং আসল চেহারা এত দিনে উন্মোচিত। ছি ছি নিজেকেই বারবার ধিক্কার দিলাম। হাড়ের শেষ অবস্থা জানার জন্য ওই ডাক্তারের অ্যাডভান্স স্লিপ নিয়ে এক্সরে কিনিকে গেলাম। রেডিওলজিস্ট বললেন, আপনার হাড়ে অনেক ফ্রাকচার হয়েছে। আমি না বোঝায় তিনি এক্সরের ফটোগুলো দেখিয়ে বললেন, এই দেখুন কত বড় বড় কালো গর্ত, এখানে হাড় সব ভেঙে গেছে।
আমার জিজ্ঞাসা, এটা কি সারবে?
তিনি কিঞ্চিত গম্ভীর হয়ে বললেন, অসম্ভব। আমি সেই ঘরে বসেই অসহায়ের মতো কাঁদতে লাগলাম। আমি আমার মেয়ে লিপিকে সব বললাম, লিপি ছি: ছি: করতে লাগল, মা, তুমি আমাকে গোড়াতেই জানালে না কেন? আমি এক হাজার মিলিগ্রামের ক্যালসিয়াম দুই-তিন ফাইল পাঠিয়ে দিতে পারতাম, কত লোক দিন-রাত আসা-যাওয়া করছে। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। আমি পাসপোর্ট এবং ভিসার জন্য দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করলাম। প্রথম ইন্টারভিউতেই আমার ভিসা হয়ে গেল, আমার সেজো বোন সালেহা খাতুন সিদ্দিকী ওরফে রেণু শুনে বলল, আমিও যাবো আপনার সাথে।
more information click here
No comments:
Post a Comment