Tuesday, 6 November 2012

গল্পের ফেরিওয়ালা

গল্পের ফেরিওয়ালা

নয়ন রহমান
তারিখ: ২ নভেম্বর, ২০১২
গল্পের ফেরিওয়ালা
দুপুরের ভাতঘুমটা কলবেলের তীèস্বরে ছই-ছৎকার হয়ে যায় রুমানার। একবার। দু’বার। তিনবার।
নাহ। আর শুয়ে থাকা যায় না।
চোখের সামনেই দেয়ালঘড়ি। বেলা তিনটা।
এ অসময়ে কে এলো?
বুয়া তো কলবেল কেন কানের কাছে বোমা ফাটলেও সাড়া দেবে না। ওর ঘুমটা একটু বেশি। ঘুম ভাঙলেও ঘটকা মেরে শুয়ে থাকে। রুমানা তাড়াতাড়ি উঠে ‘আই হোল’-এ চোখ রেখে দরজা খুলে দেয়। তুমি  অসময়ে?
আম্মা, আমাগো আবার সময় অসময় কী? আর আপনের কাছে আইতে তো আমার পরান তড়পাইতেছে হেই বিহান থাইক্যা।
এসো, ভেতরে এসো।
আম্মা, আইজ একখান জব্বর খবর আছে।
জব্বর খবর, সে আবার কী?
আম্মা, ছেরি পলাইছে।
কে?
ক্যান, যে ছেরির বিয়াত আপনে শাড়ি দিলেন, জামাইরে পায়জামা-পাঞ্জাবি দিলেন?
জোছনা?
হ আম্মা, জোছনা পলাইছে।
সেকি ওর মা তো বলেছিল জোছনা আজ শ্বশুরবাড়ি যাবে।
যাইবে না। হেই লাইগাই তো পলাইছে।
রুমানা ড্রইংরুমের ফ্যান খুলে দিয়ে বলে, বসো।
আম্মা, বুয়া নাই?
ঘুমায়।
হ, কপাল লইয়া আইছে আপনের বুয়া। আম্মা, এট্টু পানি খাইয়া আহি পাকঘর থাইকা।
না। তুমি বসো। আমি দিচ্ছি।
রুমানা এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি আর দু’খানা বিসকিট এনে দেয়। ‘আম্মা, আপনের দয়ার শরীল। হেই ভুঁইয়াপাড়া থাইক্যা হাঁইট্যা আইছি। আম্মা, আইজ আপনেরে একখান জবর খবর দিমু কইছি না?
ঠিক আছে। আগে স্থির হও।
আম্মা, ছেরি হেই ব্যান বেলাই ঘর থাইকা বাইর হইয়া গেছে। অহনও ফেরে নাই। খোঁজতে খোঁজতে হককলে হয়রান হইয়া গেছে। বাপ-মায়ের তো পাগল হইবার দশা। কী ধুমধাম কইরা বিয়া হইলো।
হউর বাড়ি গেলো। আবার আইলো। আমিও তো ছেরির লগে গেছিলাম। কী বড় গেরস্থ। দুইডা মাছের পুষ্কুনি। দুইডা গাই গরু। ধানী জমি। ছেরির মনে ধরলো না।
তা কার সাথে পালিয়েছে?
আম্মা, আপনে যেন কিছু বোঝেন না। পলাইছে ঐ ছেরার লগে।
সে কি?
হ, আম্মা, ওই ছ্যারা অরে বিয়া করতে চাইছিল। আর বাপ-মা কয়, মাইয়া ছোড। অহন বিয়া দিমু না, ছেরা এক দোকানে কাম করে। ঐ বস্তিতেই থাকে। আপনেও তো কইছেন, মাইয়ার অহন বিয়া দিও না। অর বিয়ার বয়স হয় নাই।
ঠিকই বলেছিলাম বুয়া। জোছনার মাত্র এগারো বছর বয়স। এ বয়সে বিয়ে দেওয়া যায় না। সরকার তো বাল্যবিয়ে নিষিদ্ধ করেছে। তয় অহন মাইয়ারে বিয়া দিলো কেমনে?
বিয়ে হয়ে যাবার পর আমি শুনেছি।
হ, আপনেরে আগে জানায় নাই। জামা-কাপুড় পাওনের লাইগা আপনের কাছে আইছে। বস্তির মানুষে চান্দা তুইল্যা বিয়ার খাওন দাওনের বেবস্তা করছে। অহন হগগলে পাগলের মতন জোছনারে খোঁজতাছে। ওই ছেরারে পাইলে এমন মাইর দিবো… হু। আম্মা, সুখের সংসার ছাইড়া মাইয়াডা আগুনে ঝাঁপ দিছে।
সোনার সংসার ছেড়ে জোছনা আগুনে ঝাঁপ দিলো কেন?
আম্মা, হাচা কতা কই? জোছনা মইষের মতো কালা সোয়ামীরে পছন্দ করে নাই। জোছনারে তো আপনে দেখছেন। পরীর মতন সোন্দর। সোন্দর দেইখা অরে পছন্দ করছে অর হউরে। অর মায়ে বাসা-বাড়িতে কাম করে। বাপে রিশকা টানে। এইগুলান অর হউর কিছু মানে নাই। ছেরিরে লইয়া কই পলাইছে কেডা জানে।
এসব কথা বাদ দাও। আমার কাছে ওর বাবাকে আসতে বলবে। আমি ওকে থানায় পাঠাব। পুলিশের অসাধ্য কিছু নাই। পুলিশ খুঁজে বের করবে।
আম্মা, কী যে কন। পুলিশ খুঁইজ্যা বাইর করবে?
করবে। কোথায় পালিয়ে থাকবে?
আম্মা, জোছনার বাপ যাইবে না। থানা পুলিশরে ডরায়। আর আপনের কথা মতো থানায় গেলে জোছনার বাপে ফাঁইস্যা যাইবে, হের হাতে হাতকড়া পরবো।
তাই? কেন?
বুয়া একটু মুখ বাঁকিয়ে হেসে বলল, আম্মা, আপনে এত লেহাপড়া মানুষ, আপনে এডা জানেন না যে মাইয়া সাবাল্লক না অইলে বিয়া দেওন যায় না? হুনছি সরকারে তো আইন করছে মাইয়ার বিয়ার বয়স হইবে আঠার বচ্ছর। আর পোলার বাইশ বচ্ছর। এই বয়স না হইলে বিয়া দেওন যাইবে না, উল্টা জেল খাটতে হইবে।
তুমি দেখছি সবই জানো।
জানুম না? টাউনে থাহি। রেডিও-টেলিভিশন দেহি। মানষে কওয়াকওয়ি করে। গেরামে পলাইয়া পলাইয়া বিয়া অয়, ধরা পড়লে সোজা জেল, থাউগ্যা আম্মা। অহন আমার গলা হুগাইয়া গেছে। আপনের বুয়া কই? আমারে এট্টু চা খাওয়াইলে ভালো হইবো?
বুয়াÑ ও বুয়া ওঠো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না?
পৃথুলা বুয়া হাই দিতে দিতে এসে বলে, আম্মা গো, ঘুমাইবার কি জো আছে? এই কতরয়্যা বেডির কতায় তো কানের পোক বাইর হইয়া যাইবার দশা। এই বেডি, এই দুফুরে কেউ কতা ফেরি করতে আহে?
হাগো বুজান, আমি কতা ফেরি করি আবার কামও করি। আমাগো কি সময় অসময় বাইছ্যা চলনের জো আছে? আর আইছি তো আম্মার ধারে। তোমার ধারে তো আহি নাই? এই হগলের মর্ম তুমি বুঝবা না। যে বোঝার হেয় বুঝবে।
থাকÑ কথা বাড়িও না। আমেনার মা, চোখেমুখে পানি দিয়ে এসো। ফ্রিজে সেমাই আছে, ওকে দাও। আর চা করো। বেলা একদম পড়ে গেছে।
দিতাছি আম্মা। আহাদের চাকরি করেÑ হাত-পাও লাড়াইতে অয় না, মুখ লড়াইয়া ট্যাহা কামায়।
বুজান, তুমি এইর মর্ম বুঝবা না। মুখ লাড়াইতেও কষ্ট অয়। মুখে ফেনা ওডে। এই আম্মারে আমি ভালোবাসি। হ্যার ধারেই প্যাডের কতা কই। ঘুইর‌্যা ঘুইর‌্যা কতা জোগাড় কইরা আনি। আমার দুই পয়সা লাভ অয়। হেরও অয়।
আমি বিস্মিত হয়ে বলি, কী বলছ তুমি? আমার দু’পয়সা লাভ হয় মানে কী?
একগাল হেসে আমিনার মা বলে, ক্যান আম্মা, আপনে এই কতা সোন্দর কইরা লেইখ্যা কাগজে ছাপাইতে দ্যান না? কাগজওয়ালারা আপনেরে ট্যাহা দেয় না?
আমিনার মা, গল্প ছাপা হলেই সব পত্রিকা থেকে টাকা পাওয়া যায় না।
তয় ল্যাহেন কা আম্মা? ট্যাহাই যুদি না দিবো তয় হেগো ধারে আপনে গল্প ফেরি করেন ক্যা?
আমি গল্প ফেরি করি? কে বলল তোমাকে?
আমি জানি আপনে কত পেপারে গল্প লেহেন, আমি কত মাইনষের ধারে আপনের কতা কইছি! হুনছিও।
ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। এখন বলো তো জোছনার বিয়ের কাবিন হয়েছিল? রেজিস্ট্রি হয়েছিল?
হেই কতা তো কইতে পারুম না। তয় কাবিন অয় নাই।
কাবিন হয়নি? তাহলে কেমন বিয়ে হলো?
মুখে মুখে বিয়া হইছে। লেহাপড়া কিছু অয় নাই, মৌলভী কইছে আমি কাবিন করতে পারমু না। তোমাগো পোলা-মাইয়া দুইজনেই নাবাল্লক। জানাজানি হইলে আমারই জেল হইবে।
মৌলভীর হাত-পায়ে ধরছিল অরা, আপনে লেইখা দ্যান, মাইয়ার বয়স আঠারো, পোলার বয়স বাইশ বছর।
মৌলভী রাজি অয় নাই। অরা মৌলভীরে ট্যাহাও দিতে চাইছে।
মৌলভী কইছে আমি জেলের ভাত খাইতে পারুম না। তোমরা আমারে আইডি কার্ড আইন্যা দেখাও।
হেরা আইডি কার্ড পাইবো কই?
মাইয়া-পোলার বাপে তো গ্যারাকলে পড়ছে।
কেউ কেউ পরামিশ দিছিল, পয়সা খরচ কইরা আইডি কার্ড করাও, পয়সা দিলে এক ঘণ্টার মধ্যে আইডি কার্ড পাইয়া যাইবো।
পয়সা খরচ করলেই আইডি কার্ড করানো যায়?
আম্মা, পয়সা খরচ করলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়।
আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বুয়া।
মাথা খারাপের কিচ্ছু নাই আম্মা, ট্যাহা খরচ কইরা কত মানষে মুক্তিযুদ্ধার সার্টিফিকেট নিছে। যে পোলারা হেই গণ্ডগোলের সময় জন্মায় নাই, হেরাও কয় আমি মুক্তিযোদ্ধা।
বুয়া, ‘গণ্ডগোলের সময় বলবে না, বলবে, মুক্তিযুদ্ধের সময়।
অই হইলো একটা কথা।
না, তুমি কখনো বলবে না ‘গণ্ডগোলের সময়।’
হ, আম্মা, মনে রাখুম, আমরা অশিক্ষিত মানুষ। কত শিক্ষিত মানষে এই কতা কয়।
এখন বলো, জোছনার বাবা-মা এখন কী করবে? ওই ছেলে  তো জোছনাকে বিয়ে করতে পারবে না।
বিয়ার কী দরকার আম্মা? এক লগে থাকবে। জোছনার সোয়ামীর বাড়ির মানষেও কিছু করতে পারবে না।  হেগো পোলাও তো নাবাল্লক। ধরা খাইয়া যাইবে।
এবার ওঠো। নামাজের আজান পড়ে গেছে। আমি নামাজ পড়তে যাই। আমিও যাই আম্মা। জোছনার খবর পাইলে আমি কইয়া যামু, আর কোনো গল্পের খোঁজ পাইলেও আসুম। আম্মা, গল্প কইতে কইতে আমারো নেশা ধইরা গেছে। বস্তিতে কত মানুষের কত কতা, হেইগুলানই তো আপনে সন্দোর কইরা লেখেন।
তয় একখান কতা কই আম্মা? দিনকাল খারাপ হইয়া গেছে। মাইয়া বড় অইলেই বাপ-মায়ের চিন্তা, পোলাপানরা জব্বর খারাপ। অরা মাইয়াগো ভালো থাকতে দেয় না, জোর কইরা বিয়া করতে চায়। মাইয়া রাজি না অইলে মুখ পুড়াইয়া দেয়। আম্মা আমাগো জোছনারে কি আহাদ করে বিয়া দিছে? ওই শয়তান ছ্যারা জোছনার পিছে লাগছে। কত ভালা ভালা কতা কইছে। আম্মা গো অহন মানুষ আল্লা রসুলেরে ডরায় না।
বুয়া, তোমার লেকচার বন্ধ করো। এই নাও এক শ’ টাকা। আমার বুয়া চোখ কপালে তুলে বলে, আম্মা, বেডিরে এক শ’ ট্যাহা দিলেন? আপনেরে পাইছে ভালা মানুষ।
বুয়া দরজা খুলতে খুলতে স্বগতোক্তি করেÑ আমার প্যাডেও বহুত কতা আছে। আমিও আম্মারে কইয়া প্যাড পাতলা করুম। আম্মার কাছ থেকে ট্যাহা নিমু।
আমি ওর কথায় কান না দিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম অজু করতে। মন স্থির করে অজু করতে পারলাম না। আসলে সব মানুষের মনেই কথা জমা থাকে। আমি মনের ভেতরে কথার ঝাঁপি বন্ধ করেও জোছনার কচি মুখটা ভুলতে পারছি না। সত্যি ওর মুখখানা চাঁদের মতো। গরিবের ঘরে এই চাঁদমুখের নিরাপত্তা কোথায়? মেয়েদের নিরাপত্তা নেই কোথাও। গ্রাম-শহর সব জায়গায় এক  অবস্থা। দরিদ্র বাপ-মা পেটের দায়ে নাবালক মেয়েদের বিয়ে দিয়ে একখানা ভাতের থালা কমায়।
নাহ! নামাজে দাঁড়িয়েও জোছনার কথা ভুলতে পারি না। নামাজ শেষ করে কাগজ-কলম নিয়ে বসি। ভুঁইয়াপাড়ার বস্তির বুয়া আমার কাছে এসে কত গল্প করে! আমার বুয়া বলে, কথা ফেরি করে। আমি কী করি? জনে জনে তা জানিয়ে দিই। আমিও কি গল্পের ফেরিওয়ালা?



অন্তরলোকে জ্বলে জোনাকি

রাজিয়া মজিদ

তারিখ: ২ নভেম্বর, ২০১২
বন এত ছোট কেনে?’
সরকারি কোয়ার্টার্সের দোতলার দক্ষিণমুখী জানালা দিয়ে আমি বাইরের দিকে তাকালাম। রোমাঞ্চিত হলাম। শিশুকাল থেকে আমি বাবুই পাখির বাসা নিয়ে খেলতে ভালোবাসি। বড় হয়ে এর নির্মাণ কৌশল দেখে মুগ্ধ। ছোট পাখি অথচ এর বাসার সূক্ষ্ম নির্মাণকাজ অভূতপূর্ব। সুন্দর এবং মনোহর।  এই বয়সেও আমার মনে হয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নির্মাণশিল্পীর চেয়ে এই ছোট প্রাণীটির কৃতিত্ব কম নয়। এগুলো নৈপুণ্য এবং দক্ষতার কথা। ঠোঁটে ও পায়ে করে খড়কুটো এনে বাসা তৈরি করে এরা। এখনো ভাবি, কেউ যদি আমাকে দু-একটা বাবুই পাখির বাসা এনে হাতে দেয়, আমি কৃতার্থবোধ করি এবং আমার ড্রইং রুমের কাচের আলমারিতে স্যুভেনির হিসেবে রেখে দিই। ছেলেবেলায় ঝড়বৃষ্টি হলে আমি খুশি হতাম। মা কান মলে দিয়ে বলতেন, এতে খুশি হওয়ার কী আছে? অসময়ে ঝড়বৃষ্টি হলে মানুষের কত কষ্ট বাড়ে। ফসলের ক্ষতি হয়। অতি বৃষ্টি এবং বন্যা হলে মানুষের দুর্গতির অন্ত থাকে না।
আমি কাঁদতাম। মাকে নিষ্ঠুর মনে হতো। মা আমার মনের কথা বোঝে না। আমি তার কথা বুঝি না। চিন্তাধারায় কত ফারাক। ঝড় হলে আমি দৌড়ে চলে যেতাম তালগাছের নিচে, ফাঁকা মাঠে। দু-একটা বাসা নিচে পড়তই। তাই বুকে করে নিয়ে এসে সারা দিন খেলায় মত্ত থাকতাম। মা এবার মারতেন না, শুধু আফসোস করে বলতেন, এই মেয়েটা কোন দিন না মাথায় বাজ পড়ে মারা যায়। অল্প ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে বাজ পড়ে, বললেও বুঝবে না, কথাও শুনবে না। একে নিয়ে আমার শতেক জ্বালা। মায়ের দুঃখ, আমি তার অন্য ছেলেমেয়েদের মতো বুঝদার এবং বাধ্য নই। আমি এতকাল পরে এসব ভাবছি কেন? ভাবনাটাই তো আমার সহজাত প্রবৃত্তি। আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকেই এ কারণে আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। তারা বলেন, নেই কাজ তো খই ভাজ।
কিন্তু আমি নিজেকে তা মনে করি না। পৃথিবীর সব মানুষই কি এক রকম হবে? ভোগবিলাসী, অর্থ এবং ক্ষমতালোভী? আমি তা নই। আমি ব্যতিক্রম সাদাসিধে একটা মানুষ। অল্পতে তুষ্ট। লেখালেখি এবং বই পড়া খুব ভালোবাসি। তাই নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত থাকি। আর্থিক উন্নতি এবং সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তাই আমার পরিবারে আমি একজন বোকা, গবেট এবং দায়িত্বহীন ব্যক্তি।
আবার আমি এসব অতীত চিন্তা নিয়ে, অলস ব্যাপার নিয়ে ভাবছি কেন? বর্তমান বাস্তবতা কী? তা হলো, আমি কয়েক দিন বিছানায় লেপটে আছি। একরত্তি পড়তে পারছি না। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা।
রোজকার মতো একটা সরকারি হাইস্কুলের দুই শিফটের দায়িত্ব পালন করে, ঢাকা এডুকেশন বোর্ডের হেড এক্সামিনারের কর্তব্য পালন করে রাত ১২টায় বাসায় ফিরেছি। এশার নামাজ পড়ে আর রাতের ভোজন দুই টুকরো পাউরুটি খেয়ে শুয়ে পড়েছি। সকালে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য যেই বিছানা থেকে পা নামাচ্ছি অমনি তারস্বরে চিৎকার। এমন চিৎকার যা শুনে মনে হবে, আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, শেষ রাতের হালকা অন্ধকার ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে বাজির ফুলকির মতো।
সবাই ঘুমে অচেতন। শুধু আমার সেজো বোন রেণু নিচতলা থেকে ছুটে এলো। আমার একটা পা বিছানায় অন্যটি নিচে ঝুলছে, কোনো মতেই এ পা’টাকে আর নাড়াতে পারছি না। আমার কষ্টের বর্ণনা শুনে শুধু বলল, ঠিকভাবে বিছানায় পা তুলতেই হবে।
আমি বললাম, অসম্ভব। সে কিছু না বলে সযতেœ সতর্কতার সাথে পা তুলে দিলো বিছানায়। আমার আর্তনাদে কান দিলো না। তার পরে সে আমার ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গেল কোনো কথা না বলে।
আমি হতভম্ব।
ঘণ্টাখানেক পরে সে ফিরে এলো। সাথে এক সুদর্শন যুবক। তার হাতে ডাক্তারি ব্যাগ।
সব রহস্য খোলাসা হলো। রেণু চলে গিয়েছিল পঙ্গু হাসপাতালের সরকারি কোয়ার্টার্সে। যেখানে ডাক্তারেরা বসবাস করেন। ঘুম থেকে ডা: হাসানকে তুলে সাথে নিয়ে এসেছে।
আমার এই বোনের কথায়, আচরণে এবং ব্যবহারে জাদু আছে। সেই আকর্ষণ কেউ এড়াতে পারে না, কিন্তু ডাক্তার হাসান? তখনো অন্ধকার কাটেনি। দিনের আলো ফোটেনি, সেই অস্পষ্ট অন্ধকারে ডাক্তার হাসান কেমন করে এলো একজন রোগীর বাড়ি, সে আমার কাছ থেকে কোনো ফি নেয়নি অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও। তার এই উদারতা, মহত্ত্ব এবং অসাধারণ মানবিক আচরণ আমার মনের কোঠরে আজো জ্বলজ্বল করছে মনুষ্যত্বের মর্যাদায়। ডাক্তার হাসানের অভিমত সংক্ষিপ্ত। সে আমাকে খুব যতেœর সাথে দেখল, তারপর কথা, এক্সরে না করলে সঠিকভাবে কিছু বলা যাবে না। তবে হাড় বেড়ে গেলে এ রকম যন্ত্রণা হয়। সে ক্ষেত্রে অপারেশন করলে ভালো হয়ে যায়। আর যদি হাড় ক্ষয়জনিত ফ্রাকচার হয়ে থাকে অর্থাৎ অস্টিওপরোসিস হয় তাহলে এর কোনো প্রতিকার নেই। তবে ফারদার অর্থাৎ রোগ যাতে আরো বৃদ্ধি না পায় তার জন্য প্রিভেনটিভ অনেক কিছু করতে হবে। আমার মাথা ঘুরছে। অস্টিওপরোসিস, এমন রোগের কথা জীবনেও শুনিনি। এ কেমন রোগ, প্রতিকার নেই। যা ভেঙেছে তা আর কোনো দিন ভালো হবে না। এ কী অসহনীয় যন্ত্রণা। ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগেরও চিকিৎসা আছে, কেমোথেরাপি আর হাড়ের ‘ক্ষয়জনিত’ ফ্রাকচার প্রতিকারহীন। ডা: হাসান বলল, ফুল বেডরেস্ট, পনের দিন।
আমার কোমরের মাপ নিয়ে, ফি না নিয়ে ডা: হাসান চলে যেতে যেতে বলল, পনের দিন পর আবার আমি আসব। হ্যাঁ ভালো কথা, আপনার একটা অভ্যাস আছে, লেখালেখি, রেণু আপা বলেছে, এটাও বন্ধ, ফিজিক্যাল রেস্ট এবং মেন্টাল রেস্ট, আপনার দুটোই দরকার। শুধু হালকা গল্পের বই পড়তে পারেন।
ডা: হাসান চলে গেল। লেখা বন্ধ, কাজ বন্ধ, গুরুতর সমস্যা নিয়ে আলোচনা বন্ধ, নট নড়নচড়ন, তাহলে আমি কী? একটা গাছের গুঁড়ি, একটা মৃতদেহ, একটা পুতুল? আমি কাঁদতে লাগলাম। অনেক দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য লেখক তারাশঙ্করের ‘কবি’ নামে একটা বই পড়েছিলাম। গ্রাম্য কবিদের কবিয়াল লড়াই। একপক্ষ কবিতায় প্রশ্ন করবে, অন্যপক্ষ কবিতায় উত্তর দেবে। তুমুল লড়াই। যে দল জিতবে সেই দল পুরস্কৃত হবে।
একদল প্রশ্ন করছে, কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদো কেন?
অন্যদলের উত্তর মনে নেই। তবে আজ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, হায়, জীবন এত ছোট কেনে? আমার মোটে বায়ান্ন বছর বয়স, এই বয়সে জীবন শেষ। সোজা হয়ে হাঁটতে হবে। নিচু হওয়া যাবে না, ভারী কোনো কিছু তোলা যাবে না, বসে লেখা যাবে না, আরো অনেক বিধিনিষেধ।
দ্য স্প্যান অব লাইফ ইজ সো শর্ট, ইংরেজ কবির আক্ষেপ। আমার আক্ষেপ, আমি এক দম দেয়া পুতুল। হায়, জীবন এত ছোট কেন?
পনের দিন পর ডাক্তার হাসান এলো। হাতে এক অদ্ভুত বস্তু। সে নাম বলল, করসেট। তারপর আমাকে সযতেœ উঠিয়ে কোমরে বেঁধে দিলো। বলল, আপনি চাকরি করেন, বিশেষ করে ছোটাছুটির কাজ। এটা আপনাকে কোমরে ইউজ করতেই হবে। নচেৎ আবার প্রচণ্ড ব্যথা।
করসেট চিরদিনের জন্য আমার সঙ্গী হয়ে গেল। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করি, আমার কর্মঠ কর্মময় জীবন সত্যি কি শেষ? বায়ান্ন বছর বয়সে আমি পঙ্গু, অথর্ব এবং অসহায়?
‘যাহা থাকিবে নসিবে ঘুরে ফিরে আসিবে’Ñ আমার নির্বুদ্ধিতার এই ভাবে ব্যাখ্যা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। আমার এক হিতৈষী আত্মীয়া আমাকে এভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন, মাঝারি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মধ্য বয়সের ডাক্তারকে সব সময় দেখাবে। এদের হাতে সময় আছে, ভবিষ্যতে সুনাম অর্জন ও স্বনামধন্য ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আছে। এরা রোগীকে অনেক সময় নিয়ে আন্তরিকতার সাথে দেখে। যারা ইতোমধ্যে অনেক সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের হাতে সময় কম। রোগীর ভিড় বেশি। তা ছাড়া এসব বয়োবৃদ্ধ ডাক্তারের অনেকের মানসিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া আছে। ইতোমধ্যে আমি একটুখানি সামলে উঠেছি। আমি জীবন সম্পর্কে এত হতাশ কেন? আমি একজন জীবনসৈনিক, সাহিত্যসৈনিক। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিক আহত হলেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আমিও তাই। শুধু প্রেক্ষাপট অন্যরকম। রোগের সাথে যুদ্ধ করেই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি খোঁজ করে একজন বড় অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে হাজির হলাম। তিনি পঙ্গু হাসপাতালের প্রফেসর ছিলেন। কোনো কারণে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। ভদ্রলোক আমার অসুখের বিবরণ শুনে বড় বড় চোখ করে তাকালেন। আমি বুদ্ধিমতী হলে সেই মুহূর্তে বুঝতে পারতাম, তিনি এই অসুখের নাম জীবনেও শোনেননি। ডাক্তারেরা সাধারণত রোগীদের চেয়ে অনেক চালাক এবং বুদ্ধিমান হন। তিনি বোধহয় আমার মতো শাসালো রোগীকে হাতছাড়া করতে চাননি। নিজেও রসিক এবং ভালো বক্তা। কথার জালে আমাকে মুগ্ধ করলেন। আমি তিন-তিনটা বছর তার চিকিৎসায় থেকে গেলাম। এর মধ্যে তিনি শুধু আমাকে পেইন কিলিং ট্যাবলেট এবং ভিটামিন খাইয়ে রাখলেন। এই রোগের আসল ওষুধ যে ক্যালসিয়াম তা আমি যেমন জানি না, এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ ডাক্তারও তেমনি অজ্ঞ। তিন বছর পরে আমার অসুখ চরমে উঠল। শরীরে অসহনীয় ব্যথা এবং প্রায় অনড় অবস্থায় ডাক্তার এবার শেষ নাটক করলেন। দুই হাতের তালু এক করে চাটি মেরে বললেন, আপনার শরীরের হাড় বিশেষ করে পিঠের হাড় একটার সাথে আরেকটা লেগে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। কারোর সাধ্য নেই এগুলো ঠিক করার। যান যান, বিদেশে চলে যান। শেষের কথাগুলো তার কর্কশ, অমার্জিত এবং ভঙ্গি অশালীন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আর এক মিনিটও এখানে নয়। এর অজ্ঞতা এবং আসল চেহারা এত দিনে উন্মোচিত। ছি ছি নিজেকেই বারবার ধিক্কার দিলাম। হাড়ের শেষ অবস্থা জানার জন্য ওই ডাক্তারের অ্যাডভান্স স্লিপ নিয়ে এক্সরে কিনিকে গেলাম। রেডিওলজিস্ট বললেন, আপনার হাড়ে অনেক ফ্রাকচার হয়েছে। আমি না বোঝায় তিনি এক্সরের ফটোগুলো দেখিয়ে বললেন, এই দেখুন কত বড় বড় কালো গর্ত, এখানে হাড় সব ভেঙে গেছে।
আমার জিজ্ঞাসা, এটা কি সারবে?
তিনি কিঞ্চিত গম্ভীর হয়ে বললেন, অসম্ভব। আমি সেই ঘরে বসেই অসহায়ের মতো কাঁদতে লাগলাম। আমি আমার মেয়ে লিপিকে সব বললাম, লিপি ছি: ছি: করতে লাগল, মা, তুমি আমাকে গোড়াতেই জানালে না কেন? আমি এক হাজার মিলিগ্রামের ক্যালসিয়াম দুই-তিন ফাইল পাঠিয়ে দিতে পারতাম, কত লোক দিন-রাত আসা-যাওয়া করছে। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। আমি পাসপোর্ট এবং ভিসার জন্য দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করলাম। প্রথম ইন্টারভিউতেই আমার ভিসা হয়ে গেল, আমার সেজো বোন সালেহা খাতুন সিদ্দিকী ওরফে রেণু শুনে বলল, আমিও যাবো আপনার সাথে।
more information click here



সাহিত্য কবিতাবলী

পু ল ক  হা সা ন
আত্মরক্ষা
শীতে আর্তনাদ করে ওঠা পাতাটির মতো
মৃত্যুভয় আমার মনে
ধার্মিকের অনাবশ্যক খিস্তি থেকে
আছি তাই নিরাপদ;

দারুণ এই সময় যে-বা চাই অভয়
প্রেমের বিভীষিকায় শুধু আত্মক্ষয়
মৃত্যু প্রলোভন তাই যদি না জড়াত
পায় পায়, মন থেকে যত বিচিত্র ক্ষত
সারাবার থাকত কী উপায়?

এই ভেবে জেগে উঠি সাহসে
আহতের কণ্ঠ চিরে রক্তিম সারসে।

আ ই উ ব  সৈ য় দ
নিরপেক্ষ শরত
নিরপেক্ষ শরতটা হইচই করে ঘরে ফিরে
মাঝে মধ্যে বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে কল্পিত স্বরে,
সুর তাল লয় ডেকে শিশির ছায়ায় মিশে যায়
মনোনীত ব্যাকুলতা কেঁপে ওঠে অবিরত ঘরে।
পাখা ঝাপটানো দৃষ্টি প্রতিনিয়ত মুখ ফিরিয়ে
বিতর্ক করে উল্লাসে; উদাসী অবলোকনে পায়
অপঠিত রাতেরই বিপন্ন আচরণের ভাষা,
লুকানো রহস্য নিয়ে ডুবুরি সেজেই সাঁতরায়।

নিরপেক্ষ শরতটা আবার তদন্তের ভারেও
গোপন করে গোধূলি, কবিতার তীর ঘাম আর
অসহনীয় বিলাপ, উদোম পত্রালির রোমাঞ্চÑ
বুঝি না অগ্নিপরীক্ষা, আয়োজনে কেন হাহাকার?

নিরপেক্ষ শরতটা অজানা দাবির যৌথ ক্ষতে,
এখনো আছড়ে পড়ে সাবালিয়ার কথিত পথে।

কৃ ষ্ণা ন ন্দ  সা হা  রা য়
অসীমে হারিয়ে যাওয়া
মনে করো আমি নেই
নিথর নিষ্পন্দ প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে
স্তূপীকৃত একরাশ বালির স্তূপে
জেগে আছে শুধু আমার নিজস্ব মন ও চেতনা
রূপান্তরিত জৈবিক দেহ কঠিন প্রস্তর শিলায়।

মনে করো আমি নেই চেতনার নীলাকাশে চলেছি ছুটে
টেনে নিয়ে স্মৃতিময় বিদেহী সত্তাকে আমার
মিশে যেতে সীমাহীন অসীম আনন্দলোকে

সুখ নেই, দুঃখ নেই, নেই কোনো জ্বালাময় যন্ত্রণা
চাওয়া নেই, পাওয়া নেই, নেই কোনো আমিত্বের অহঙ্কার
ছায়া নেই, কায়া নেই, জৈবিক দেহ ছাড়ি
প্রাপ্তি শুধু একমাত্র অসীমে হারিয়ে যাওয়া।



কিছু স্মৃতি কিছু কথা : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নুরুল করিম নাসিম

তারিখ: ২ নভেম্বর, ২০১২
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
তখন ষাট দশকের শেষ প্রহর। সত্তর দশক উদ্বোধন হওয়ার অপেক্ষায়। কলকাতা থেকে কোনো বাংলা বই কিংবা সাহিত্যপত্রিকা এ দেশে আসত না। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে রক্তহীন এক বিপ্লবে তদানীন্তন পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন, দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ।
তারপরও সীমান্তের কাঁটাতারের শাসনকে উপেক্ষা করে কী এক জাদুবলে কলকাতার পূজা সংখ্যা ‘দেশ’ ও দু’তিনটি লিটল ম্যাগ সাংবাদিকদের হাতে পৌঁছে যেত।
এরকম একটি পূজা সংখ্যা ‘দেশ’ হাত বদলে আমাদের কাছে এলো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অতিন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়Ñ তাদের লেখা আমরা পড়তাম। পূজা সংখ্যায়ও এদের লেখা ছিল। এর মধ্যে সুনীলের লেখাটি মনে হয়েছে অন্য রকম।
সুনীলের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ নিজের জীবন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস। খুবই সাহসী এবং সময়োপযোগী একটি আখ্যান। আমেরিকান কবি সিলভিয়া প্লাথের ‘বেলজার’ উপন্যাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যদিও দু’টি দুই ভিন্ন ধারার উপন্যাস।
সুনীলের সাথে এভাবে আমাদের পরিচয়। যা কিছু পেয়েছি, কবিতা কিংবা উপন্যাস গোগ্রাসে গিলেছি। এক বিমুগ্ধতা আমাদের পেয়ে বসেছিল। একটা ঘোরের ভেতর আমরা চলে যেতাম তার উপন্যাস পড়তে পড়তে। তিনি জনপ্রিয় ধারার লেখক হয়েও বেশ কিছু অবিস্মরণীয় উপন্যাস আমাদের উপহার দিয়েছেন।
নোবেল বিজয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ তার একটি গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন। তিনি স্বপ্নে গল্প পেতেন। রাতে দেখা স্বপ্নগুলো কাটছাঁট করে গল্প লিখেছিলেন গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ। সুনীলও স্বপ্ন নিয়ে, স্বপ্ন থেকে গল্প আহরণ করতেন।
সুনীল একজন সিরিয়াস পাঠকও বটে। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আবার এমনও হয় আমার খুব এলোমেলো বই পড়ার স্বভাব, যখন তখন যেকোনো একটা বই পড়ি। এ রকম যেকোনো একটা বই পড়তে পড়তেও চিন্তা আসে। সেই সব চিন্তা কখনো কখনো লেখার বিষয়বস্তুও হয়ে দাঁড়ায়।
ষাট দশকের শেষ প্রহরে এবং সত্তর দশকের শুরুতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় ছাপা হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তখন সাগরময় ঘোষ। সুনীলকে তার লেখার জন্য সব ধরনের পত্রপত্রিকায় তাকে গদ্য জোগান দিতে হয়েছে।
‘কৃত্তিবাস’ ছিল তার যৌবনের স্বপ্ন। এই লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে তিনি ও তার কবিতাপ্রেমিক বন্ধুরা একটি কবিতা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কবি বুদ্ধদেব বসুর যেমন ছিল ‘কবিতা’ পত্রিকা। আমাদের দেশে কবি শামসুর রাহমান ও কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের যৌথ উদ্যোগে যেমনÑ তেমনি সুনীলের ‘কৃত্তিবাস’।
সুনীলের একাধিক ছবির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন।
তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থ প্রণেতা। শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে, তার প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই ‘একা এবং কয়েকজন’, পরে একই নামে একটি বিশাল উপন্যাসও লেখেন, আর পরে গদ্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বলা চলে, জীবন-জীবিকার জন্য নিয়মিত রুটিন করে তাকে গদ্য লিখতে হতো। এই লেখার টাকা দিয়ে তার সংসার চলত। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নিয়মিত লিখতেন, সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে কফি হাউজে আড্ডা দিতেন।
বিটলসদের দলপতি কবি অ্যালেন গিনসবার্গ যখন কলকাতায় আসেন, সুনীলের সাথে গভীর অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। সেটা ষাট দশকের কথা। আমেরিকার আইওয়াতে কবিতার আন্তর্জাতিক উৎসব ও ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর। প্রতিষ্ঠানের আয়োজকেরা সুনীলকে আমন্ত্রণ জানালেন এক বছরের জন্য সেখানে। চমৎকার সময় কাটল। সবটাই ছিল কবিতার দিনরাত্রি। তখন তিনি তরতাজা যুবক। চোখে স্বপ্ন, মনের ভেতর কবিতার আনাগোনা নিঃসঙ্গ একাকী জীবনে শুধু কবিতার একমাত্র আশ্রয়। সেই ভিনদেশে দেখা হলো তার সাথে এক কবিতাপাগল ফরাসি যুবতীর। মেয়েটির নাম মার্গারিট। সুনীলের ‘কবিতার দেশে গানের দেশে’ বইটিতে সেই অনিন্দ্য সুন্দরী নারীর কথা বিস্তারিত লেখা আছে। তাকে নিয়ে ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’ উপন্যাসও লিখেছেন। আরো একটি উপন্যাসে এ প্রসঙ্গ এসেছে। মার্গারিট ছিল তার অনুপ্রেরণা। ফরাসি কবিতা ফরাসি ভাষায় সে আবৃত্তি করত, আর সুনীল বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাকে শোনাতেন। এভাবে আমেরিকার আইওয়াতে কবিতাময় দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন দেশে ফেরার সময় এলো। ইচ্ছে করলে আরো এক বছর থাকতে পারতেন সেখানে। কিন্তু বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার জন্য দেশে ফিরে এলেন। দেশে চাকরি পাওয়া এতটা সহজ ছিল না সেই ষাট-সত্তর দশকে। টিউশনি করে জীবন শুরু করেছিলেন, আবার কি তবে পুরনো পেশায় ফিরে যাবেন? না, সে রকমটি হয়নি। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ সুনীলের ভেতর সম্ভাবনাময় এক তরুণ কবি ও ঔপন্যাসিককে আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাকে স্বনামে এবং কিছু ছদ্মনামে ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় কলাম লিখতে দিলেন। সনাতন পাঠক, নীললোহিত, নীল উপাধ্যায়Ñ এসব ছদ্মনামে তিনি অবিশ্রান্ত লিখতে শুরু করলেন।
তার আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’-এ এসব কথা খোলাখুলি লিখেছেন। তিনি জীবন ধারণের প্রয়োজনে গদ্য লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন।
তার রক্তের সাথে গভীরভাবে মিশে ছিল ভ্রমণ। যখনই কিছু টাকা হাতে আসত, দু-তিনজন বন্ধু মিলে চলে যেতেন কলকাতার বাইরে। নতুন জনপদ দেখতেন, বিচিত্র সব মানুষ দেখতেন, দেশকে বুঝতে চেষ্টা করতেন। তার ‘যুবক যুবতীরা’ উপন্যাসটি এই ভ্রমণের ফসল। জ্যাক কেরুয়াক, বিটলসদের আর এক খ্যাতিমান লেখক, ‘অফ দ্য রোড’ লিখেছিলেন তিন সপ্তাহে একটি ভ্রমণকে পুঁজি করে, তেমনি সুনীলও পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের বিশাল ও বিচিত্রসব জনপদ, সংস্কৃতি ও মানুষের কথা তার অসংখ্য উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।
তার সহধর্মিণী স্বাতীর সাথে বিয়েটাও উপন্যাসের মতো চমকপ্রদ। তখন সুনীল কবি ও গদ্যকার হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। হঠাৎ একদিন এক নারী তাকে টেলিফোন করে দেখা করতে চাইলেন। সুনীল রাজি হলেন। নারীটি কবির সাথে দেখা করলেন এবং সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।
সুনীলের তখন চালচুলো কিছু নেই। স্থায়ী কোনো চাকরিও নেই। আছে শুধু চমৎকার গদ্যের একটি হাত। রিস্ক নিলেন উভয়ে, হয়ে গেল বিয়ে। সুনীল এসব কথা তার আত্মজীবনীতে চমৎকার গদ্যে লিখেছেন।
বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদ ও প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল সুনীলের। কবি রফিক আজাদ ‘কোনো খেদ নাই’ আত্মজীবনীতে অনেক অকথিত গল্প বলেছেন এই কবি সম্পর্কে।
‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে সুনীল লিখেছেন : কেন লিখি, এই প্রশ্ন যদি আমার চব্বিশ-পঁচিশ বছরে করা হতো, তাহলে উত্তর একরকম হতো। চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছরে অন্যরকম। এখন হয়তো আরেক রকম। এ ব্যাপারে কোনো স্থির সত্য নেই।
সুনীল চলে গেলেন।
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে যার জন্ম, ২৩ অক্টোবর ২০১২ সালে কলকাতায় তার মৃত্যু। শিক্ষা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেছেন।
জীবনে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৩ সালে পান বঙ্কিম পুরস্কার। ভারতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে।
তার লেখা, বিশেষত উপন্যাস ও কবিতা, ইংরেজিসহ একাধিক বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, তা সহজে পূরণ হবে বলে মনে হয় না। তিনি বিদেশী কবিতাও অনুবাদ করেছেন বিস্তর। তার ‘কবিতা কার জন্য’, ‘কবিতার জন্য সারা পৃথিবী’, ‘সাহিত্যের কোনো শর্ত নেই’ বাঙালি পাঠকদের কাছে অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি একজন ভালো বক্তাও ছিলেন। তার লেখায় যেমন, কথাতেও হাস্যরস থাকত, ব্যঙ্গ থাকত।
‘সেইসময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘প্রথম আলো’, ‘জীবন যে রকম’ বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী উপন্যাস। জনপ্রিয় ধারার লেখক হয়েও কয়েকটি অবিস্মরণীয় উপন্যাসও আমাদের জন্য তিনি রেখে গেছেন।

বড় মনের মানুষ

রা ম শ ং ক র দে ব না থ
এই সেদিন, ২৩ অক্টোবর ২০১২ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেছেন অনেক দূর। সবে প্রকাশনা (বিভাস) প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেছি, প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট লেখক-সম্পাদক সবার যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি পূর্বপরিচয়ের সূত্রে। প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ দাদার আন্তরিক সহযোগিতা ও পরামর্শ ঢাকা শহরের নিষ্করুণ লড়াইয়ের ময়দানে আমার মনোবল ধরে রাখতে সহায়ক হয়েছে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির ১ম দিনে টাঙ্গাইলে কবি মাহমুদ কামাল ভাইয়ের কবিতা উত্সবে যোগ দিতে আসছেন বাংলা সাহিত্যের কলম জাদুকর, বিশ্ব-পর্যটক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ধ্রুব-দার কাছে একদিন গেলাম। বললাম, “আগামী সপ্তাহে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশে আসছেন।” এই নামটাই আমার জন্য এমন গভীর সংবেদনশীল যে, আমি ভেতরে ভেতরে যেন কেমন আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলাম। আমার বুকশেলফ ভর্তি প্রিয় কবি-লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্র, অর্ধেক জীবন, জীবন যে রকম, সেই সময়, ছবির দেশে কবিতার দেশে, প্রথম আলো, অর্জুন, পূর্ব-পশ্চিম, কবিতার জন্য সারা পৃথিবী’র কলকাতার সংস্করণ। ধ্রুব-দাই বললেন, “দেখা করেন, খুব ভালো মানুষ, অনেক মহান মনের মানুষ, টাকা-পয়সা অবস্থান এসব দেখে তিনি মানুষের সঙ্গে মেশেন না, যেমন বড় লেখক, তেমনি বড় মনের মানুষ।”
কথাটায় ভরসা পেলাম। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, “আমার সঙ্গে দেখা কী করবেন?”
“নিশ্চয়ই করবেন, দাঁড়ান, যোগাযোগের ব্যবস্থা করিয়ে দিচ্ছি।”
ধ্রুব-দা সুনীলদার ভ্রাতৃসম কবি শ্যামলকান্তি দাশের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় দিন। অন্য আর দশজন সাধারণ প্রকাশকের মত আমারও ব্যস্ততা তুঙ্গে। ছয়জনের কাজ একাকীই করতে হয়। বেলা ১১টায় মেলা শুরু। তার আগে সকাল ৮টার সময় কাকরাইলস্থ রাজমণি ঈশা খাঁ হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখানেই আমার স্বপ্নের মানুষটি ঘর নিয়েছেন থাকার জন্য। অবশেষে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। হোটেলভর্তি পশ্চিম বাংলার কবি-লেখকরা সাত সকালেই টাঙ্গাইল যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছেন, শুধু সুনীলদার অপেক্ষায়। পরিচয় হলো কবি নবনীতা দেব সেনসহ আরো কয়েকজন কবির সঙ্গে। কবি শ্যামলকান্তি দাশ আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ক’মিনিট কথা বলা যায় কি-না সন্দেহ। উনি এত ব্যস্ত মানুষ। এরই মধ্যে এসে গেলেন বাংলা প্রকাশের কবি, লেখক হুমায়ূন কবীর ঢালী ভাই ও আরো কয়েক জন।
সুনীলদা নাস্তা খাবার ফাঁকে মোবাইলে কবি বিপাশা মনডলের সঙ্গে নতুনদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করলেন।
আমার বই প্রকাশের তালিকা নিয়ে দেখে ‘অর্ধেক জীবন’ নিয়ে কবি শ্যামলকান্তি দাশ একটু অমত করলেন। সুনীলদা শ্যামলকান্তিকে বললেন, আমি আনন্দ পাবলিশার্সকে কপিরাইট দিয়ে দিয়েছি না-কি!
সুনীলদা এমনভাবে কথা বললেন যেন আমি তার অনেক দিনের চেনা। আমাকে সহযোগিতা করার জন্য তাঁর লেখা বই প্রকাশের অনুমতি দিলেন। আমাকে নিয়ে সঙ্গে নাস্তা করলেন। সম্মানীর অর্থ দিতে গেলে নিতে চাইলেন না।
জিজ্ঞেস করলেন, “প্রকাশনা ছাড়া আর কি কর?”
আমি বললাম, “আর কিছুই করি না।”
“স্ত্রী কিছু করে?”
“আগে শিক্ষকতা করত, এখন বাচ্চা নিয়ে করতে পারে না।”
“টাকা এখন দিতে হবে না, আগে বই প্রকাশিত হোক, কিছু মুনাফা কর, তারপর দেবে।”
আমি ইতস্তত স্বরে বললাম, “সেটা ঠিক আছে, কিন্তু শিল্পীর তো একটা সম্মান আছে, আর আপনি যত বড় মহান শিল্পী, আপনাকে সম্মানিত না করে আমি বই প্রকাশ করতে পারি না।”
অত বড় মানুষটাও আমার আকুলতার কাছে হার মানলেন। সম্মানীর অর্থ গ্রহণ করলেন। বললেন, “কলকাতায় গেলে যেন তাঁর বাসায় উঠি।”
প্রথম সাক্ষাতেই আমাকে লিখিত অনুমতি দিয়ে দিলেন। হুমায়ূন কবীর ঢালী ভাই তার ক্যামেরায় কয়েক প্রস্থ ছবি ওঠালেন। হোটেল রাজমণির দক্ষিণ পাশের বড় বড় জানালায় সকালের সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছিল। কালো কাচের পাল্লা দু’টি লাগিয়ে হোটেল রুমের বৈদ্যুতিক বাতিতে আবার ক্যামেরায় ক্লিক... ক্লিক...
একদিন ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইয়ের প্রুফ সংশোধন করতে গিয়ে একটু দ্বিধায় পড়লাম। কিছুতেই সুনীলদার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। তখন আমাদের শ্রদ্ধেয় কবি বেলাল চৌধুরীর শরণাপন্ন হয়েছি। উনি যোগাযোগের ব্যবস্থা করিয়ে দিলেন।
এরপর আর কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আমাকে দাদার সঙ্গে দু’বার কথা বলতে হয়নি। যখনই কোনো অসুবিধায় পড়েছি, ফোন দিলেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি রিসিভ করেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন। অত বড় একজন মানুষ, সাহিত্য আকাদেমীর প্রধান, কত ব্যস্ততা, তারপরও তিনি কখনো বিরক্ত হননি।
২০১১ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমার শ্বশুরমশায় কলকাতা গেছেন আরও বই প্রকাশের অনুমতিপত্র নিয়ে। যোগাযোগ করে জানতে পারলাম, তিনি কবিতার আমন্ত্রণে আফ্রিকা গেছেন। তিনি আগামী সপ্তাহে কলকাতায় আসবেন তাও বলেছেন। শ্বশুরমশায় বিভাস-এর চিঠি ও প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে সাক্ষাত্ করতে গেলে তিনি চিঠিতে (অনুমতিপত্র) স্বাক্ষর করে দিয়েছেন।
পুজোর আগের সপ্তাহে কথা বললাম সুনীলদার সঙ্গে। শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা হলো দীর্ঘক্ষণ। সবশেষে নতুন কয়েকটি বই প্রকাশের অনুমতি দেয়ার অনুরোধ জানালাম। কিছু সম্মানী-দক্ষিণা পাঠানোর মাধ্যম জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, এবার কেউ এলে (কলকাতায় গেলে) তার হাতেই পাঠিয়ে দিও। সঙ্গে নতুন বইগুলোর নামসহ চিঠিটাও।
ফোনেই জিজ্ঞেস করি, খুব শীঘ্র ঢাকা আসছেন কি?
উত্তরে বললেন, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না (আসবেন বলে ঠিক নেই)।
আজ আমার মনে হয় এই যে এতবড় মানুষটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, এত সহযোগিতা করেছেন, সেসব সত্যি নয়, যেন স্বপ্ন, মানুষ যে এত দয়াশীল হতে পারে, এত সহযোগিতামূলক মনের মানুষ হতে পারে তাঁকে না জানলে, না দেখলে আমার জানা-দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরপারে চলে গেছেন। তাঁর পরিবারবর্গ ছাড়া আর কার (ব্যক্তি) কি ক্ষতি হয়েছে জানি না, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণ হবে না। ছেলেবেলা থেকে তাঁর বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। মানুষের ভালো-মন্দকে বুঝতে শিখেছি, আধুনিকতা সম্পর্কে জেনেছি, তার সরাসরি সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য তাঁর স্নেহ-আনুকূল্য পাওয়া সবার কপালে জোটে না। আমি বাংলাদেশে বসবাস করেও তাঁর যে ভালোবাসা, পিতার স্নেহ পেয়েছি তাতে এমন আমার মনে হয় আমার জন্ম অন্তত এই একটা কারণে হলেও অনেকটা সার্থক।
আমাদের প্রকাশনা সংস্থা বিভাস প্রকাশিত/প্রকাশিতব্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের বই গুলো হচ্ছে : *নির্বাচিত ২০০ কবিতা *অর্ধেক জীবন *রাণু ও ভানু *আমি কেউ না *যুবক যুবতীরা *তিনটি উপন্যাস *জীবন যে রকম *ভয়ংকর সুন্দর *শিশু-কিশোর গল্প *ভালোবাসা, প্রেম নয় *ভয় পেয়ো না নীল মানুষ *পাঁচটি প্রেমের উপন্যাস *কবিতার জন্য সারা পৃথিবী *ছবির দেশে কবিতার দেশে *একটি মেয়ে অনেক পাখি *বরণীয় মানুষ স্মরণীয় বিচার *রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার এবং পুনরাবিষ্কার *অর্জুন *শ্রেষ্ঠ গল্প *সুনীল স্মরণে (হাসান হাফিজ সম্পাদিত)।
 
 সূত্র ঃ আমার দেশ, সাহিত্য সাময়িকী।

প্রথম নারী হিসেবে দ্বিতীয়বার বুকার জয়ী হিলারি ম্যানটেল

প্রথম নারী হিসেবে দ্বিতীয়বার বুকার জয়ী হিলারি ম্যানটেল

নু র জা হা ন রু না
বিশ্বে প্রথম নারী হিসেবে দ্বিতীয়বার সাহিত্যের অন্যতম সম্মানজনক পুরস্কার ‘দ্য ম্যান বুকার প্রাইজ ফর ফিকশন’ জয় করলেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক হিলারি ম্যানটেল। এ বছর ‘ব্রিং আপ দ্য বডিস’ উপন্যাসের জন্য তিনি এই পুরস্কার লাভ করেন। ‘ব্রিং আপ দ্য বডিস’ তার ‘উলফ হল’ উপন্যাসের সিক্যুয়াল। ‘উলফ হল’ উপন্যাসের জন্য তিনি ২০০৯ সালে প্রথমবার বুকার জয় করেছিলেন।
হিলারি ম্যানটেল এবং তার উপন্যাস নিয়ে পরে বলছি, আগে পাঠকের জানার সুবিধার্থে ‘বুকার’ পুরস্কার নিয়ে কিছু কথা।
ব্রিটেনের সাহিত্যে সর্বোচ্চ পুরস্কারের নাম ‘বুকার’ পুরস্কার। এর বর্তমান নাম ‘দ্য ম্যান বুকার প্রাইজ ফর ফিকশন’। ১৯৬৯ সালে বুকার পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। এর প্রবর্তক হচ্ছে যুক্তরাজ্যের বুকার ম্যাক কোলেন কোম্পানি। পুরস্কারের বর্তমান অর্থমূল্য ৫০ হাজার পাউন্ড। ১৯৬৯ সালে প্রথম বুকার পুরস্কার লাভ করেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক পার্সি হাওয়ার্ড নিউবে তার ‘সামথিং টু অ্যানসার ফর’ উপন্যাসের জন্য। প্রথম নারী হিসেবে বুকার বিজয়ী হচ্ছেন ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক বার্নিস রুবিনস তার ‘দি ইলেকটেড মেম্বার’ উপন্যাসের জন্য, ১৯৭০ সালে।
হিলারি ম্যানটেল ও তার সাহিত্যকর্ম
হিলারি ম্যানটেলের পুরো নাম হিলারি মেরী থম্পসন। ১৯৫২ সালের ৬ জুলাই ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারের গ্লোসপে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। হিলারি ম্যানটেলের বাবার নাম হেনরি থম্পসন এবং মা মার্গারেট থম্পসন। তাদের পূর্বসূরিরা আইরিশ হলেও হিলারির বাবা-মা ইংল্যান্ডেই জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় রোমান ক্যাথলিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবনের শুরু। হিলারির ১১ বছর বয়সে তার বাবা-মার বিচ্ছেদ ঘটে। তারপর হিলারির সত্ বাবা জ্যাক ম্যানটেলের পদবি গ্রহণ করে হিলারি ম্যানটেল নাম ধারণ করেন তিনি।
১৯৭০ সালে হিলারি ম্যানটেল আইন বিষয়ে পড়ার জন্য ‘লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স’-এ অধ্যয়ন শুরু করেন। পরে তিনি ‘ইউনিভার্সিটি অব শেফিল্ড’-এ স্থানান্তরিত হন এবং ১৯৭৩ সালে ‘জুরিসপ্রুডেন্স’ অর্থাত্ মানবিক আইনের বিজ্ঞান ও দর্শনে ব্যাচেলর ডিগ্রি অর্জন করেন।
গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার পর ম্যানটেল একটি হাসপাতালের সমাজকর্ম বিভাগে কাজ করেন এবং পাশাপাশি একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোরে বিক্রয় সহকারী হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭২ সালে হিলারি ম্যানটেল বিয়ে করেন। তার স্বামীর নাম গ্যারাল্ড ম্যাকইউয়েন। তিনি একজন জিওলজিস্ট। ১৯৭৪ সালে হিলারি ফরাসি বিপ্লব নিয়ে একটি উপন্যাস লেখা শুরু করেন, যা পরে ‘অ্যা প্লেস অব গ্রেটার সেফটি’ নামে প্রকাশিত হয়।
১৯৭৭ সালে হিলারি স্বামীর চাকরি সূত্রে বতসোয়ানায় পাড়ি জমান। পরে সেখান থেকে সৌদি আরবের জেদ্দায় গিয়ে থাকেন চার বছর। সে সময় ‘সামওয়ান টু ডিসটার্ব’ নামে তার একটি স্মৃতিকথা প্রকাশিত হয়। হিলারি ম্যানটেলের প্রথম উপন্যাস ‘এভরি ডে ইজ মাদার’স ডে’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। এর পরের বছরই এই উপন্যাসের সিক্যুয়াল ‘ভ্যাকেন্ট পজেশন’ প্রকাশিত হয়। এরপর আবার ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন তিনি। আসার পর ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে ‘দ্য স্পেকটেটর’ নামে চলচ্চিত্র সমালোচনা লেখা শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘এইট মান্থস অন গাজা স্ট্রিট’ উপন্যাসটি। যেখানে তিনি সৌদি আরবে তার প্রথম দিকের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেন। উপন্যাসটি ইসলাম ও পশ্চিমা মূল্যবোধের মধ্যে বিরোধ নিয়ে তার উদ্বেগকে উপজীব্য করে লেখা।
হিলারি ম্যানটেলের ‘ফ্লুড’ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৮৯ সালে। এই উপন্যাসটির জন্য একাধিক পুরস্কার লাভ করেন তিনি। এরপর ১৯৯২ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘অ্যা প্লেস অব গ্রেটার সেফটি’ উপন্যাসটি। যার জন্য তিনি ‘সানডে এক্সপ্রেস বুক অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কারটি অর্জন করেন। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘অ্যা চেঞ্জ অব ক্লাইমেট’ উপন্যাসটি। ‘অ্যান এক্সপেরিমেন্ট ইন লাভ’ হিলারির এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। যেটির জন্য তিনি ‘হথ্রনডেন প্রাইজ’ লাভ করেন।
এরপর ২০০৩ সালে ম্যানটেলের স্মৃতিকথা ‘গিভিং আপ দ্য ঘোস্ট’ প্রকাশিত হয়। যেটি ‘মাইন্ড’-এর ‘বুক অব দ্য ইয়ার’ পুরস্কার জয় করে। ওই বছরই তার ছোট গল্প সংকলন ‘লার্নিং টু টক’ প্রকাশিত হয়। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় তার ‘বিয়ন্ড ব্ল্যাক’ উপন্যাসটি, যা অরেঞ্জ পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা করে নেয়।
হিলারি ম্যানটেল ২০০৯ সালে ‘উলফ হল’ উপন্যাসের জন্য প্রথমবার বুকার পুরস্কার জয় করেন। আর এ বছর অর্থাত্ ২০১২ সালে ওই উপন্যাসেরই সিক্যুয়াল ‘ব্রিং আপ দ্য বডিস’-এর জন্য দ্বিতীয়বার বুকার অর্জন করে প্রথম নারী হিসেবে দুবার ‘দ্য ম্যান বুকার’ পুরস্কার জয়ের খেতাব অর্জন করেন।
২০০৯ সালে বুকার জয়ী হিলারি ম্যানটেলের ‘উলফ হল’ উপন্যাসটি ষোড়শ শতকের রাজা অষ্টম হেনরির উপদেষ্টা টমাস ক্রমওয়েলের জীবনের বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে রচিত।
গত ১৬ অক্টোবর লন্ডনের গিল্ড হলে দ্বিতীয়বার বুকার জয়ী হিলারি ম্যানটেলের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। পুরস্কার প্রাপ্তির পর উচ্ছ্বসিত ম্যানটেল মজা করে বলেন, ‘একটি বুকার লাভ করতে ২০ বছর লেগেছিল। আর দ্বিতীয়টি এত দ্রুত ভাবাই যায় না। আমি জানি, আজকের রাতে এখানে দাঁড়াতে নিজেকে কেমন সৌভাগ্যবান মনে হচ্ছে।’
এদিকে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হবে হিলারি ম্যানটেলের মহাকাব্যিক ত্রয়ী উপন্যাসের শেষ খণ্ড ‘দ্য মিরর অ্যান্ড দ্য লাইট’। এরই মধ্যে অনেকেই ধারণা করছেন, তিনি তৃতীয়বারের মতোও বুকার জয় করতে পারেন। তবে এ সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়ে ম্যানটেল দর্শক ও মনোনয়ন পাওয়া অপর লেখকের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার ত্রয়ী উপন্যাসের তৃতীয় ও শেষ খণ্ড লেখার জন্য আমাকে আবার লেখালেখিতে ফিরতে হবে। তবে আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি, ওই উপন্যাসের জন্য আমি আবারও এখানে দাঁড়াব, এ ধরনের কোনো আকাঙ্ক্ষা বা প্রত্যাশা আমার নেই।’

 সূত্র ঃ আমার দেশ, সাহিত্য সাময়িকী।

ভারতে হিন্দু মৌলবাদ কুিসতভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে

ভারতে হিন্দু মৌলবাদ কুিসতভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
(সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বয়স যখন ৭০, সে বছর ২০০৩ সালে তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশে। গিয়েছিলেন মাদারীপুরে, জন্মভিটায়। তখন নেয়া সাক্ষাত্কারের পুনর্মুদ্রণ।
- বি. স.)
সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ও জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন, ভারতে হিন্দু মৌলবাদ কুিসতভাবে মাথাচাড়া দিয়েছে। আমৃত্যু এর বিরুদ্ধে বলে যাব। একে আক্রমণ করব। মৌলবাদ দমনের জন্য যতটা চেষ্টা দরকার, ততটা হয় না। মুসলমানদের মধ্যেও মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা আছে। ও বিষয়ে আমি কিছু বলব না। আমি চাইব, মুসলমান লেখকরা তার বিরুদ্ধে বলুক। আমি নিজে বলে যাব হিন্দু মৌলবাদের বিরুদ্ধে।
নিজের পৈতৃক ভিটা, জন্মগ্রাম মাদারীপুরের মাইজপাড়া ও আমগ্রাম দেখার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সস্ত্রীক বাংলাদেশে আসেন গত ২৩ এপ্রিল ২০০৩ সালে। কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগে নয়াপল্টনের একটি হোটেলে ২ মে বৃষ্টিমুখর এক সকালে তাঁর সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতার সুযোগ হয়। তাঁর সঙ্গে বহু বিষয়ে কথা, মতবিনিময় হলো। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আমি আগেও বলেছি এখনও বলি, ভবিষ্যতে ঢাকাই হবে বাংলা সাহিত্যের রাজধানী। কারণ বাংলা ভাষাভাষীর সংখ্যা ও অন্যান্য কারণে প্রকাশনার মূল কেন্দ্রই হবে ঢাকা। এক সময় কলকাতা ছিল এই কেন্দ্র। শিক্ষার জন্য, চাকরির জন্য কলকাতায় ছুটতে হতো সবাইকে। এখন হলো তার উল্টা স্রোত। প্রকাশনার জগত্ ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই আরও ছড়িয়ে যাবে। প্রবাসী বাংলাভাষী লেখকরাও চাইবেন, ঢাকা থেকেই তাদের লেখা বই বের হোক।
সামপ্রতিক বিশ্বপরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি গভীরভাবে শঙ্কিত, উত্কণ্ঠিত। বললেন, ইরাকে মার্কিন-ব্রিটিশ আক্রমণ একটা ঘৃণ্য ব্যাপার। আমেরিকা বিশ্বজনমত, রাষ্ট্রসংঘকে গ্রাহ্য না করে যেটা করেছে, তা তিন শতাব্দী পিছিয়ে গিয়ে করেছে। তখন ছিল জোর যার মুল্লুক তার। এভাবে জয়ী হওয়া যায় না। আমেরিকাকে হারতেই হবে। হয়তো সময় লাগবে এতে। বিশ্বব্যাপী এই আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। নীতিগত প্রতিবাদ, সশস্ত্র নয়। খোদ আমেরিকায় হয়েছে, ইংল্যান্ডেও। জর্জ বুশ কোনো দিনই শান্তি পাবে না। ইতিহাস বুশকে আর্বজনায় নিক্ষেপ করবে।
বাংলাদেশের জননন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রস্তাব করেছেন। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, হুমায়ূনকে তার ঔদার্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি এ প্রস্তাবের কথা পড়ে অভিভূত হয়েছি। আমাকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দিলে তো বেশ ভালোই হয়, তখন আরও বেশি বেশি এ দেশে আসতে পারব। ঘরবাড়ি তুলে হয়তো বাস করব না এখানে, অভ্যেসটভ্যেস অনেকটা পাল্টে গেছে তো! নাগরিকত্ব যদি হয়, তো সেটা মাথায় করে রাখব।
ভারতীয় উপমহাদেশে সামপ্রদায়িকতা, মৌলবাদ, উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির উত্থান ও বিকাশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বিষয়টি আমাকে অত্যন্ত পীড়া দেয়, বিষণ্ন করে। ছোটবেলায় ভাবতাম, ২৫-৩০ বছর পর নতুন প্রজন্মের কেউ হয়তো এসব গ্রাহ্যই করবে না। কিন্তু তা হয়নি। কমে যাওয়ার বদলে ধর্মান্ধতা বরং বেড়েছে। এটি মনুষ্যসমাজকে পেছনে নিয়ে যায়। মানুষ যুক্তি হারিয়ে ফেলছে। সভ্যতাকে আমরা পিছিয়ে দিচ্ছি, এ কথাই মনে হয় বারবার। হয়তো আমার জীবদ্দশায় এর থেকে উত্তরণ দেখব না, কিন্তু আশা রেখে যেতে পারি যে, পরিস্থিতি একসময় বদলাবে। এ ব্যাপারে শুধু আশাই করতে পারি। আমি নিজে পরজন্ম, ভূত-ভগবান আর হোমিওপ্যাথিতে কোনো বিশ্বাস করি না।
মাদারীপুরের জন্মগ্রাম তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন ১০ বছর বয়সে, সেটা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়। তারপর এবার গেলেন সেখানে। এতকাল পর জন্মভূমিতে গিয়ে কেমন লেগেছে? এ প্রশ্নের উত্তরে বললেন, অনুভূতিটা মিশ্র। নিজের গ্রামের স্মৃতি আমার বেশ ভালোই মনে আছে। এবার গিয়ে কখনও মনে হয়েছে, ফিরে গিয়েছি বাল্যকালে। আবার কখনও মনে হয়েছে, বয়স্ক চোখে পরিবর্তন দেখছি। সব মিলিয়ে ভালো লাগার অনুভূতিটাই প্রধান। আমার কোনো আত্মীয়স্বজন এখন সেখানে নেই। এবার গিয়ে দেখলাম এলাহী আয়োজন। দেখে তো আমি ঘাবড়ে গিয়েছি। মনে হয়েছে, ওখানে অনেক আত্মীয়স্বজন আমার। তারা থাকতে বলেছেন, খেতে বলেছেন। তারা যে আন্তরিক ব্যবহার করেছেন, তাতে আমি অভিভূত, মুগ্ধ।
এবার মাদারীপুরের গ্রামে গিয়ে বড় ধরনের কী পরিবর্তন আপনার চোখে পড়ল? জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, অনেক বছর বাদে গেলাম তো! প্রায় অর্ধশতাব্দী। প্রধান পরিবর্তন হলো পরিবহন। আমরা জলপথে যেতাম, স্টিমারের পর নৌকায়। এখন সব রাস্তা হয়ে গেছে, সেতুও। দূরত্ব কমে গেছে। ছোটবেলায় মনে হতো, যাচ্ছি তো যাচ্ছিই, পথ বুঝি আর শেষ হবে না।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, বিশ্বায়ন মানুষকে সঙ্কুচিত করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, আগে অনেক দেশে যেতে ভিসা লাগত না। এখন কত কড়াকড়ি, নানারকম কাঁটাতারের বেড়া। এগুলো কী বিশ্বায়নের নমুনা? ভারত ও বাংলাদেশ কি আমেরিকা, কানাডার মতো প্রতিবেশী দেশ হতে পারত না? হয়নি। আমি যদি ভিসা ছাড়া আমার জন্মস্থানে আসতে পারতাম, কত খুশিই না হতাম।
এমন কোনো স্বপ্ন কি আপনার আছে, আজও যা পূর্ণ হয়নি? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আছে। তা হলো, অন্তত একটা ভালো লেখা। এ পর্যন্ত যা লিখেছি, তার কোনোটাই ভালো হয়নি। জানতে চাই, আপনার প্রকাশিত গ্রন্থ এখন পর্যন্ত কত? মৃদুু হেসে স্বভাবরসিক সুনীল বলেন, তিন শ’র বেশি হবে শুনেছি। শুনেছি বলছি, কারণ আমি নিজে জানি না। আমার স্মৃতিকথা ‘অর্ধেক জীবন’ এ বাংলাদেশের প্রসঙ্গ অনেকবার এসেছে।
‘ছেলেবেলায় নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম’
গত ২ মে ২০০৩ বৃষ্টিমুখর সকালবেলায় কথা হচ্ছিল সমকালীন বাংলা সাহিত্যের পাঠকনন্দিত সাহিত্যিক, কবি, কথাশিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। নয়াপল্টনের হোটেল অরচার্ড প্লাজায় উঠেছিলেন তিনি সে যাত্রা। বাংলাদেশে সস্ত্রীক এসেছিলেন মাদারীপুরে নিজের গ্রাম দেখতে। দেখার পর এসেছিলেন ঢাকায়। ওই সকালবেলাতেই তার বেশ কয়েকজন ভক্ত, অনুরাগী ভিড় জমিয়েছিলেন হোটেলে। তাদের সঙ্গ দিতে তিনি ব্যস্ত ছিলেন। সে জন্যে বিস্তারিত আলাপচারিতার সুযোগ ঘটেনি। ফাঁকে ফাঁকে যেটুকুই কথা হয়েছে, তা তুলে ধরা হলো টুকরো ধরনের এই সাক্ষাত্কারে। তাঁর বয়স ৭০ পূর্ণ হলো এ বছর, অর্থাত্ ২০০৩ সালে।
প্রশ্ন : আপনার চোখে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের কবিতার মৌলিক পার্থক্যগুলো কী?
উত্তর : বাংলাদেশে কবিতা নিয়ে উত্সাহ-উদ্দীপনা বেশি। বাংলাদেশে অনেক রাজনৈতিক উত্থান-পতনের ঘটনা ঘটেছে। কবিতায় সমসাময়িক ঘটনার ছাপটা বেশি। আর পশ্চিমবঙ্গের কবিদের মধ্যে ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার ঝোঁকটা বেশি। বাংলাদেশের অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশের কোন কোন কবির কবিতা আপনার ভালো লাগে?
উত্তর : অনেকের কবিতাই আমার ভালো লাগে। দু-চারজনের নাম বাদ পড়ে গেলে সেটা ঠিক হবে না। তারা দুঃখ পাবেন। সেজন্য নির্দিষ্ট করে কারও নাম উল্লেখ না করাই ভালো। আমি নিয়মিত বাংলাদেশের কবিতা পড়ি। খোঁজ রাখি।
প্রশ্ন : আমরা পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের লেখা সম্পর্কে যতটা জানি, খোঁজখবর রাখি, তার বিপরীতে কিন্তু ওরা এ ব্যাপারে আশ্চর্যরকম উদাসীন। দুই দেশের মধ্যে বই বাণিজ্যেও বড় ধরনের অসমতা আছে। এ প্রসঙ্গে আপনি কী বলবেন?
উত্তর : এই অভিযোগের খানিকটা সত্য। তবে ব্যবধান আস্তে আস্তে কমে আসছে। এই দ্যাখো না, সত্তর দশকের কবিদের দল উত্সব করেছে কলকাতায়, ঢাকায়। সেটার নাম সৌহার্দ্য কবিতা উত্সব। দুই দেশের আশির দশকের কবিরাও উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রশ্ন : আপনারা ষাটের দশকের কবিরা সে রকম কোনো উত্সবের উদ্যোগ আয়োজন করছেন না কেন?
উত্তর : ষাটের দশকের কবিরা বুড়ো হয়ে গেছে হে! উদ্যম কম তাদের মধ্যে।
প্রশ্ন : টেলিভিশন সাহিত্যের কতটা শত্রু, কতটা মিত্র? আপনার কী মনে হয় বলুন না!
উত্তর : টেলিভিশন একটা অবধারিত ব্যাপার। একে ফেরানোর উপায় নেই কোনো। কমিকস একসময় তোলপাড় তুলেছিল। বাবা-মা, অভিভাবকদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাচ্চারা কমিকস পড়ত। টেলিভিশনের ব্যাপারটাও অনেকটা সেই রকমই। এটাকে সবার মেনে নিতে হবে। আর এর মধ্যেই এসে গেল কম্পিউটার। এ থেকেও মুক্তি নেই আমাদের। আসলে সাহিত্যকে এসবের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে।
প্রশ্ন : ক্রমাগত ব্যাপক কম্পিউটারায়ন কী বইয়ের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে?
উত্তর : আগে আমাকে বলো, ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোয় শতকরা কতজনের কম্পিউটার আছে? বড়োজোর, শতকরা তিনজনের বাড়িতে। বেশি বেশি কম্পিউটার থাকলে না হয় এ প্রশ্নটা প্রাসঙ্গিক হতো। কম্পিউটারের ব্যাপক বিস্তারের ফলে কী হবে না হবে, এটা হলো পশ্চিমী জগতের চিন্তা। ভবিষ্যতে যদি দেশ সফল হয়, সবাই খেতে-পরতে পায়, দু’টি করে মোটরগাড়ি চড়তে পারে, তখন এ ভীতির প্রশ্ন আসবে। তার আগে নয়।
প্রশ্ন : আপনি কবি ও কথাশিল্পী। এই দুই সত্তার মধ্যে কি কোনো দ্বন্দ্ব আছে?
উত্তর : ঠিক জানি না। গল্প-উপন্যাস লিখতে পরিশ্রম বেশি হয়। অনেক সময় ইচ্ছে না থাকলেও লিখতে হয় আমাকে। গদ্য, ইচ্ছে না থাকলেও লেখা যায়। কবিতার ব্যাপারটি ভিন্ন। যখন ইচ্ছে হলো, লিখলাম। কবিতা লিখতেই খুব বেশি আনন্দ পাই। আর গদ্য লেখা শেষ হলে স্বস্তি।
প্রশ্ন : পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার ভবিষ্যত্ কী? সেখানে কী কোনোদিন ভাষা আন্দোলনের প্রয়োজন হবে?
উত্তর : হলেও হতে পারে। আমাদের দেশ ভারতে শিক্ষার বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে নয়। প্রত্যেক রাজ্যে শিক্ষার ব্যাপারটি তাদের নিজস্ব নীতিতে চলে।
প্রশ্ন : ছেলেবেলায় কী ভাবতেন, বড় হয়ে কী হবেন?
উত্তর : ছেলেবেলায় লেখক হবো ভাবিনি। নাবিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। নাবিক হওয়ার মধ্যে রোমান্টিক একটা ব্যাপার আছে। আমাদের ছোটবেলায় অনেক জাহাজ চলত। নাবিকদের সে জায়গা কিন্তু এখন পাইলটরা নিয়ে নিয়েছে।
প্রশ্ন : কলকাতায় বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যত্ কী?
উত্তর : বাংলা ভাষা অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। নতুন প্রজন্ম বাংলা শিখতে চাইছে না। পড়তে চাইছে না। আমরা এ অবস্থা পাল্টাতে আন্দোলন শুরু করেছি। তাতে আমরা দাবি করছি, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে চাকরি দেবে, তাতে বাংলা জানাটা বাধ্যতামূলক করতে হবে। আরও বলছি, বাংলায় চিঠি দিলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বাংলায়ই তার উত্তর দিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার এটা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গত পয়লা বৈশাখে বলেছেন, সরকারি কাজ সব বাংলায় চলবে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা : আত্মস্বীকারোক্তির শিল্পিত দলিল

অতএব ঘরছাড়া পথিক ফিরে এলেন আপন ঘরে। নিমগ্ন হলেন নিজস্ব লেখালেখিতে। আর এখানেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে এক চমত্কার সাদৃশ্য খুঁজে পাই আমরা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর জীবনের একটা বড় অংশ কাটিয়েছেন রাজধানী কলকাতার সব হৈ-হুল্লোড় ও রাজনৈতিক ডামাডোল থেকে অনেক দূরে। কখনও শিলাইদহ, কখনও পতিসর, কখনও শান্তিনিকেতন আবার কখনওবা বিদেশে। কিন্তু তবুও সমস্ত দূরত্ব অতিক্রম করে কখনও কখনও নিজেকে সঁপে দিতেন সেই রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্কভরা উত্তেজনার মধ্যে। উদাহরণ হিসেবে আমরা ‘বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন’-এর কথা বলতে পারি। সবকিছু ছেড়েছুড়ে একসময় কী মাতাটাই না মেতেছিলেন তিনি এই আন্দোলনে! কত কিছুই না করলেন। তারপর হঠাত্ একদিন সবকিছু পিছে ফেলে নিজের লেখার টেবিলে বসে রইলেন চুপচাপ। কেননা তখন তাঁর মনে হয়েছে রাজনীতি নিয়ে দাপাদাপি করা, দলবেঁধে রাস্তায় নেমে মিছিল-মিটিং কিংবা গান করা তাঁর কাজ নয়। কেননা তিনি কবি, তিনি লেখক। একমাত্র লেখাটাই তাঁর কাজ। একুশ শতকের প্রথম দশকে এসে সুনীল যা উপলব্ধি করলেন, উনিশ ও বিশ শতকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবদ্দশায় একাধিকবার তা অনুভব করেছেন। জীবনের অপরাহ্নবেলায় এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর চিন্তা ও উপলব্ধির সাদৃশ্য প্রবলভাবে অনুভব করলেও প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথকে এড়িয়ে অথবা অতিক্রম করে চলাই ছিল তাঁর কবিজীবনের সচেতন প্রয়াস। ফলে স্পর্ধিত যৌবনকালে তাঁর গায়ে রবীন্দ্রবিরোধীর তকমাও জুটেছিল। যেমন জুটেছিল বুদ্ধদেব বসুর ললাটেও। তবে ‘তিনজোড়া লাথির ঘায়ে রবীন্দ্ররচনাবলী লুটোয় পাপোষে’-এর মতো অবাক করা পঙিক্ত যখন লেখা হলো সুনীলের কবিতায়, কলকাতার রবীন্দ্রপ্রেমীদের কাছে তা ঈশ্বরদ্রোহিতার মতোই এক অমার্জনীয় অপরাধ বলে মনে হলো এবং রবীন্দ্রনাথ নয়—তত্কালের এই রবীন্দ্রপ্রেমীদের ওপরই ছিল সুনীলের যত রাগ।
আর আজকের পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে সেই রাগকে তো স্পষ্টতই মনে হয়। চল্লিশের দশকের শেষদিকে এসে ঘটেছিল ঘটনাটি। সুনীলের কণ্ঠে তখন রবীন্দ্রনাথের গান উঠেছে। সেই গান গেয়ে তখন তিনি খানিকটা খ্যাতিও অর্জন করেছেন। মহাজাতি সদনের একটা অনুষ্ঠানে এই সময় তাঁর দলের কাছে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ এলো। যথারীতি প্রস্তুত হয়েই তাঁরা সেখানে গেলেন। মঞ্চে উঠলেন এবং গান গাওয়া শুরু করলেন। হঠাত্ কিছু দর্শক তাদের আসন থেকে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন এবং ক্রমেই তাদের সঙ্গে যোগ দিতে লাগলেন আরও অনেকে। কিন্তু মঞ্চে সুনীলরা তখনও তার কোনো কারণ ধরতে পারছেন না। তাদের গাওয়া গানের কথা ও সুরের মধ্যে কোথাও তো কোনো ভুল নেই। তবে? কিছু বুঝতে না পেরে আরও মনোযোগের সঙ্গে তারা তাদের গান চালিয়ে যেতে লাগলেন। ওদিকে দর্শকরাও সমান তালে চেঁচাচ্ছেন। আগের চেয়ে তারা এখন অনেক বেশি উত্তেজিত। একেবারে মারমুখো। এর মধ্যে উদ্যোক্তাদের কয়েকজন এগিয়ে এসে তাদের অতি দ্রুত পেছনের দরজা দিয়ে বের করে দিলেন এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের সরে পড়তে বললেন। তারা সবাই হতচকিত এবং হতবিহ্বল। কী তাদের অপরাধ—জানতেই পারলেন না। তবে পরে জেনেছিলেন। গান তারা ঠিকঠাকই গাইছিলেন। কিন্তু তাদের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবির বদলে ছিল শার্ট-প্যান্ট। আর হলের উত্তেজিত শ্রোতা-দর্শকদের কাছে সেটাই ছিল অপরাধ। তাদের বিচারে শার্ট-প্যান্ট পরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ার অর্থ হলো রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত উভয়কেই অপমান করা। এবং এরাই ছিল তখনকার রবীন্দ্র সাহিত্য ও সঙ্গীতের ধারক, বাহক, রক্ষক। এই সংকীর্ণ ধ্যান-ধারণার রবীন্দ্রপ্রেমীদের সুনীলের মতো মুক্ত মনের মানুষ যে মেনে নিতে পারবেন না—সে তো খুবই স্বাভাবিক।
তবে তাই বলে যে ভাষাভঙ্গিতে কথা বলে গেছেন, কিংবা কবিতা লিখে গেছেন রবীন্দ্রনাথ—সে তো সম্পূর্ণই রবীন্দ্রনাথের। প্রতিটি কবি এবং কথাশিল্পীকেই তার নিজস্ব ভাষাভঙ্গি বা স্টাইল তৈরি করে নিতে হবে। গড়ে নিতে হবে নিজস্ব উপলব্ধি ও চেতনার একটা ভিন্ন জগত। দৃষ্টির স্বাতন্ত্র্য। সঙ্গত কারণেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে সুনীলের অনেক দূরত্ব।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার মাধ্যমেই পঞ্চাশের দশকের বাংলা, বিশেষত পশ্চিমবাংলার কবিতার একটি নিজস্ব চারিত্র্য গড়ে উঠেছিল। ফলে রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রযুগের কবিতার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই তার পার্থক্যগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠল। রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর অনুসারীরা তাঁদের কবিতায় কখনোই অমার্জিত কিংবা অশালীন শব্দকে প্রবেশাধিকার দিতেন না। দিতেন না তিরিশের কবিরাও। জীবনানন্দ দাশ তাঁর একটি কবিতায় এ ধরনের কয়েকটি শব্দ ব্যবহার করে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে তাঁর চাকরিটা খুইয়েছিলেন। কিন্তু পঞ্চাশের দশকে সুনীল ও তাঁর সহযাত্রীরা শালীন আর অশালীন শব্দের মধ্যবর্তী বিভাজন রেখাটিকেই গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য সচেষ্ট হয়ে উঠলেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানে ঈশ্বরের উপস্থিতি প্রশ্নাতীত। কিন্তু এরা তাকে করে তুললেন প্রশ্নসাপেক্ষ। শুভ সুন্দর ও কল্যাণের মূর্ত বাণীরূপই হলো রবীন্দ্রনাথের কবিতা। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর সময়ের ক্ষয়ক্ষতি গ্লানি অবিশ্বাস আর দেশবিভাগের যন্ত্রণায় এদের কবিতা রক্তাপ্লুত। রাজনীতি অথবা ঈশ্বর—কোথায়ও তাদের আস্থা নেই, আশ্রয় নেই। তবে এ যুগের ধূলিধূসর অথবা ঊর্মিমুখর কিংবা নিরাশ্রয়ী জীবনে নারীপ্রেমের মহিমা ও মর্যাদাকে তারা ছোট করে দেখলেন না। কিন্তু সেই দেখার ধরনটিও আবার রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা। রবীন্দ্রনাথ বরাবরই প্রেমকে জেনেছিলেন হৃদয়ের সামগ্রী। শরীর সেখানে কখনোই মুখ্য হয়ে ওঠেনি। কিন্তু সুনীল পুষ্পিত নারী শরীরকেই জেনেছেন প্রেমের আধার। সেই শরীর ছুঁয়ে ছুঁয়েই তাঁর প্রেম সন্ধান করেছে হৃদয়ের এবং সেই শরীর-কামনা কোথাও কোথাও এতই উদগ্র হয়ে উঠেছে যে, সমকালের সংস্কারমৃত-পাঠকরাও তাঁকে এক ‘সকাতর যৌন কামনার কবি’ বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। বন্ধু শঙ্খ ঘোষকেও লিখতে হয়েছে—‘সন্দেহ নেই যে তীব্র যৌনতা তাঁর কবিতার অন্যতম বড় ভর।’
যৌনতা এমন একটা মদ, যা খুব সহজেই মাতিয়ে তোলে নারী-পুরুষকে। আর তখনই সুরের মধ্যে ঢুকে পড়ে অসুর। ‘সুন্দর ফিরিয়া যায় অসহ্য লজ্জায় অপমানে।’ কিন্তু সুনীলের কবিতায় আশ্চর্যজনকভাবে সেই ছন্দপতনটি খুব কমই হয়েছে। কামনার মদির গন্ধ ছড়িয়ে সেখানেই থেমে থাকে না তাঁর কবিতা। পৌঁছে যায় হৃদয় মন্থন করা ভালোবাসার এক ঊর্ধ্বলোকে। তাঁর ‘নীরা’ তাই সহজেই হয়ে ওঠে পাঠকদের অতি আদরের মানসসঙ্গী। সময়ের অগ্রগমনের সঙ্গে সঙ্গে কিশোরেরা তরুণ হয়। তরুণেরা যুবক এবং যুবকেরা বৃদ্ধ। নতুন প্রজন্ম এসে জায়গা দখল করে পুরনোর। কিন্তু নীরা একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকে তার সেই সৌরভময় পুরনো অবস্থানে। একইভাবে আনন্দ ছড়ায়, বেদনা জাগায়, সৌন্দর্য বিলায় এবং মায়ার বিভ্রমে মাতায় প্রজন্মের পর প্রজন্মকে। দেহকে ছুঁয়ে ছুঁয়েই সে দেহাতীত, কালাতীত এবং মরণাতীত।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি কাব্যগ্রন্থের নাম— ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি’। এটি সুনীলের দ্বিতীয় কাব্য। এই কাব্যটিতেই সুনীল তাঁর কাব্যভাবনার নিজস্ব ভিত্তিভূমি রচনা করেছিলেন। খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর কবিযাত্রার সদর রাস্তা। সারাজীবন এই একই রাস্তা ধরে হেঁটেছেন তিনি। আর কখনোই কোনো দিকবদল করেননি। তাই দৃশত একটি কাব্যের নাম হলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর সব কাব্য এবং কবিতাই তাঁর বেঁচে থাকার ধরন-ধারণ, অভিজ্ঞতা ও অনুভবের শিল্পিত দলিল।
‘যেমন হওয়া ভাল’ কিংবা ‘যেমন হওয়া উচিত’— রবীন্দ্রনাথের সমগ্র জীবনের সাহিত্য সৃষ্টি এই বোধের আঙিনা থেকে উত্সারিত হয়েছে। তাই এর সঙ্গে মিশে আছে আদর্শবাদের উজ্জ্বল আলো। মিশে আছে কল্যাণ, শুভ ও সৌন্দর্যচেতনার আলোছায়া। কিন্তু সুনীলের যাত্রা ছিল এর ঠিক বিপরীতে। জীবন ও জগতের ব্যাপ্ত পরিসরে ‘যেমন হয়ে থাকে’— রবীন্দ্রনাথ তাঁর সকল ইন্দ্রিয়কে সজাগ রেখে তা দেখেছেন এবং ‘যেমন হওয়া ভালো’র দিকে তাকে পরিচালিত করেছেন। কিন্তু ‘কেমন হওয়া ভালো’ এই বোধ সুনীলকে মোটেই তাড়িত কিংবা চালিত করেনি। তার বদলে তিনি পরিচালিত হয়েছেন ‘যেমন আছি আমি’—তারই বর্ণনায় কবিতাকে শিল্পিত করে তোলার প্রেরণায়। ফলে তাঁর সমুদয় কবিতা হয়ে থাকল তাঁরই আত্মকাহিনীর প্রতিচিহ্ন। আত্মউপলব্ধির ধারাবিবরণী। আর এই পথে নিঃশঙ্ক যাত্রার প্রেরণাটি তিনি পেয়েছিলেন এ্যালেন গিনসবার্গের কাছ থেকে। তাঁর প্রথম কাব্য ‘একা এবং কয়েকজন’ প্রকাশের পর যখন তিনি কবিতাযাত্রার একটা নতুন ও নিজস্ব পথের সন্ধান করছিলেন, তখনই তাঁর হাতে পৌঁছেছিল গিনসবার্গের একটি চিঠি, যাতে লেখা ছিল—“যা কিছু তুমি অনুভব করো, তাকে ঠিক ঠিক বলে যাওয়াটাই হলো কবিতার কাজ, যেখানে থাকবে তোমার সকল রকম স্বীকারোক্তি, সমস্ত রকম অসন্তোষ, সমস্ত রকম উচ্ছলতা। ‘কী তোমার হওয়া উচিত’ সেদিকে কিছুমাত্র লক্ষ্য না রেখে কবিতা আজ জানতে চায় তুমি ঠিক কেমন।”
গিনসবার্গের এই কথাগুলো সুনীলের মনেও ছিল—অর্ধ উচ্চারিত কিংবা অর্ধ জাগর অবস্থায়। চমত্কারভাবে গিনসবার্গ তাকে জাগিয়ে দিলেন। সেই জাগর সত্তা সুনীলকে আর থামতে দেয়নি। তাই তিনি জীবনভর নিমগ্ন থেকেছেন কবিতার সাধনায়—যে কবিতা তাঁরই যাপিত জীবন আর সংকোচহীন স্বীকারোক্তির এক শিল্পিত দলিল। অর্ধশতাব্দীব্যাপী বিস্তৃত একটি যুগের পাঠক আগ্রহ ও আনন্দের সঙ্গে দেখলেন, সেসব স্বীকারোক্তি শুধু সুনীল নামের একজন ব্যক্তি মানুষের নয়, একই সঙ্গে তাদের জীবনেরও অনেক অভিজ্ঞতা ও অনুভবের নিকটাত্মীয়। অন্যের দর্পণে যখন নিজের ছায়া ভাসে, তখন সেই দর্পণটির জন্যও জেগে ওঠে এক ধরনের ভালোলাগা, ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার দর্পণ হয়েই সুনীলের কবিতা জায়গা করে নিয়েছে আমাদের ঘর ও মনে। আগামী প্রজন্মের কবিতাপ্রেমীরাও যত্ন করে মুখ দেখবে সেই দর্পণে।
বর্তমান সময়ের পাদপীঠে দাঁড়ানো একজন স্পর্শকাতর হৃদয়ের অধিকারী মানুষের জীবনযাপনের সমুদয় আনন্দ-বিষাদ, গ্লানি-উল্লাস এবং আলো-অন্ধকারকে প্রায় নির্বিচারভাবেই সুনীল তাঁর কবিতার বিষয়বস্তু করেছেন। নানা রঙে আঁকা ছবির মর্যাদা দিয়েছেন। সেসব ছবিতে বারবার ঘুরেফিরে আসতে দেখেছি আমরা একটি মুখকেই—সে মুখ বঙ্গোপসাগরের মতো বিশালতাময় ভালোবাসা বুকে ধারণকারী এক প্রেমিক কবির মুখ। আর তখনই নতুনভাবে উপলব্ধি করি, সুনীলের এই অন্তহীন এবং কাতর ভালোবাসা শুধু কোনো নারী কিংবা নীরার জন্য নয়, তা একইভাবে আকুল মাটি মানুষ দেশ নিসর্গ ও পৃথিবীর জন্যও। এবং ঘুরেফিরে, এবং বারবার—তাঁর প্রাণের গভীরে আসন বিছিয়ে রাখা রবীন্দ্রনাথের জন্যও। ‘প্রথম আলো’র সুবিস্তৃত পরিসর থেকে ‘রানু ও ভানু’র সংহত অবয়বে সেই ভালোবাসা খোদাই করা আছে কোজাগরী পূর্ণিমার জোছনা দিয়ে।
যেহেতু সুনীল অবিরাম লিখে গেছেন গদ্য-পদ্য দুই-ই, তাই তাঁর হাতে কবিতা কোথাও হয়ে উঠেছে মসৃণ গদ্য, আবার প্রবহমান গদ্য হয়ে উঠেছে কবিতার স্নিগ্ধ ছোঁয়ায় লাবণ্যময়। বাংলা সাহিত্যের এই দুই শক্তিশালী মাধ্যমের ভাষার মধ্যে বিরাজিত দীর্ঘ দূরত্বকে সুনীল তাঁর একক প্রয়াসেই একেবারে নিকটবর্তী করে রেখে গেলেন। আগামী দিনের সাহিত্যপ্রেমী মানুষের কাছে কিংবা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটাই কি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্যতম অবদান হিসেবে চিহ্নিত হবে? হয়তো বা।
আজ থেকে অর্ধশতাব্দী আগে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলা কবিতার নতুন পথ আর নতুন ভাষাভঙ্গির সন্ধানে যে নিঃসঙ্গ যাত্রা শুরু করেছিলেন, পঞ্চাশ বছরের দীর্ঘ সাধনায় তিনি তাকে পৌঁছে দিয়েছেন উত্কর্ষের বেলাভূমিতে। সেখানে কবিতার সমুদ্র আর গদ্যের পটভূমি পরস্পরের হাতে হাত রেখে এক অপূর্ব গতি ছন্দ লয় ও সুরের যুগলবন্দী গেয়ে যাচ্ছে। আর ক্রমাগত পরিচর্যার ফলে দুই ভিন্ন ঘরানা থেকে একত্রিত হওয়া যুগলও কী চমত্কারভাবে অভিন্ন সত্তা ও শৈলীর অধিকারী হয়ে উঠতে পারে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার সর্বশেষ দ্যুতিময় উদাহরণটি রেখে গেলেন এ বছরের শারদীয় ‘আমার সময়’ পত্রিকায়—‘কবিতার গল্প কিংবা গল্পের কবিতা’ শিরোনামের পৌনে চারশো পঙিক্তর এক অপূর্ব কবিতায়। একদিকে দুর্বার প্রেমাকাঙ্ক্ষা, অপরদিকে অঙ্কুশবিদ্ধ অপরাধবোধ—এই দুই ভিন্ন অনুভূতির টানাপোড়েনে গড়ে ওঠা এই দীর্ঘ কবিতার সমগ্র পরিসরে বেলোয়ারি চুড়ির টুংটাং আর কাঁঠালি-চাঁপার সুগন্ধ ছড়ানো আছে। আর তাতেই জুড়িয়ে যায় দীর্ঘ কবিতা পাঠের সব ক্লান্তি। মন ভরে ওঠে প্রেমের মোহমদিরায়। কবিতার মাধ্যমে গল্প বলা—সে তো প্রাচীন যুগ থেকেই চলে আসছে। কিন্তু একটি অনুপম কবিতা নিজেই যখন হয়ে ওঠে এক অনবদ্য গল্প অথবা বিপরীত বিচারে—একটি নিটোল গল্প শুধু ভাষাশৈলীর কারণে নিজেই হয়ে ওঠে শরত্ আকাশের সাদা মেঘের মতো কোমল সজল এবং নির্ভার কবিতা, তখন আমাদের চেতনা এবং অনুভবে জেগে ওঠে বিস্ময়বোধের প্লাবন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর এই বেলাশেষের উপহারে আমাদের অনেকটা বিমূঢ়ের মতোই দাঁড় করিয়ে রেখে গেলেন সেই বিস্ময়ের প্লাবনভূমিতে—কবিতাই গল্প, আবার গল্পই কবিতা।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা : আত্মস্বীকারোক্তির শিল্পিত দলিল

স র দা র আ ব দু স সা ত্তা র
নীরার সামান্য কোনো অসুখের সংবাদ শুনলেই মন খারাপ হয়ে যায় গোটা কলকাতার—সে তো অনেক আগেই আমরা জেনেছিলাম। কিন্তু সেই নীরার স্রষ্টার মৃত্যু-সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে জগত্-সংসারে কতখানি দুঃখের বাতাস আর্দ্র হয়ে ওঠে। কী পরিমাণ বেদনা ও কান্না জমা হতে পারে পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা তাঁর ভক্ত ও পাঠক মহলে—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সে বিষয়ে আমাদের কিছুই জানাননি। তবে কবির ‘মৃত্যু’ কবিতায় ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার বধ্যভূমিতে বাঁধভাঙা ভিড়ের ছবি বেশ যত্ন করেই এঁকেছিলেন তিনি। আর সেই ভিড়ের আকুলতা ও শোকবিহ্বলতার এক নতুন ছবি দেখলাম আমরা ২৫ অক্টোবর। দূরদর্শনের পর্দায় তা দেখা গেল—রবীন্দ্রসদন চত্বরে যখন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের শবাধারে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পালা চলছিল। আঁকাবাঁকা দীর্ঘ লাইন ধরে ক্রমাগতভাবে এগিয়ে চলা জনতার উপচে ওঠা ভিড় নিয়ন্ত্রণে পুলিশ তখন ব্যর্থ এবং অসহায়। অবস্থা সামাল দিতে ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ও মন্ত্রীদেরও তখন ভিড় নিয়ন্ত্রণে গলদঘর্ম হয়ে উঠতে দেখা গেল। একজন সাহিত্যিকের অন্তিম শ্রদ্ধা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানে ঢল নামা সাধারণ মানুষের ভিড় সামলাতে পথে নেমে পড়তে হয়েছে খোদ মন্ত্রীবর্গকে—বিষয়টি ভাবতেও ভালো লাগে। ভালো লাগে দেখতেও।
তবে আমাদের জন্য দেখার তখনও কিছু বাকি ছিল। টেলিভিশনের ক্যামেরা যখন সারবন্দী সাধারণ মানুষের লাইন ছেড়ে মরদেহ রাখার জন্য বিশেষভাবে তৈরি মঞ্চ ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার ওপর আলো ফেলল, তখন দেখা গেল সেখানে বেশ কাছাকাছি অবস্থানেই বিষণ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সবসময়ে যারা একে অপরের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং সেই কথার তাপ-উত্তাপ দ্বারা প্রভাবিত হয় গোটা রাজ্যের রাজনীতি, সেই দু’জন সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রাজনীতিবিদকে এক মঞ্চে দেখা যাবে—চোখে না দেখলে কেউই হয়তো তা বিশ্বাস করতেন না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁচে থাকাকালীন অবস্থায় কলকাতা শহরে বহু ধরনের কীর্তি কাহিনীর জন্ম দিয়েছেন। অনেক আপাত অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন। পার্থিব মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর সেই আশ্চর্য জাদুকরী ক্ষমতাটি যে নিঃশেষ হয়ে যায়নি, তাঁর শবাধারের পাশে একই বেদনায় বিনম্র হয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এক মঞ্চে দাঁড় করিয়ে সেই কথাটাই যেন সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন তিনি। তবে এখানেই শেষ নয়। বিস্ময়ের আরও একটা দৃশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আর তা দেখা গেল কেওড়াতলা অভিমুখী শ্মশানযাত্রীদের মিছিলে সবার সঙ্গে হেঁটে চলেছেন ক্ষমতাসীন মুখ্যমন্ত্রীও। একজন সাহিত্যিকের মৃত্যুতে শোককাতর জনতার সারিতে যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সশরীরে যোগ দেন, তাহলে সেটা একটা ভিন্ন মাত্রা পায় বৈকি।
সদ্য প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের শেষ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানে আমরা আমাদের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী নেত্রীর প্রতিনিধিকে দেখেছি। তাদের দেখিনি। দেখলে ভালো লাগত। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মত ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য ছিল অনেক। কিন্তু চমত্কার বন্ধুত্ব ছিল প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে। ১৯৬৪ সালে ঘটেছিল এই বন্ধুত্বের গোড়াপত্তন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে বিকশিত করলেও মূলত সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনেই তিনি খুঁজে পান তার প্রাণের মুক্তি। প্রাণের আনন্দ। তাই দু’জনের জীবনের বিভিন্ন ধরনের চড়াই-উত্রাই সত্ত্বেও তাদের বন্ধুত্ব ছিল অটুট। শোকে-দুঃখে, আনন্দে-বিষাদে দু’জনেই ছিলেন পরস্পরের কাছাকাছি। ২৩ তারিখ রাতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের আকস্মিক মৃত্যুতে কলকাতার একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল দিনভর রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন জনের যে শোকবার্তা প্রচার করছিল, সেখানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আর শঙ্খ ঘোষের দেয়া বাণী দু’টিতে যে তপ্ত প্রাণের উষ্ণতা এবং বেদনার শিশিরবিন্দু জমা হয়েছিল, তা অন্য বাণীগুলোতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বেশ খানিকটা বিস্ময়ের সঙ্গেই আমি তা লক্ষ্য করছিলাম।
কয়েকবছর আগে ২০০৭ সালের মার্চ মাসে নন্দীগ্রাম ট্র্যাজেডি নিয়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গ যখন উত্তাল, মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পনীতির বিরুদ্ধে সুযোগসন্ধানী রাজনীতিবিদ থেকে পেশাদার বুদ্ধিজীবী সবাই সোচ্চার, তখন কী দরদ আর সাহস নিয়েই না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর বন্ধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন! আনন্দবাজারের মতো একটি প্রভাবশালী ও কট্টর ডানপন্থী পত্রিকায় সেদিন তিনি দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লিখেছিলেন, ‘আমি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের শিল্পনীতির একশো ভাগ সমর্থক। কৃষিতে আনতে হবে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশের উন্নতি নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে। আকবর বাদশার আমলে একজন চাষীর যে রকম চেহারা বা পোশাক ছিল, ঠেঙ্গো ধুতি বা ছেঁড়া লুঙ্গি-গেঞ্জি থাক বা না থাক, খালি পা, রোগা ডিগডিগে চেহারা, এখনও সেই চেহারাই দেখি। সেই লাঙল। চিরকাল এ রকমই থাকবে?... চাষির তিন ছেলের মধ্যে যদি দুই ছেলে কারখানায় চাকরি করতে যায়, তাহলেই আর জমি ভাগ হয় না। তার অবস্থা কিছুটা সচ্ছল হতে পারে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ৭ মার্চ ২০০৭)।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যে শিল্পনীতিকে সেদিন তিনি দুস্থ কৃষক এবং রাষ্ট্রের ভাগ্যোন্নয়নের জন্য অপরিহার্য বলে মনে করেছিলেন, তার সপক্ষে সেদিন তিনি শুধু কলম ধরেই তৃপ্ত হননি, বক্তৃতা বিবৃতি মিছিল মিটিংয়েও সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছিলেন। ফলে বিরোধী শিবিরের নানা ধরনের তির্যক মন্তব্যের ধারালো তীরও তাঁর দিকে ছুটে আসছিল। কিন্তু তিনি তো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কোনো টীকা-টিপ্পনিই নীরবে মেনে নেয়ার মানুষ নন। তাই কোনো বিলম্ব না করেই জবাবে সেদিন লিখেছিলেন—‘যারা সরকার-বিরোধী প্রতিবাদে নেমেছেন, তাদের মধ্যে অনেক অগ্রগণ্য ব্যক্তির মনোভাবে বেশ ‘হোলিয়ার দ্যান দাউ’ মনোভাব দেখা যাচ্ছে। তারাই যেন আদর্শবাদী, স্বার্থত্যাগী, সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার বা সুবিধে পাওয়ার তোয়াক্কা করেন না। আর যারা প্রতিবাদের জন্য তাদের পাশে এসে দাঁড়াননি, তারা যেন সরকারের চাটুকার, সুবিধাবাদী ইত্যাদি। এটা বেশ মজার। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তরুণ মজুমদার এমনকি এই অধমেরও সরকারের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই, তা তারা বোঝেন না...।’ এসব তর্ক-বিতর্ক, বাদ-প্রতিবাদ ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এগুতে এগুতে সুনীল তাঁর নিজের মতো করে একটা চমত্কার উপস্থিতিতে পৌঁছে যান। আর সেই উপলব্ধিত সত্যের আলো দিয়ে সেরা মতামতটি প্রকাশ করতে গিয়ে লিখলেন—“আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, এই বামফ্রন্ট একবার পাঁচ বছরের জন্য বিরোধী আসনে গিয়ে বসলেই বোধ হয় ভালো হয়। তিরিশ বছরে ক্ষমতার একাধিপত্যে তাতে ক্লেদও জমে যায়। তলার দিকে ক্ষমতার ভোগী আস্ফাালন ও অর্থলোভ বেড়ে যায়। সেই সব খারাপ উপাদান থেকে মুক্ত হয়ে শুদ্ধ হয়ে তাঁরা আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুন। কিন্তু এই পাঁচ বছর ক্ষমতায় বসবে যারা, সেই বিকল্পের কথা ভাবলেই বিবমিষা হয়।...”
কিন্তু তাঁর এই খোলাখুলি মতামতকে সহজভাবে গ্রহণ করা বাম কিংবা ডান কোনো শিবিরের পক্ষেই সহজ ছিল না। তবু তিনি নিজের মতো করেই সারাজীবন ব্যক্ত করে গেছেন আপন মতামত। কে পছন্দ করল আর করল না—তা নিয়ে বিচলিত হতেন না। কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি নিজেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, রাজনৈতিক তর্ক-বিতর্ক আর হৈ-হল্লার মধ্যে সারাক্ষণ ডুবে থাকা—কোনো লেখকের জন্যই কাঙ্ক্ষিত কিংবা শুভ নয়। সব দলাদলি ও ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে লেখকের স্থান, বাগানের মালীর মতো একজন লেখক নিরন্তরভাবে তাঁর কলম থেকে কথার ফুল ফুটিয়ে থাকেন। তার কোনোটিতে অমোঘ সত্য, কোনোটিতে হাসি, কোনোটিতে কান্নাসহ বিবিধ অনুভূতির তাজা রঙ লেগে থাকবে—যা হার মানিয়ে দেবে বাগানের টকটকে রক্তগোলাপটিকে। আর এই উপলব্ধিকে অন্তরে ধারণ করেই তিনি লিখলেন—“আমি ঠিক করেছি, আমি আর কোনওদিন কোনও মিছিলে যাব না। আমি না গেলেও কারও কিছু যাবে আসবে না। আমি বাংলা ভাষার একজন সেবক, এখনও বিবেকের দংশন অসহ্য হলে লেখার মাধ্যমেই প্রতিবাদ জানাব, অথবা সমর্থন জানাব বন্ধুদের, পথে নামার প্রয়োজন নেই আমার।”