গল্পের ফেরিওয়ালা
নয়ন রহমান
দুপুরের ভাতঘুমটা কলবেলের তীèস্বরে ছই-ছৎকার হয়ে যায় রুমানার। একবার। দু’বার। তিনবার।নাহ। আর শুয়ে থাকা যায় না।
চোখের সামনেই দেয়ালঘড়ি। বেলা তিনটা।
এ অসময়ে কে এলো?
বুয়া তো কলবেল কেন কানের কাছে বোমা ফাটলেও সাড়া দেবে না। ওর ঘুমটা একটু বেশি। ঘুম ভাঙলেও ঘটকা মেরে শুয়ে থাকে। রুমানা তাড়াতাড়ি উঠে ‘আই হোল’-এ চোখ রেখে দরজা খুলে দেয়। তুমি অসময়ে?
আম্মা, আমাগো আবার সময় অসময় কী? আর আপনের কাছে আইতে তো আমার পরান তড়পাইতেছে হেই বিহান থাইক্যা।
এসো, ভেতরে এসো।
আম্মা, আইজ একখান জব্বর খবর আছে।
জব্বর খবর, সে আবার কী?
আম্মা, ছেরি পলাইছে।
কে?
ক্যান, যে ছেরির বিয়াত আপনে শাড়ি দিলেন, জামাইরে পায়জামা-পাঞ্জাবি দিলেন?
জোছনা?
হ আম্মা, জোছনা পলাইছে।
সেকি ওর মা তো বলেছিল জোছনা আজ শ্বশুরবাড়ি যাবে।
যাইবে না। হেই লাইগাই তো পলাইছে।
রুমানা ড্রইংরুমের ফ্যান খুলে দিয়ে বলে, বসো।
আম্মা, বুয়া নাই?
ঘুমায়।
হ, কপাল লইয়া আইছে আপনের বুয়া। আম্মা, এট্টু পানি খাইয়া আহি পাকঘর থাইকা।
না। তুমি বসো। আমি দিচ্ছি।
রুমানা এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি আর দু’খানা বিসকিট এনে দেয়। ‘আম্মা, আপনের দয়ার শরীল। হেই ভুঁইয়াপাড়া থাইক্যা হাঁইট্যা আইছি। আম্মা, আইজ আপনেরে একখান জবর খবর দিমু কইছি না?
ঠিক আছে। আগে স্থির হও।
আম্মা, ছেরি হেই ব্যান বেলাই ঘর থাইকা বাইর হইয়া গেছে। অহনও ফেরে নাই। খোঁজতে খোঁজতে হককলে হয়রান হইয়া গেছে। বাপ-মায়ের তো পাগল হইবার দশা। কী ধুমধাম কইরা বিয়া হইলো।
হউর বাড়ি গেলো। আবার আইলো। আমিও তো ছেরির লগে গেছিলাম। কী বড় গেরস্থ। দুইডা মাছের পুষ্কুনি। দুইডা গাই গরু। ধানী জমি। ছেরির মনে ধরলো না।
তা কার সাথে পালিয়েছে?
আম্মা, আপনে যেন কিছু বোঝেন না। পলাইছে ঐ ছেরার লগে।
সে কি?
হ, আম্মা, ওই ছ্যারা অরে বিয়া করতে চাইছিল। আর বাপ-মা কয়, মাইয়া ছোড। অহন বিয়া দিমু না, ছেরা এক দোকানে কাম করে। ঐ বস্তিতেই থাকে। আপনেও তো কইছেন, মাইয়ার অহন বিয়া দিও না। অর বিয়ার বয়স হয় নাই।
ঠিকই বলেছিলাম বুয়া। জোছনার মাত্র এগারো বছর বয়স। এ বয়সে বিয়ে দেওয়া যায় না। সরকার তো বাল্যবিয়ে নিষিদ্ধ করেছে। তয় অহন মাইয়ারে বিয়া দিলো কেমনে?
বিয়ে হয়ে যাবার পর আমি শুনেছি।
হ, আপনেরে আগে জানায় নাই। জামা-কাপুড় পাওনের লাইগা আপনের কাছে আইছে। বস্তির মানুষে চান্দা তুইল্যা বিয়ার খাওন দাওনের বেবস্তা করছে। অহন হগগলে পাগলের মতন জোছনারে খোঁজতাছে। ওই ছেরারে পাইলে এমন মাইর দিবো… হু। আম্মা, সুখের সংসার ছাইড়া মাইয়াডা আগুনে ঝাঁপ দিছে।
সোনার সংসার ছেড়ে জোছনা আগুনে ঝাঁপ দিলো কেন?
আম্মা, হাচা কতা কই? জোছনা মইষের মতো কালা সোয়ামীরে পছন্দ করে নাই। জোছনারে তো আপনে দেখছেন। পরীর মতন সোন্দর। সোন্দর দেইখা অরে পছন্দ করছে অর হউরে। অর মায়ে বাসা-বাড়িতে কাম করে। বাপে রিশকা টানে। এইগুলান অর হউর কিছু মানে নাই। ছেরিরে লইয়া কই পলাইছে কেডা জানে।
এসব কথা বাদ দাও। আমার কাছে ওর বাবাকে আসতে বলবে। আমি ওকে থানায় পাঠাব। পুলিশের অসাধ্য কিছু নাই। পুলিশ খুঁজে বের করবে।
আম্মা, কী যে কন। পুলিশ খুঁইজ্যা বাইর করবে?
করবে। কোথায় পালিয়ে থাকবে?
আম্মা, জোছনার বাপ যাইবে না। থানা পুলিশরে ডরায়। আর আপনের কথা মতো থানায় গেলে জোছনার বাপে ফাঁইস্যা যাইবে, হের হাতে হাতকড়া পরবো।
তাই? কেন?
বুয়া একটু মুখ বাঁকিয়ে হেসে বলল, আম্মা, আপনে এত লেহাপড়া মানুষ, আপনে এডা জানেন না যে মাইয়া সাবাল্লক না অইলে বিয়া দেওন যায় না? হুনছি সরকারে তো আইন করছে মাইয়ার বিয়ার বয়স হইবে আঠার বচ্ছর। আর পোলার বাইশ বচ্ছর। এই বয়স না হইলে বিয়া দেওন যাইবে না, উল্টা জেল খাটতে হইবে।
তুমি দেখছি সবই জানো।
জানুম না? টাউনে থাহি। রেডিও-টেলিভিশন দেহি। মানষে কওয়াকওয়ি করে। গেরামে পলাইয়া পলাইয়া বিয়া অয়, ধরা পড়লে সোজা জেল, থাউগ্যা আম্মা। অহন আমার গলা হুগাইয়া গেছে। আপনের বুয়া কই? আমারে এট্টু চা খাওয়াইলে ভালো হইবো?
বুয়াÑ ও বুয়া ওঠো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না?
পৃথুলা বুয়া হাই দিতে দিতে এসে বলে, আম্মা গো, ঘুমাইবার কি জো আছে? এই কতরয়্যা বেডির কতায় তো কানের পোক বাইর হইয়া যাইবার দশা। এই বেডি, এই দুফুরে কেউ কতা ফেরি করতে আহে?
হাগো বুজান, আমি কতা ফেরি করি আবার কামও করি। আমাগো কি সময় অসময় বাইছ্যা চলনের জো আছে? আর আইছি তো আম্মার ধারে। তোমার ধারে তো আহি নাই? এই হগলের মর্ম তুমি বুঝবা না। যে বোঝার হেয় বুঝবে।
থাকÑ কথা বাড়িও না। আমেনার মা, চোখেমুখে পানি দিয়ে এসো। ফ্রিজে সেমাই আছে, ওকে দাও। আর চা করো। বেলা একদম পড়ে গেছে।
দিতাছি আম্মা। আহাদের চাকরি করেÑ হাত-পাও লাড়াইতে অয় না, মুখ লড়াইয়া ট্যাহা কামায়।
বুজান, তুমি এইর মর্ম বুঝবা না। মুখ লাড়াইতেও কষ্ট অয়। মুখে ফেনা ওডে। এই আম্মারে আমি ভালোবাসি। হ্যার ধারেই প্যাডের কতা কই। ঘুইর্যা ঘুইর্যা কতা জোগাড় কইরা আনি। আমার দুই পয়সা লাভ অয়। হেরও অয়।
আমি বিস্মিত হয়ে বলি, কী বলছ তুমি? আমার দু’পয়সা লাভ হয় মানে কী?
একগাল হেসে আমিনার মা বলে, ক্যান আম্মা, আপনে এই কতা সোন্দর কইরা লেইখ্যা কাগজে ছাপাইতে দ্যান না? কাগজওয়ালারা আপনেরে ট্যাহা দেয় না?
আমিনার মা, গল্প ছাপা হলেই সব পত্রিকা থেকে টাকা পাওয়া যায় না।
তয় ল্যাহেন কা আম্মা? ট্যাহাই যুদি না দিবো তয় হেগো ধারে আপনে গল্প ফেরি করেন ক্যা?
আমি গল্প ফেরি করি? কে বলল তোমাকে?
আমি জানি আপনে কত পেপারে গল্প লেহেন, আমি কত মাইনষের ধারে আপনের কতা কইছি! হুনছিও।
ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। এখন বলো তো জোছনার বিয়ের কাবিন হয়েছিল? রেজিস্ট্রি হয়েছিল?
হেই কতা তো কইতে পারুম না। তয় কাবিন অয় নাই।
কাবিন হয়নি? তাহলে কেমন বিয়ে হলো?
মুখে মুখে বিয়া হইছে। লেহাপড়া কিছু অয় নাই, মৌলভী কইছে আমি কাবিন করতে পারমু না। তোমাগো পোলা-মাইয়া দুইজনেই নাবাল্লক। জানাজানি হইলে আমারই জেল হইবে।
মৌলভীর হাত-পায়ে ধরছিল অরা, আপনে লেইখা দ্যান, মাইয়ার বয়স আঠারো, পোলার বয়স বাইশ বছর।
মৌলভী রাজি অয় নাই। অরা মৌলভীরে ট্যাহাও দিতে চাইছে।
মৌলভী কইছে আমি জেলের ভাত খাইতে পারুম না। তোমরা আমারে আইডি কার্ড আইন্যা দেখাও।
হেরা আইডি কার্ড পাইবো কই?
মাইয়া-পোলার বাপে তো গ্যারাকলে পড়ছে।
কেউ কেউ পরামিশ দিছিল, পয়সা খরচ কইরা আইডি কার্ড করাও, পয়সা দিলে এক ঘণ্টার মধ্যে আইডি কার্ড পাইয়া যাইবো।
পয়সা খরচ করলেই আইডি কার্ড করানো যায়?
আম্মা, পয়সা খরচ করলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়।
আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বুয়া।
মাথা খারাপের কিচ্ছু নাই আম্মা, ট্যাহা খরচ কইরা কত মানষে মুক্তিযুদ্ধার সার্টিফিকেট নিছে। যে পোলারা হেই গণ্ডগোলের সময় জন্মায় নাই, হেরাও কয় আমি মুক্তিযোদ্ধা।
বুয়া, ‘গণ্ডগোলের সময় বলবে না, বলবে, মুক্তিযুদ্ধের সময়।
অই হইলো একটা কথা।
না, তুমি কখনো বলবে না ‘গণ্ডগোলের সময়।’
হ, আম্মা, মনে রাখুম, আমরা অশিক্ষিত মানুষ। কত শিক্ষিত মানষে এই কতা কয়।
এখন বলো, জোছনার বাবা-মা এখন কী করবে? ওই ছেলে তো জোছনাকে বিয়ে করতে পারবে না।
বিয়ার কী দরকার আম্মা? এক লগে থাকবে। জোছনার সোয়ামীর বাড়ির মানষেও কিছু করতে পারবে না। হেগো পোলাও তো নাবাল্লক। ধরা খাইয়া যাইবে।
এবার ওঠো। নামাজের আজান পড়ে গেছে। আমি নামাজ পড়তে যাই। আমিও যাই আম্মা। জোছনার খবর পাইলে আমি কইয়া যামু, আর কোনো গল্পের খোঁজ পাইলেও আসুম। আম্মা, গল্প কইতে কইতে আমারো নেশা ধইরা গেছে। বস্তিতে কত মানুষের কত কতা, হেইগুলানই তো আপনে সন্দোর কইরা লেখেন।
তয় একখান কতা কই আম্মা? দিনকাল খারাপ হইয়া গেছে। মাইয়া বড় অইলেই বাপ-মায়ের চিন্তা, পোলাপানরা জব্বর খারাপ। অরা মাইয়াগো ভালো থাকতে দেয় না, জোর কইরা বিয়া করতে চায়। মাইয়া রাজি না অইলে মুখ পুড়াইয়া দেয়। আম্মা আমাগো জোছনারে কি আহাদ করে বিয়া দিছে? ওই শয়তান ছ্যারা জোছনার পিছে লাগছে। কত ভালা ভালা কতা কইছে। আম্মা গো অহন মানুষ আল্লা রসুলেরে ডরায় না।
বুয়া, তোমার লেকচার বন্ধ করো। এই নাও এক শ’ টাকা। আমার বুয়া চোখ কপালে তুলে বলে, আম্মা, বেডিরে এক শ’ ট্যাহা দিলেন? আপনেরে পাইছে ভালা মানুষ।
বুয়া দরজা খুলতে খুলতে স্বগতোক্তি করেÑ আমার প্যাডেও বহুত কতা আছে। আমিও আম্মারে কইয়া প্যাড পাতলা করুম। আম্মার কাছ থেকে ট্যাহা নিমু।
আমি ওর কথায় কান না দিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম অজু করতে। মন স্থির করে অজু করতে পারলাম না। আসলে সব মানুষের মনেই কথা জমা থাকে। আমি মনের ভেতরে কথার ঝাঁপি বন্ধ করেও জোছনার কচি মুখটা ভুলতে পারছি না। সত্যি ওর মুখখানা চাঁদের মতো। গরিবের ঘরে এই চাঁদমুখের নিরাপত্তা কোথায়? মেয়েদের নিরাপত্তা নেই কোথাও। গ্রাম-শহর সব জায়গায় এক অবস্থা। দরিদ্র বাপ-মা পেটের দায়ে নাবালক মেয়েদের বিয়ে দিয়ে একখানা ভাতের থালা কমায়।
নাহ! নামাজে দাঁড়িয়েও জোছনার কথা ভুলতে পারি না। নামাজ শেষ করে কাগজ-কলম নিয়ে বসি। ভুঁইয়াপাড়ার বস্তির বুয়া আমার কাছে এসে কত গল্প করে! আমার বুয়া বলে, কথা ফেরি করে। আমি কী করি? জনে জনে তা জানিয়ে দিই। আমিও কি গল্পের ফেরিওয়ালা?
No comments:
Post a Comment