Friday, 8 March 2013

আমরা কর্তব্যহীন

আমরা কর্তব্যহীন

আমরা হাঁটছ, আমরা চলছ
আমরা যাচ্ছ কোথায়? আমরা নিজেরাও জানি না তা
একটুৃ একটু করে গড়ে তুলি সম্পদের পাহাড়
আর আমরা থাকতে চাই তার চূড়ায়
আমরা কি একটিবার ভাবি? ভাবি কি আমরা?
আসলে কি করছি আমরা? কিসের নেশায় ছুটে চলছি আমরা?
আমাদের ভেতরটাতেও এমন প্রশ্ন একটিবারও ওঠে না
আমরা নিজেরা জিততে চাই বার বার
কিন্তু আমরা তো জানি না যে আমরা যতটা না জিতে যাচ্ছি
তার চেয়ে বেশী আমরা
হারছি
আমাদের অন্তুরাত্মা আমাদের তা বুঝতে দেয় না
ওটা থাকে বাকহীন
আর দেখে আমরা কতই না কর্তব্যহীন।

Tuesday, 4 December 2012

শীত হালকা পরতে শুরু করে দিয়েছে। তাই কম্বল এর কোন প্রয়োজন পড়ে নি। আজ কেমন যেন একটু বেশী শীত অনুভূত হচ্ছে। একটা কম্বল টেনে যে গায়ে জড়িয়ে নেবে তা ও ইচ্ছা করছে না। শতি কেমন যেন তার উপর অবিচার করছে। শুধু যে শতি তা নয়, তার মতে তার সাথে অবিচার কওে চলেছে তার প্রকৃতি তার সাথে, যা সে স্বীকার করে মেনে নিতে পারে না, তবুও মানতে হয়।
সালেহা বেগম জানেন যে এটা তার একটা ভাগ্য। হোক না সেটা মন্দ ভাগ্য। পৃথিবীতে মানুষ জন্ম নেয় দুইটা ভাগ্য সাথে কওে নিয়ে তার মধ্যে দূভাগ্য হলো একটা ভাগ্য। যদিও এটাকে সকলে এড়িয়ে চলতে চায় তবুও এই ভাগ্যটা কারো পিছু ছাড়ে না। তবুও মানুষ এটাকে চায় না। তার কিছু মানুষ এটাকে এড়িয়ে চললেও এই ভাগ্যটা তার পিছু ছাড়ে না। এটা স্বয়ং স্রষ্ট্রার একটা দান। এটা আবার সবাই অর্জনও করতে পারে না। এই লজিক দাতা সালেহা বেগম নিজেই। যাই হোক। না চাইলেও মানুষ যেমন কিছু কিছু প্রাপ্তি অর্জন করে, এটাও ঠিক তেমন।
পাশের রুমে আলো জ্বলছে। কেন আলো জ্বলছে এত রাতে? তারা তো বিদ্যুৎ বিল ঠিকমত দেয় না।
তাহলে এমন কেন?
নাকি জরুরী কিছু একটা করছে?
এসব হাজারো প্রশ্ন তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। কি করবে সে তাও সে ভেবে পাচ্ছে না। এই সাবলেটটা নিয়েই যেন তার যত মরণ। কি দরকার ছিল এটা নিতে?
একটা ফাট সে একাই নিয়ে ভাড়া থাকত আগে। কিন্তু এই এত বড় রুমের ভেতর কেমন যেন একা একা বোধ কওে তাই তিন বছর ধরে একটা সাবলেট দিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে ওদেও খুব ভাল লাগে। আবার মাঝে মাঝে কেমন যেন  লাগে যে মন চায় ধরে তারিয়ে দিতে। যখন তাদের বাচ্চা দুইটা চেচামেচি করে।
এই বাচ্চাদের চেচামেচি তার ভাল লাগে না। না করাতে, না শুনতে। এই বাচ্চাদের কথা মনে পড়াতে তার মনে পড়ে গেল সেই পনের বছর আগের কথা।
তখনও ছিল সেটা শীতকাল। গায়ে কম্বল জড়ানো ছিল। তখন আর এমন একা তার দিনাতিপাত করতে হত না। আফজালের বুকের লোমে তার মুখ লুকানো ছিল। আচ্ছা বলতো আমাদের আগে কি সন্তান চাই?
জানি না। লজ্জায় লাল হয়ে গেল সালেহা বেগম।
আমি চাই একটা মেয়ে হোক আমাদের। কি বল তুমি?
ভালো লাগে না।
কি ভালো লাগে না তোমার?
জানি না।
এই জানি না এর মাঝে কত উত্তর লুকিয়ে আছে জান?
তাও জানি না।
আচ্ছা বিয়ে করলেই কি ছেলে-মেয়ে জন্ম দিয়ে বংশবিস্তার করলেই জীবনটা শেষ?
কি মনে হয় তোমার?
এানুষের জীবনে কি আর কোন পাওয়া থাকতে পারে না?
কি সেটা? একটু বিদঘুটে প্রশ্নটা আফজালের।
কোন চাওয়া
জানি না।
কিছুণ আবার চুপ কওে থাকে সালেহা। তারপর আবার সে বলে, দেখ একটা মানুষের জীবন শুধু বাচ্চা নেওয়ার উপরই চলে না। আর বাচ্চা কিসের ন্য চাই তোমার?
এর মানে কি বোঝাতে চাচ্ছ তুমি?
তুমি কি বাচ্চা নিতে চাও না?
আমি মোটেও তা বলিনি।
তবে।
নিব। তবে পরে অনেক পরে।
কত পরে হতে পারে তা?
তাছাড়া তুমি তো জান যে বাচ্চাদের কান্নাকাটি আমার একদম ভাল লাগে না। আমি ওটা একদম সহ্য করে পারি না।
আফজাল হাসে। সে বলে, দেখ নিজেরটা হলে ঠিক সব সয়ে যাবে। তার জন্য এত চিন্ত্ াকিসের তোমার?
মূহুর্তেই আফজালের সাথে ঘনিষ্টতা থেকে সে সড়ে যায়। আফজালও আর তার দিকে ফিওে ঘুমালো না। সে অন্যদিকে ফিওে দিল এক ঘুম। রাতটাই ব্যর্থ গেল।
আর এখনো সে পারল না একটা বাচ্চার মা হতে।
এই তো সেদিনের ঘটনা। সাবলেট এই মহিলার বাচ্চা কাদছিল। এই কান্নার শব্দ শুনে একদম খারাপ লাগলো তার।
এই আপনার বাচ্চা এভাবে কাদছে কেন?
কাদলে তো আর কিছু করতে পারি না। আমি তো থামানোর চেষ্টা করছি।
কি চেষ্টা করছেন আপনি? আর আমার সাথে আপনি তর্ক করলেন কেন?
কে করল?
আপনি তো করলেন?
দেখেন আমার আপনার সাথে ঝগড়া করার মত কোন ই্চ্ছা নেই।
আমার অনেক ইচ্ছা আছে আপনার সাথে ঝগড়া করার? না? আমি কি ঝগড়াটে মহিলা।
আপনি নিজের গায়ে টেনে কেন কথা বলছেন? কে বলেছে আপনাাকে এসব?
আজব মহিলা তো। বেয়াদব। একদম ফাষ্ট কাস বেয়াদব। তাই কো স্বামীর সাথে এত ঝগড়া হয় প্রতি রাতেই। আমি কি শুনি না?
আপনি কি শোনেন? আপনার মত তো আর বাচ্চা না নিতে পেওে স্বামী ছাড়ি নি।
এই কথাটা শোনার পর তার মেজাজটা ১০০% খারাপ হয়ে গেল। কি যেন আবার ভেবে চুপ হয়ে গেল। আসলে আগে যদি এমন বুঝত যে এমন কথা শুনতে হবে কারো তাহলে অন্তত একটা বাচ্চা নিত ্আর আফজালকেও ত্যাগ করতে হত না।
বেচারা তো ছিল অনেক ভাল। নিজেই তাকে ত্যাগ করলো।
নিজের দোষে।
হুমমম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কিছুণ আবার চুপ করে থেকে কি যেন ভাবতে থাকে। পাশের রুমের লাইটটা অফ হয়ে গেছে। ওরা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। এখন কি কববে তাই ভাবছে। লাইটের সুইচটা অন করে দেয়। ঘরে একটু আলোর আভাস ভেসে আসে। ওয়ারড্রপের কাছে গিয়ে চাবিটা হাতে নিয়ে দাড়ায় সে। ওটা খুলতে ইচ্ছা কওে না।
ড্রেসিং টেবিলের কাছে এসে দাড়ায়। আয়নায় নিজের শশীরটা একটু দেখে নেয়। নেই।
আর আগের মতন সেরকম নেই। বয়স ও তো কম হলো না। বয়সের কাছে তো সবকিছু হার মানে। তবে সবকিছু যে শেষ হয়ে গেছে তাও নয়। পেটে মেদ জমেছে। আগের চেয়ে অনেক মোটাও হয়েছে। শশীরের চামড়া কেমন যেন একটা ভাজ পড়েছে। জোর করে পারা যায় না শশীরের সাথে এটে লাগানো। দুটি চোখের নিচে দাগ পড়ে গেছে। কালো সে দাগ। মনে হয় যেন অনেক রাত ঘুম হয় না তার। কিন্তু আসলেও তা না।
আফজালের সাথে ছাড়াছাড়ি হলো কতদিন হবে?
ঠিক মনে আসছে না। তের বছর পর না কি চৌদ্দ বছর?
তারপর
এরপর থেকে শুধু জীবন-যাপন। একটা দিনও সুখ ছিল না সে জীবনে। না এসেছে স্বামীর সোহাগ। আর । আর কিসের যেন একটা অভাব তার ভেতর সবসময় থেকেই যায়। এটাকে কোন ভাবে দমন করতে পাওে না।
শীত হালকা পরতে শুরু করে দিয়েছে। তাই কম্বল এর কোন প্রয়োজন পড়ে নি। আজ কেমন যেন একটু বেশী শীত অনুভূত হচ্ছে। একটা কম্বল টেনে যে গায়ে জড়িয়ে নেবে তা ও ইচ্ছা করছে না। শতি কেমন যেন তার উপর অবিচার করছে। শুধু যে শতি তা নয়, তার মতে তার সাথে অবিচার কওে চলেছে তার প্রকৃতি তার সাথে, যা সে স্বীকার করে মেনে নিতে পারে না, তবুও মানতে হয়।
সালেহা বেগম জানেন যে এটা তার একটা ভাগ্য। হোক না সেটা মন্দ ভাগ্য। পৃথিবীতে মানুষ জন্ম নেয় দুইটা ভাগ্য সাথে কওে নিয়ে তার মধ্যে দূভাগ্য হলো একটা ভাগ্য। যদিও এটাকে সকলে এড়িয়ে চলতে চায় তবুও এই ভাগ্যটা কারো পিছু ছাড়ে না। তবুও মানুষ এটাকে চায় না। তার কিছু মানুষ এটাকে এড়িয়ে চললেও এই ভাগ্যটা তার পিছু ছাড়ে না। এটা স্বয়ং স্রষ্ট্রার একটা দান। এটা আবার সবাই অর্জনও করতে পারে না। এই লজিক দাতা সালেহা বেগম নিজেই। যাই হোক। না চাইলেও মানুষ যেমন কিছু কিছু প্রাপ্তি অর্জন করে, এটাও ঠিক তেমন।
পাশের রুমে আলো জ্বলছে। কেন আলো জ্বলছে এত রাতে? তারা তো বিদ্যুৎ বিল ঠিকমত দেয় না।
তাহলে এমন কেন?
নাকি জরুরী কিছু একটা করছে?
এসব হাজারো প্রশ্ন তার মনে ঘুরপাক খেতে থাকে। কি করবে সে তাও সে ভেবে পাচ্ছে না। এই সাবলেটটা নিয়েই যেন তার যত মরণ। কি দরকার ছিল এটা নিতে?
একটা ফাট সে একাই নিয়ে ভাড়া থাকত আগে। কিন্তু এই এত বড় রুমের ভেতর কেমন যেন একা একা বোধ কওে তাই তিন বছর ধরে একটা সাবলেট দিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে ওদেও খুব ভাল লাগে। আবার মাঝে মাঝে কেমন যেন  লাগে যে মন চায় ধরে তারিয়ে দিতে। যখন তাদের বাচ্চা দুইটা চেচামেচি করে।
এই বাচ্চাদের চেচামেচি তার ভাল লাগে না। না করাতে, না শুনতে। এই বাচ্চাদের কথা মনে পড়াতে তার মনে পড়ে গেল সেই পনের বছর আগের কথা।
তখনও ছিল সেটা শীতকাল। গায়ে কম্বল জড়ানো ছিল। তখন আর এমন একা তার দিনাতিপাত করতে হত না। আফজালের বুকের লোমে তার মুখ লুকানো ছিল। আচ্ছা বলতো আমাদের আগে কি সন্তান চাই?
জানি না। লজ্জায় লাল হয়ে গেল সালেহা বেগম।
আমি চাই একটা মেয়ে হোক আমাদের। কি বল তুমি?
ভালো লাগে না।
কি ভালো লাগে না তোমার?
জানি না।
এই জানি না এর মাঝে কত উত্তর লুকিয়ে আছে জান?
তাও জানি না।
আচ্ছা বিয়ে করলেই কি ছেলে-মেয়ে জন্ম দিয়ে বংশবিস্তার করলেই জীবনটা শেষ?
কি মনে হয় তোমার?
এানুষের জীবনে কি আর কোন পাওয়া থাকতে পারে না?
কি সেটা? একটু বিদঘুটে প্রশ্নটা আফজালের।
কোন চাওয়া
জানি না।
কিছুণ আবার চুপ কওে থাকে সালেহা। তারপর আবার সে বলে, দেখ একটা মানুষের জীবন শুধু বাচ্চা নেওয়ার উপরই চলে না। আর বাচ্চা কিসের ন্য চাই তোমার?
এর মানে কি বোঝাতে চাচ্ছ তুমি?
তুমি কি বাচ্চা নিতে চাও না?
আমি মোটেও তা বলিনি।
তবে।
নিব। তবে পরে অনেক পরে।
কত পরে হতে পারে তা?
তাছাড়া তুমি তো জান যে বাচ্চাদের কান্নাকাটি আমার একদম ভাল লাগে না। আমি ওটা একদম সহ্য করে পারি না।
আফজাল হাসে। সে বলে, দেখ নিজেরটা হলে ঠিক সব সয়ে যাবে। তার জন্য এত চিন্ত্ াকিসের তোমার?
মূহুর্তেই আফজালের সাথে ঘনিষ্টতা থেকে সে সড়ে যায়। আফজালও আর তার দিকে ফিওে ঘুমালো না। সে অন্যদিকে ফিওে দিল এক ঘুম। রাতটাই ব্যর্থ গেল।
আর এখনো সে পারল না একটা বাচ্চার মা হতে।
এই তো সেদিনের ঘটনা। সাবলেট এই মহিলার বাচ্চা কাদছিল। এই কান্নার শব্দ শুনে একদম খারাপ লাগলো তার।
এই আপনার বাচ্চা এভাবে কাদছে কেন?
কাদলে তো আর কিছু করতে পারি না। আমি তো থামানোর চেষ্টা করছি।
কি চেষ্টা করছেন আপনি? আর আমার সাথে আপনি তর্ক করলেন কেন?
কে করল?
আপনি তো করলেন?
দেখেন আমার আপনার সাথে ঝগড়া করার মত কোন ই্চ্ছা নেই।
আমার অনেক ইচ্ছা আছে আপনার সাথে ঝগড়া করার? না? আমি কি ঝগড়াটে মহিলা।
আপনি নিজের গায়ে টেনে কেন কথা বলছেন? কে বলেছে আপনাাকে এসব?
আজব মহিলা তো। বেয়াদব। একদম ফাষ্ট কাস বেয়াদব। তাই কো স্বামীর সাথে এত ঝগড়া হয় প্রতি রাতেই। আমি কি শুনি না?
আপনি কি শোনেন? আপনার মত তো আর বাচ্চা না নিতে পেওে স্বামী ছাড়ি নি।
এই কথাটা শোনার পর তার মেজাজটা ১০০% খারাপ হয়ে গেল। কি যেন আবার ভেবে চুপ হয়ে গেল। আসলে আগে যদি এমন বুঝত যে এমন কথা শুনতে হবে কারো তাহলে অন্তত একটা বাচ্চা নিত ্আর আফজালকেও ত্যাগ করতে হত না।
বেচারা তো ছিল অনেক ভাল। নিজেই তাকে ত্যাগ করলো।
নিজের দোষে।
হুমমম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কিছুণ আবার চুপ করে থেকে কি যেন ভাবতে থাকে। পাশের রুমের লাইটটা অফ হয়ে গেছে। ওরা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। উঠতে ইচ্ছা করছে না। এখন কি কববে তাই ভাবছে। লাইটের সুইচটা অন করে দেয়। ঘরে একটু আলোর আভাস ভেসে আসে। ওয়ারড্রপের কাছে গিয়ে চাবিটা হাতে নিয়ে দাড়ায় সে। ওটা খুলতে ইচ্ছা কওে না।
ড্রেসিং টেবিলের কাছে এসে দাড়ায়। আয়নায় নিজের শশীরটা একটু দেখে নেয়। নেই।
আর আগের মতন সেরকম নেই। বয়স ও তো কম হলো না। বয়সের কাছে তো সবকিছু হার মানে। তবে সবকিছু যে শেষ হয়ে গেছে তাও নয়। পেটে মেদ জমেছে। আগের চেয়ে অনেক মোটাও হয়েছে। শশীরের চামড়া কেমন যেন একটা ভাজ পড়েছে। জোর করে পারা যায় না শশীরের সাথে এটে লাগানো। দুটি চোখের নিচে দাগ পড়ে গেছে। কালো সে দাগ। মনে হয় যেন অনেক রাত ঘুম হয় না তার। কিন্তু আসলেও তা না।
আফজালের সাথে ছাড়াছাড়ি হলো কতদিন হবে?
ঠিক মনে আসছে না। তের বছর পর না কি চৌদ্দ বছর?
তারপর
এরপর থেকে শুধু জীবন-যাপন। একটা দিনও সুখ ছিল না সে জীবনে। না এসেছে স্বামীর সোহাগ। আর । আর কিসের যেন একটা অভাব তার ভেতর সবসময় থেকেই যায়। এটাকে কোন ভাবে দমন করতে পাওে না।

Tuesday, 6 November 2012

গল্পের ফেরিওয়ালা

গল্পের ফেরিওয়ালা

নয়ন রহমান
তারিখ: ২ নভেম্বর, ২০১২
গল্পের ফেরিওয়ালা
দুপুরের ভাতঘুমটা কলবেলের তীèস্বরে ছই-ছৎকার হয়ে যায় রুমানার। একবার। দু’বার। তিনবার।
নাহ। আর শুয়ে থাকা যায় না।
চোখের সামনেই দেয়ালঘড়ি। বেলা তিনটা।
এ অসময়ে কে এলো?
বুয়া তো কলবেল কেন কানের কাছে বোমা ফাটলেও সাড়া দেবে না। ওর ঘুমটা একটু বেশি। ঘুম ভাঙলেও ঘটকা মেরে শুয়ে থাকে। রুমানা তাড়াতাড়ি উঠে ‘আই হোল’-এ চোখ রেখে দরজা খুলে দেয়। তুমি  অসময়ে?
আম্মা, আমাগো আবার সময় অসময় কী? আর আপনের কাছে আইতে তো আমার পরান তড়পাইতেছে হেই বিহান থাইক্যা।
এসো, ভেতরে এসো।
আম্মা, আইজ একখান জব্বর খবর আছে।
জব্বর খবর, সে আবার কী?
আম্মা, ছেরি পলাইছে।
কে?
ক্যান, যে ছেরির বিয়াত আপনে শাড়ি দিলেন, জামাইরে পায়জামা-পাঞ্জাবি দিলেন?
জোছনা?
হ আম্মা, জোছনা পলাইছে।
সেকি ওর মা তো বলেছিল জোছনা আজ শ্বশুরবাড়ি যাবে।
যাইবে না। হেই লাইগাই তো পলাইছে।
রুমানা ড্রইংরুমের ফ্যান খুলে দিয়ে বলে, বসো।
আম্মা, বুয়া নাই?
ঘুমায়।
হ, কপাল লইয়া আইছে আপনের বুয়া। আম্মা, এট্টু পানি খাইয়া আহি পাকঘর থাইকা।
না। তুমি বসো। আমি দিচ্ছি।
রুমানা এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি আর দু’খানা বিসকিট এনে দেয়। ‘আম্মা, আপনের দয়ার শরীল। হেই ভুঁইয়াপাড়া থাইক্যা হাঁইট্যা আইছি। আম্মা, আইজ আপনেরে একখান জবর খবর দিমু কইছি না?
ঠিক আছে। আগে স্থির হও।
আম্মা, ছেরি হেই ব্যান বেলাই ঘর থাইকা বাইর হইয়া গেছে। অহনও ফেরে নাই। খোঁজতে খোঁজতে হককলে হয়রান হইয়া গেছে। বাপ-মায়ের তো পাগল হইবার দশা। কী ধুমধাম কইরা বিয়া হইলো।
হউর বাড়ি গেলো। আবার আইলো। আমিও তো ছেরির লগে গেছিলাম। কী বড় গেরস্থ। দুইডা মাছের পুষ্কুনি। দুইডা গাই গরু। ধানী জমি। ছেরির মনে ধরলো না।
তা কার সাথে পালিয়েছে?
আম্মা, আপনে যেন কিছু বোঝেন না। পলাইছে ঐ ছেরার লগে।
সে কি?
হ, আম্মা, ওই ছ্যারা অরে বিয়া করতে চাইছিল। আর বাপ-মা কয়, মাইয়া ছোড। অহন বিয়া দিমু না, ছেরা এক দোকানে কাম করে। ঐ বস্তিতেই থাকে। আপনেও তো কইছেন, মাইয়ার অহন বিয়া দিও না। অর বিয়ার বয়স হয় নাই।
ঠিকই বলেছিলাম বুয়া। জোছনার মাত্র এগারো বছর বয়স। এ বয়সে বিয়ে দেওয়া যায় না। সরকার তো বাল্যবিয়ে নিষিদ্ধ করেছে। তয় অহন মাইয়ারে বিয়া দিলো কেমনে?
বিয়ে হয়ে যাবার পর আমি শুনেছি।
হ, আপনেরে আগে জানায় নাই। জামা-কাপুড় পাওনের লাইগা আপনের কাছে আইছে। বস্তির মানুষে চান্দা তুইল্যা বিয়ার খাওন দাওনের বেবস্তা করছে। অহন হগগলে পাগলের মতন জোছনারে খোঁজতাছে। ওই ছেরারে পাইলে এমন মাইর দিবো… হু। আম্মা, সুখের সংসার ছাইড়া মাইয়াডা আগুনে ঝাঁপ দিছে।
সোনার সংসার ছেড়ে জোছনা আগুনে ঝাঁপ দিলো কেন?
আম্মা, হাচা কতা কই? জোছনা মইষের মতো কালা সোয়ামীরে পছন্দ করে নাই। জোছনারে তো আপনে দেখছেন। পরীর মতন সোন্দর। সোন্দর দেইখা অরে পছন্দ করছে অর হউরে। অর মায়ে বাসা-বাড়িতে কাম করে। বাপে রিশকা টানে। এইগুলান অর হউর কিছু মানে নাই। ছেরিরে লইয়া কই পলাইছে কেডা জানে।
এসব কথা বাদ দাও। আমার কাছে ওর বাবাকে আসতে বলবে। আমি ওকে থানায় পাঠাব। পুলিশের অসাধ্য কিছু নাই। পুলিশ খুঁজে বের করবে।
আম্মা, কী যে কন। পুলিশ খুঁইজ্যা বাইর করবে?
করবে। কোথায় পালিয়ে থাকবে?
আম্মা, জোছনার বাপ যাইবে না। থানা পুলিশরে ডরায়। আর আপনের কথা মতো থানায় গেলে জোছনার বাপে ফাঁইস্যা যাইবে, হের হাতে হাতকড়া পরবো।
তাই? কেন?
বুয়া একটু মুখ বাঁকিয়ে হেসে বলল, আম্মা, আপনে এত লেহাপড়া মানুষ, আপনে এডা জানেন না যে মাইয়া সাবাল্লক না অইলে বিয়া দেওন যায় না? হুনছি সরকারে তো আইন করছে মাইয়ার বিয়ার বয়স হইবে আঠার বচ্ছর। আর পোলার বাইশ বচ্ছর। এই বয়স না হইলে বিয়া দেওন যাইবে না, উল্টা জেল খাটতে হইবে।
তুমি দেখছি সবই জানো।
জানুম না? টাউনে থাহি। রেডিও-টেলিভিশন দেহি। মানষে কওয়াকওয়ি করে। গেরামে পলাইয়া পলাইয়া বিয়া অয়, ধরা পড়লে সোজা জেল, থাউগ্যা আম্মা। অহন আমার গলা হুগাইয়া গেছে। আপনের বুয়া কই? আমারে এট্টু চা খাওয়াইলে ভালো হইবো?
বুয়াÑ ও বুয়া ওঠো। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এখনো তোমার ঘুম ভাঙলো না?
পৃথুলা বুয়া হাই দিতে দিতে এসে বলে, আম্মা গো, ঘুমাইবার কি জো আছে? এই কতরয়্যা বেডির কতায় তো কানের পোক বাইর হইয়া যাইবার দশা। এই বেডি, এই দুফুরে কেউ কতা ফেরি করতে আহে?
হাগো বুজান, আমি কতা ফেরি করি আবার কামও করি। আমাগো কি সময় অসময় বাইছ্যা চলনের জো আছে? আর আইছি তো আম্মার ধারে। তোমার ধারে তো আহি নাই? এই হগলের মর্ম তুমি বুঝবা না। যে বোঝার হেয় বুঝবে।
থাকÑ কথা বাড়িও না। আমেনার মা, চোখেমুখে পানি দিয়ে এসো। ফ্রিজে সেমাই আছে, ওকে দাও। আর চা করো। বেলা একদম পড়ে গেছে।
দিতাছি আম্মা। আহাদের চাকরি করেÑ হাত-পাও লাড়াইতে অয় না, মুখ লড়াইয়া ট্যাহা কামায়।
বুজান, তুমি এইর মর্ম বুঝবা না। মুখ লাড়াইতেও কষ্ট অয়। মুখে ফেনা ওডে। এই আম্মারে আমি ভালোবাসি। হ্যার ধারেই প্যাডের কতা কই। ঘুইর‌্যা ঘুইর‌্যা কতা জোগাড় কইরা আনি। আমার দুই পয়সা লাভ অয়। হেরও অয়।
আমি বিস্মিত হয়ে বলি, কী বলছ তুমি? আমার দু’পয়সা লাভ হয় মানে কী?
একগাল হেসে আমিনার মা বলে, ক্যান আম্মা, আপনে এই কতা সোন্দর কইরা লেইখ্যা কাগজে ছাপাইতে দ্যান না? কাগজওয়ালারা আপনেরে ট্যাহা দেয় না?
আমিনার মা, গল্প ছাপা হলেই সব পত্রিকা থেকে টাকা পাওয়া যায় না।
তয় ল্যাহেন কা আম্মা? ট্যাহাই যুদি না দিবো তয় হেগো ধারে আপনে গল্প ফেরি করেন ক্যা?
আমি গল্প ফেরি করি? কে বলল তোমাকে?
আমি জানি আপনে কত পেপারে গল্প লেহেন, আমি কত মাইনষের ধারে আপনের কতা কইছি! হুনছিও।
ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। এখন বলো তো জোছনার বিয়ের কাবিন হয়েছিল? রেজিস্ট্রি হয়েছিল?
হেই কতা তো কইতে পারুম না। তয় কাবিন অয় নাই।
কাবিন হয়নি? তাহলে কেমন বিয়ে হলো?
মুখে মুখে বিয়া হইছে। লেহাপড়া কিছু অয় নাই, মৌলভী কইছে আমি কাবিন করতে পারমু না। তোমাগো পোলা-মাইয়া দুইজনেই নাবাল্লক। জানাজানি হইলে আমারই জেল হইবে।
মৌলভীর হাত-পায়ে ধরছিল অরা, আপনে লেইখা দ্যান, মাইয়ার বয়স আঠারো, পোলার বয়স বাইশ বছর।
মৌলভী রাজি অয় নাই। অরা মৌলভীরে ট্যাহাও দিতে চাইছে।
মৌলভী কইছে আমি জেলের ভাত খাইতে পারুম না। তোমরা আমারে আইডি কার্ড আইন্যা দেখাও।
হেরা আইডি কার্ড পাইবো কই?
মাইয়া-পোলার বাপে তো গ্যারাকলে পড়ছে।
কেউ কেউ পরামিশ দিছিল, পয়সা খরচ কইরা আইডি কার্ড করাও, পয়সা দিলে এক ঘণ্টার মধ্যে আইডি কার্ড পাইয়া যাইবো।
পয়সা খরচ করলেই আইডি কার্ড করানো যায়?
আম্মা, পয়সা খরচ করলে বাঘের দুধও পাওয়া যায়।
আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বুয়া।
মাথা খারাপের কিচ্ছু নাই আম্মা, ট্যাহা খরচ কইরা কত মানষে মুক্তিযুদ্ধার সার্টিফিকেট নিছে। যে পোলারা হেই গণ্ডগোলের সময় জন্মায় নাই, হেরাও কয় আমি মুক্তিযোদ্ধা।
বুয়া, ‘গণ্ডগোলের সময় বলবে না, বলবে, মুক্তিযুদ্ধের সময়।
অই হইলো একটা কথা।
না, তুমি কখনো বলবে না ‘গণ্ডগোলের সময়।’
হ, আম্মা, মনে রাখুম, আমরা অশিক্ষিত মানুষ। কত শিক্ষিত মানষে এই কতা কয়।
এখন বলো, জোছনার বাবা-মা এখন কী করবে? ওই ছেলে  তো জোছনাকে বিয়ে করতে পারবে না।
বিয়ার কী দরকার আম্মা? এক লগে থাকবে। জোছনার সোয়ামীর বাড়ির মানষেও কিছু করতে পারবে না।  হেগো পোলাও তো নাবাল্লক। ধরা খাইয়া যাইবে।
এবার ওঠো। নামাজের আজান পড়ে গেছে। আমি নামাজ পড়তে যাই। আমিও যাই আম্মা। জোছনার খবর পাইলে আমি কইয়া যামু, আর কোনো গল্পের খোঁজ পাইলেও আসুম। আম্মা, গল্প কইতে কইতে আমারো নেশা ধইরা গেছে। বস্তিতে কত মানুষের কত কতা, হেইগুলানই তো আপনে সন্দোর কইরা লেখেন।
তয় একখান কতা কই আম্মা? দিনকাল খারাপ হইয়া গেছে। মাইয়া বড় অইলেই বাপ-মায়ের চিন্তা, পোলাপানরা জব্বর খারাপ। অরা মাইয়াগো ভালো থাকতে দেয় না, জোর কইরা বিয়া করতে চায়। মাইয়া রাজি না অইলে মুখ পুড়াইয়া দেয়। আম্মা আমাগো জোছনারে কি আহাদ করে বিয়া দিছে? ওই শয়তান ছ্যারা জোছনার পিছে লাগছে। কত ভালা ভালা কতা কইছে। আম্মা গো অহন মানুষ আল্লা রসুলেরে ডরায় না।
বুয়া, তোমার লেকচার বন্ধ করো। এই নাও এক শ’ টাকা। আমার বুয়া চোখ কপালে তুলে বলে, আম্মা, বেডিরে এক শ’ ট্যাহা দিলেন? আপনেরে পাইছে ভালা মানুষ।
বুয়া দরজা খুলতে খুলতে স্বগতোক্তি করেÑ আমার প্যাডেও বহুত কতা আছে। আমিও আম্মারে কইয়া প্যাড পাতলা করুম। আম্মার কাছ থেকে ট্যাহা নিমু।
আমি ওর কথায় কান না দিয়ে বাথরুমে ঢুকলাম অজু করতে। মন স্থির করে অজু করতে পারলাম না। আসলে সব মানুষের মনেই কথা জমা থাকে। আমি মনের ভেতরে কথার ঝাঁপি বন্ধ করেও জোছনার কচি মুখটা ভুলতে পারছি না। সত্যি ওর মুখখানা চাঁদের মতো। গরিবের ঘরে এই চাঁদমুখের নিরাপত্তা কোথায়? মেয়েদের নিরাপত্তা নেই কোথাও। গ্রাম-শহর সব জায়গায় এক  অবস্থা। দরিদ্র বাপ-মা পেটের দায়ে নাবালক মেয়েদের বিয়ে দিয়ে একখানা ভাতের থালা কমায়।
নাহ! নামাজে দাঁড়িয়েও জোছনার কথা ভুলতে পারি না। নামাজ শেষ করে কাগজ-কলম নিয়ে বসি। ভুঁইয়াপাড়ার বস্তির বুয়া আমার কাছে এসে কত গল্প করে! আমার বুয়া বলে, কথা ফেরি করে। আমি কী করি? জনে জনে তা জানিয়ে দিই। আমিও কি গল্পের ফেরিওয়ালা?



অন্তরলোকে জ্বলে জোনাকি

রাজিয়া মজিদ

তারিখ: ২ নভেম্বর, ২০১২
বন এত ছোট কেনে?’
সরকারি কোয়ার্টার্সের দোতলার দক্ষিণমুখী জানালা দিয়ে আমি বাইরের দিকে তাকালাম। রোমাঞ্চিত হলাম। শিশুকাল থেকে আমি বাবুই পাখির বাসা নিয়ে খেলতে ভালোবাসি। বড় হয়ে এর নির্মাণ কৌশল দেখে মুগ্ধ। ছোট পাখি অথচ এর বাসার সূক্ষ্ম নির্মাণকাজ অভূতপূর্ব। সুন্দর এবং মনোহর।  এই বয়সেও আমার মনে হয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নির্মাণশিল্পীর চেয়ে এই ছোট প্রাণীটির কৃতিত্ব কম নয়। এগুলো নৈপুণ্য এবং দক্ষতার কথা। ঠোঁটে ও পায়ে করে খড়কুটো এনে বাসা তৈরি করে এরা। এখনো ভাবি, কেউ যদি আমাকে দু-একটা বাবুই পাখির বাসা এনে হাতে দেয়, আমি কৃতার্থবোধ করি এবং আমার ড্রইং রুমের কাচের আলমারিতে স্যুভেনির হিসেবে রেখে দিই। ছেলেবেলায় ঝড়বৃষ্টি হলে আমি খুশি হতাম। মা কান মলে দিয়ে বলতেন, এতে খুশি হওয়ার কী আছে? অসময়ে ঝড়বৃষ্টি হলে মানুষের কত কষ্ট বাড়ে। ফসলের ক্ষতি হয়। অতি বৃষ্টি এবং বন্যা হলে মানুষের দুর্গতির অন্ত থাকে না।
আমি কাঁদতাম। মাকে নিষ্ঠুর মনে হতো। মা আমার মনের কথা বোঝে না। আমি তার কথা বুঝি না। চিন্তাধারায় কত ফারাক। ঝড় হলে আমি দৌড়ে চলে যেতাম তালগাছের নিচে, ফাঁকা মাঠে। দু-একটা বাসা নিচে পড়তই। তাই বুকে করে নিয়ে এসে সারা দিন খেলায় মত্ত থাকতাম। মা এবার মারতেন না, শুধু আফসোস করে বলতেন, এই মেয়েটা কোন দিন না মাথায় বাজ পড়ে মারা যায়। অল্প ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে বাজ পড়ে, বললেও বুঝবে না, কথাও শুনবে না। একে নিয়ে আমার শতেক জ্বালা। মায়ের দুঃখ, আমি তার অন্য ছেলেমেয়েদের মতো বুঝদার এবং বাধ্য নই। আমি এতকাল পরে এসব ভাবছি কেন? ভাবনাটাই তো আমার সহজাত প্রবৃত্তি। আমার আত্মীয়স্বজনের মধ্যে অনেকেই এ কারণে আমাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করেন। তারা বলেন, নেই কাজ তো খই ভাজ।
কিন্তু আমি নিজেকে তা মনে করি না। পৃথিবীর সব মানুষই কি এক রকম হবে? ভোগবিলাসী, অর্থ এবং ক্ষমতালোভী? আমি তা নই। আমি ব্যতিক্রম সাদাসিধে একটা মানুষ। অল্পতে তুষ্ট। লেখালেখি এবং বই পড়া খুব ভালোবাসি। তাই নিয়ে দিন-রাত ব্যস্ত থাকি। আর্থিক উন্নতি এবং সংসারের স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। তাই আমার পরিবারে আমি একজন বোকা, গবেট এবং দায়িত্বহীন ব্যক্তি।
আবার আমি এসব অতীত চিন্তা নিয়ে, অলস ব্যাপার নিয়ে ভাবছি কেন? বর্তমান বাস্তবতা কী? তা হলো, আমি কয়েক দিন বিছানায় লেপটে আছি। একরত্তি পড়তে পারছি না। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা।
রোজকার মতো একটা সরকারি হাইস্কুলের দুই শিফটের দায়িত্ব পালন করে, ঢাকা এডুকেশন বোর্ডের হেড এক্সামিনারের কর্তব্য পালন করে রাত ১২টায় বাসায় ফিরেছি। এশার নামাজ পড়ে আর রাতের ভোজন দুই টুকরো পাউরুটি খেয়ে শুয়ে পড়েছি। সকালে ফজরের নামাজ পড়ার জন্য যেই বিছানা থেকে পা নামাচ্ছি অমনি তারস্বরে চিৎকার। এমন চিৎকার যা শুনে মনে হবে, আকাশ বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, শেষ রাতের হালকা অন্ধকার ছিন্নভিন্ন হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে বাজির ফুলকির মতো।
সবাই ঘুমে অচেতন। শুধু আমার সেজো বোন রেণু নিচতলা থেকে ছুটে এলো। আমার একটা পা বিছানায় অন্যটি নিচে ঝুলছে, কোনো মতেই এ পা’টাকে আর নাড়াতে পারছি না। আমার কষ্টের বর্ণনা শুনে শুধু বলল, ঠিকভাবে বিছানায় পা তুলতেই হবে।
আমি বললাম, অসম্ভব। সে কিছু না বলে সযতেœ সতর্কতার সাথে পা তুলে দিলো বিছানায়। আমার আর্তনাদে কান দিলো না। তার পরে সে আমার ঘর থেকে ছুটে বের হয়ে গেল কোনো কথা না বলে।
আমি হতভম্ব।
ঘণ্টাখানেক পরে সে ফিরে এলো। সাথে এক সুদর্শন যুবক। তার হাতে ডাক্তারি ব্যাগ।
সব রহস্য খোলাসা হলো। রেণু চলে গিয়েছিল পঙ্গু হাসপাতালের সরকারি কোয়ার্টার্সে। যেখানে ডাক্তারেরা বসবাস করেন। ঘুম থেকে ডা: হাসানকে তুলে সাথে নিয়ে এসেছে।
আমার এই বোনের কথায়, আচরণে এবং ব্যবহারে জাদু আছে। সেই আকর্ষণ কেউ এড়াতে পারে না, কিন্তু ডাক্তার হাসান? তখনো অন্ধকার কাটেনি। দিনের আলো ফোটেনি, সেই অস্পষ্ট অন্ধকারে ডাক্তার হাসান কেমন করে এলো একজন রোগীর বাড়ি, সে আমার কাছ থেকে কোনো ফি নেয়নি অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও। তার এই উদারতা, মহত্ত্ব এবং অসাধারণ মানবিক আচরণ আমার মনের কোঠরে আজো জ্বলজ্বল করছে মনুষ্যত্বের মর্যাদায়। ডাক্তার হাসানের অভিমত সংক্ষিপ্ত। সে আমাকে খুব যতেœর সাথে দেখল, তারপর কথা, এক্সরে না করলে সঠিকভাবে কিছু বলা যাবে না। তবে হাড় বেড়ে গেলে এ রকম যন্ত্রণা হয়। সে ক্ষেত্রে অপারেশন করলে ভালো হয়ে যায়। আর যদি হাড় ক্ষয়জনিত ফ্রাকচার হয়ে থাকে অর্থাৎ অস্টিওপরোসিস হয় তাহলে এর কোনো প্রতিকার নেই। তবে ফারদার অর্থাৎ রোগ যাতে আরো বৃদ্ধি না পায় তার জন্য প্রিভেনটিভ অনেক কিছু করতে হবে। আমার মাথা ঘুরছে। অস্টিওপরোসিস, এমন রোগের কথা জীবনেও শুনিনি। এ কেমন রোগ, প্রতিকার নেই। যা ভেঙেছে তা আর কোনো দিন ভালো হবে না। এ কী অসহনীয় যন্ত্রণা। ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগেরও চিকিৎসা আছে, কেমোথেরাপি আর হাড়ের ‘ক্ষয়জনিত’ ফ্রাকচার প্রতিকারহীন। ডা: হাসান বলল, ফুল বেডরেস্ট, পনের দিন।
আমার কোমরের মাপ নিয়ে, ফি না নিয়ে ডা: হাসান চলে যেতে যেতে বলল, পনের দিন পর আবার আমি আসব। হ্যাঁ ভালো কথা, আপনার একটা অভ্যাস আছে, লেখালেখি, রেণু আপা বলেছে, এটাও বন্ধ, ফিজিক্যাল রেস্ট এবং মেন্টাল রেস্ট, আপনার দুটোই দরকার। শুধু হালকা গল্পের বই পড়তে পারেন।
ডা: হাসান চলে গেল। লেখা বন্ধ, কাজ বন্ধ, গুরুতর সমস্যা নিয়ে আলোচনা বন্ধ, নট নড়নচড়ন, তাহলে আমি কী? একটা গাছের গুঁড়ি, একটা মৃতদেহ, একটা পুতুল? আমি কাঁদতে লাগলাম। অনেক দিন আগে পশ্চিমবঙ্গের স্বনামধন্য লেখক তারাশঙ্করের ‘কবি’ নামে একটা বই পড়েছিলাম। গ্রাম্য কবিদের কবিয়াল লড়াই। একপক্ষ কবিতায় প্রশ্ন করবে, অন্যপক্ষ কবিতায় উত্তর দেবে। তুমুল লড়াই। যে দল জিতবে সেই দল পুরস্কৃত হবে।
একদল প্রশ্ন করছে, কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদো কেন?
অন্যদলের উত্তর মনে নেই। তবে আজ আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে, হায়, জীবন এত ছোট কেনে? আমার মোটে বায়ান্ন বছর বয়স, এই বয়সে জীবন শেষ। সোজা হয়ে হাঁটতে হবে। নিচু হওয়া যাবে না, ভারী কোনো কিছু তোলা যাবে না, বসে লেখা যাবে না, আরো অনেক বিধিনিষেধ।
দ্য স্প্যান অব লাইফ ইজ সো শর্ট, ইংরেজ কবির আক্ষেপ। আমার আক্ষেপ, আমি এক দম দেয়া পুতুল। হায়, জীবন এত ছোট কেন?
পনের দিন পর ডাক্তার হাসান এলো। হাতে এক অদ্ভুত বস্তু। সে নাম বলল, করসেট। তারপর আমাকে সযতেœ উঠিয়ে কোমরে বেঁধে দিলো। বলল, আপনি চাকরি করেন, বিশেষ করে ছোটাছুটির কাজ। এটা আপনাকে কোমরে ইউজ করতেই হবে। নচেৎ আবার প্রচণ্ড ব্যথা।
করসেট চিরদিনের জন্য আমার সঙ্গী হয়ে গেল। শুয়ে শুয়ে চিন্তা করি, আমার কর্মঠ কর্মময় জীবন সত্যি কি শেষ? বায়ান্ন বছর বয়সে আমি পঙ্গু, অথর্ব এবং অসহায়?
‘যাহা থাকিবে নসিবে ঘুরে ফিরে আসিবে’Ñ আমার নির্বুদ্ধিতার এই ভাবে ব্যাখ্যা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। আমার এক হিতৈষী আত্মীয়া আমাকে এভাবে উপদেশ দিয়েছিলেন, মাঝারি অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মধ্য বয়সের ডাক্তারকে সব সময় দেখাবে। এদের হাতে সময় আছে, ভবিষ্যতে সুনাম অর্জন ও স্বনামধন্য ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন আছে। এরা রোগীকে অনেক সময় নিয়ে আন্তরিকতার সাথে দেখে। যারা ইতোমধ্যে অনেক সুখ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের হাতে সময় কম। রোগীর ভিড় বেশি। তা ছাড়া এসব বয়োবৃদ্ধ ডাক্তারের অনেকের মানসিক ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া আছে। ইতোমধ্যে আমি একটুখানি সামলে উঠেছি। আমি জীবন সম্পর্কে এত হতাশ কেন? আমি একজন জীবনসৈনিক, সাহিত্যসৈনিক। যুদ্ধক্ষেত্রে একজন সৈনিক আহত হলেও শেষ পর্যন্ত বেঁচে থাকার জন্য চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায়। আমিও তাই। শুধু প্রেক্ষাপট অন্যরকম। রোগের সাথে যুদ্ধ করেই আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি খোঁজ করে একজন বড় অর্থোপেডিক ডাক্তারের কাছে হাজির হলাম। তিনি পঙ্গু হাসপাতালের প্রফেসর ছিলেন। কোনো কারণে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। ভদ্রলোক আমার অসুখের বিবরণ শুনে বড় বড় চোখ করে তাকালেন। আমি বুদ্ধিমতী হলে সেই মুহূর্তে বুঝতে পারতাম, তিনি এই অসুখের নাম জীবনেও শোনেননি। ডাক্তারেরা সাধারণত রোগীদের চেয়ে অনেক চালাক এবং বুদ্ধিমান হন। তিনি বোধহয় আমার মতো শাসালো রোগীকে হাতছাড়া করতে চাননি। নিজেও রসিক এবং ভালো বক্তা। কথার জালে আমাকে মুগ্ধ করলেন। আমি তিন-তিনটা বছর তার চিকিৎসায় থেকে গেলাম। এর মধ্যে তিনি শুধু আমাকে পেইন কিলিং ট্যাবলেট এবং ভিটামিন খাইয়ে রাখলেন। এই রোগের আসল ওষুধ যে ক্যালসিয়াম তা আমি যেমন জানি না, এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ ডাক্তারও তেমনি অজ্ঞ। তিন বছর পরে আমার অসুখ চরমে উঠল। শরীরে অসহনীয় ব্যথা এবং প্রায় অনড় অবস্থায় ডাক্তার এবার শেষ নাটক করলেন। দুই হাতের তালু এক করে চাটি মেরে বললেন, আপনার শরীরের হাড় বিশেষ করে পিঠের হাড় একটার সাথে আরেকটা লেগে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। কারোর সাধ্য নেই এগুলো ঠিক করার। যান যান, বিদেশে চলে যান। শেষের কথাগুলো তার কর্কশ, অমার্জিত এবং ভঙ্গি অশালীন। আমি উঠে দাঁড়ালাম। আর এক মিনিটও এখানে নয়। এর অজ্ঞতা এবং আসল চেহারা এত দিনে উন্মোচিত। ছি ছি নিজেকেই বারবার ধিক্কার দিলাম। হাড়ের শেষ অবস্থা জানার জন্য ওই ডাক্তারের অ্যাডভান্স স্লিপ নিয়ে এক্সরে কিনিকে গেলাম। রেডিওলজিস্ট বললেন, আপনার হাড়ে অনেক ফ্রাকচার হয়েছে। আমি না বোঝায় তিনি এক্সরের ফটোগুলো দেখিয়ে বললেন, এই দেখুন কত বড় বড় কালো গর্ত, এখানে হাড় সব ভেঙে গেছে।
আমার জিজ্ঞাসা, এটা কি সারবে?
তিনি কিঞ্চিত গম্ভীর হয়ে বললেন, অসম্ভব। আমি সেই ঘরে বসেই অসহায়ের মতো কাঁদতে লাগলাম। আমি আমার মেয়ে লিপিকে সব বললাম, লিপি ছি: ছি: করতে লাগল, মা, তুমি আমাকে গোড়াতেই জানালে না কেন? আমি এক হাজার মিলিগ্রামের ক্যালসিয়াম দুই-তিন ফাইল পাঠিয়ে দিতে পারতাম, কত লোক দিন-রাত আসা-যাওয়া করছে। যাক, যা হওয়ার হয়েছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। আমি পাসপোর্ট এবং ভিসার জন্য দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করলাম। প্রথম ইন্টারভিউতেই আমার ভিসা হয়ে গেল, আমার সেজো বোন সালেহা খাতুন সিদ্দিকী ওরফে রেণু শুনে বলল, আমিও যাবো আপনার সাথে।
more information click here



সাহিত্য কবিতাবলী

পু ল ক  হা সা ন
আত্মরক্ষা
শীতে আর্তনাদ করে ওঠা পাতাটির মতো
মৃত্যুভয় আমার মনে
ধার্মিকের অনাবশ্যক খিস্তি থেকে
আছি তাই নিরাপদ;

দারুণ এই সময় যে-বা চাই অভয়
প্রেমের বিভীষিকায় শুধু আত্মক্ষয়
মৃত্যু প্রলোভন তাই যদি না জড়াত
পায় পায়, মন থেকে যত বিচিত্র ক্ষত
সারাবার থাকত কী উপায়?

এই ভেবে জেগে উঠি সাহসে
আহতের কণ্ঠ চিরে রক্তিম সারসে।

আ ই উ ব  সৈ য় দ
নিরপেক্ষ শরত
নিরপেক্ষ শরতটা হইচই করে ঘরে ফিরে
মাঝে মধ্যে বোধশক্তি হারিয়ে ফেলে কল্পিত স্বরে,
সুর তাল লয় ডেকে শিশির ছায়ায় মিশে যায়
মনোনীত ব্যাকুলতা কেঁপে ওঠে অবিরত ঘরে।
পাখা ঝাপটানো দৃষ্টি প্রতিনিয়ত মুখ ফিরিয়ে
বিতর্ক করে উল্লাসে; উদাসী অবলোকনে পায়
অপঠিত রাতেরই বিপন্ন আচরণের ভাষা,
লুকানো রহস্য নিয়ে ডুবুরি সেজেই সাঁতরায়।

নিরপেক্ষ শরতটা আবার তদন্তের ভারেও
গোপন করে গোধূলি, কবিতার তীর ঘাম আর
অসহনীয় বিলাপ, উদোম পত্রালির রোমাঞ্চÑ
বুঝি না অগ্নিপরীক্ষা, আয়োজনে কেন হাহাকার?

নিরপেক্ষ শরতটা অজানা দাবির যৌথ ক্ষতে,
এখনো আছড়ে পড়ে সাবালিয়ার কথিত পথে।

কৃ ষ্ণা ন ন্দ  সা হা  রা য়
অসীমে হারিয়ে যাওয়া
মনে করো আমি নেই
নিথর নিষ্পন্দ প্রাণহীন দেহ পড়ে আছে
স্তূপীকৃত একরাশ বালির স্তূপে
জেগে আছে শুধু আমার নিজস্ব মন ও চেতনা
রূপান্তরিত জৈবিক দেহ কঠিন প্রস্তর শিলায়।

মনে করো আমি নেই চেতনার নীলাকাশে চলেছি ছুটে
টেনে নিয়ে স্মৃতিময় বিদেহী সত্তাকে আমার
মিশে যেতে সীমাহীন অসীম আনন্দলোকে

সুখ নেই, দুঃখ নেই, নেই কোনো জ্বালাময় যন্ত্রণা
চাওয়া নেই, পাওয়া নেই, নেই কোনো আমিত্বের অহঙ্কার
ছায়া নেই, কায়া নেই, জৈবিক দেহ ছাড়ি
প্রাপ্তি শুধু একমাত্র অসীমে হারিয়ে যাওয়া।



কিছু স্মৃতি কিছু কথা : সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

নুরুল করিম নাসিম

তারিখ: ২ নভেম্বর, ২০১২
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
তখন ষাট দশকের শেষ প্রহর। সত্তর দশক উদ্বোধন হওয়ার অপেক্ষায়। কলকাতা থেকে কোনো বাংলা বই কিংবা সাহিত্যপত্রিকা এ দেশে আসত না। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে রক্তহীন এক বিপ্লবে তদানীন্তন পাকিস্তানের ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন, দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়েছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ।
তারপরও সীমান্তের কাঁটাতারের শাসনকে উপেক্ষা করে কী এক জাদুবলে কলকাতার পূজা সংখ্যা ‘দেশ’ ও দু’তিনটি লিটল ম্যাগ সাংবাদিকদের হাতে পৌঁছে যেত।
এরকম একটি পূজা সংখ্যা ‘দেশ’ হাত বদলে আমাদের কাছে এলো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অতিন বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়Ñ তাদের লেখা আমরা পড়তাম। পূজা সংখ্যায়ও এদের লেখা ছিল। এর মধ্যে সুনীলের লেখাটি মনে হয়েছে অন্য রকম।
সুনীলের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ নিজের জীবন ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে লেখা আত্মজৈবনিক উপন্যাস। খুবই সাহসী এবং সময়োপযোগী একটি আখ্যান। আমেরিকান কবি সিলভিয়া প্লাথের ‘বেলজার’ উপন্যাসকে স্মরণ করিয়ে দেয়, যদিও দু’টি দুই ভিন্ন ধারার উপন্যাস।
সুনীলের সাথে এভাবে আমাদের পরিচয়। যা কিছু পেয়েছি, কবিতা কিংবা উপন্যাস গোগ্রাসে গিলেছি। এক বিমুগ্ধতা আমাদের পেয়ে বসেছিল। একটা ঘোরের ভেতর আমরা চলে যেতাম তার উপন্যাস পড়তে পড়তে। তিনি জনপ্রিয় ধারার লেখক হয়েও বেশ কিছু অবিস্মরণীয় উপন্যাস আমাদের উপহার দিয়েছেন।
নোবেল বিজয়ী লেখক গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ তার একটি গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় একটি প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছিলেন। তিনি স্বপ্নে গল্প পেতেন। রাতে দেখা স্বপ্নগুলো কাটছাঁট করে গল্প লিখেছিলেন গ্যাব্রিয়েল মার্কেজ। সুনীলও স্বপ্ন নিয়ে, স্বপ্ন থেকে গল্প আহরণ করতেন।
সুনীল একজন সিরিয়াস পাঠকও বটে। তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘আবার এমনও হয় আমার খুব এলোমেলো বই পড়ার স্বভাব, যখন তখন যেকোনো একটা বই পড়ি। এ রকম যেকোনো একটা বই পড়তে পড়তেও চিন্তা আসে। সেই সব চিন্তা কখনো কখনো লেখার বিষয়বস্তুও হয়ে দাঁড়ায়।
ষাট দশকের শেষ প্রহরে এবং সত্তর দশকের শুরুতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ দেশ পত্রিকার পূজা সংখ্যায় ছাপা হয়। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন তখন সাগরময় ঘোষ। সুনীলকে তার লেখার জন্য সব ধরনের পত্রপত্রিকায় তাকে গদ্য জোগান দিতে হয়েছে।
‘কৃত্তিবাস’ ছিল তার যৌবনের স্বপ্ন। এই লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে তিনি ও তার কবিতাপ্রেমিক বন্ধুরা একটি কবিতা আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। কবি বুদ্ধদেব বসুর যেমন ছিল ‘কবিতা’ পত্রিকা। আমাদের দেশে কবি শামসুর রাহমান ও কবি ফজল শাহাবুদ্দীনের যৌথ উদ্যোগে যেমনÑ তেমনি সুনীলের ‘কৃত্তিবাস’।
সুনীলের একাধিক ছবির চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তার ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ উপন্যাসের নাট্যরূপ দিয়েছেন।
তিনি দুই শতাধিক গ্রন্থ প্রণেতা। শুরু করেছিলেন কবিতা দিয়ে, তার প্রথম প্রকাশিত কবিতার বই ‘একা এবং কয়েকজন’, পরে একই নামে একটি বিশাল উপন্যাসও লেখেন, আর পরে গদ্যের দিকে ঝুঁকে পড়েন। বলা চলে, জীবন-জীবিকার জন্য নিয়মিত রুটিন করে তাকে গদ্য লিখতে হতো। এই লেখার টাকা দিয়ে তার সংসার চলত। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত নিয়মিত লিখতেন, সন্ধ্যায় বন্ধুদের সাথে কফি হাউজে আড্ডা দিতেন।
বিটলসদের দলপতি কবি অ্যালেন গিনসবার্গ যখন কলকাতায় আসেন, সুনীলের সাথে গভীর অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। সেটা ষাট দশকের কথা। আমেরিকার আইওয়াতে কবিতার আন্তর্জাতিক উৎসব ও ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর। প্রতিষ্ঠানের আয়োজকেরা সুনীলকে আমন্ত্রণ জানালেন এক বছরের জন্য সেখানে। চমৎকার সময় কাটল। সবটাই ছিল কবিতার দিনরাত্রি। তখন তিনি তরতাজা যুবক। চোখে স্বপ্ন, মনের ভেতর কবিতার আনাগোনা নিঃসঙ্গ একাকী জীবনে শুধু কবিতার একমাত্র আশ্রয়। সেই ভিনদেশে দেখা হলো তার সাথে এক কবিতাপাগল ফরাসি যুবতীর। মেয়েটির নাম মার্গারিট। সুনীলের ‘কবিতার দেশে গানের দেশে’ বইটিতে সেই অনিন্দ্য সুন্দরী নারীর কথা বিস্তারিত লেখা আছে। তাকে নিয়ে ‘সুদূর ঝর্ণার জলে’ উপন্যাসও লিখেছেন। আরো একটি উপন্যাসে এ প্রসঙ্গ এসেছে। মার্গারিট ছিল তার অনুপ্রেরণা। ফরাসি কবিতা ফরাসি ভাষায় সে আবৃত্তি করত, আর সুনীল বাংলা কবিতা আবৃত্তি করে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তাকে শোনাতেন। এভাবে আমেরিকার আইওয়াতে কবিতাময় দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন দেশে ফেরার সময় এলো। ইচ্ছে করলে আরো এক বছর থাকতে পারতেন সেখানে। কিন্তু বাংলা ভাষায় কবিতা লেখার জন্য দেশে ফিরে এলেন। দেশে চাকরি পাওয়া এতটা সহজ ছিল না সেই ষাট-সত্তর দশকে। টিউশনি করে জীবন শুরু করেছিলেন, আবার কি তবে পুরনো পেশায় ফিরে যাবেন? না, সে রকমটি হয়নি। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ সুনীলের ভেতর সম্ভাবনাময় এক তরুণ কবি ও ঔপন্যাসিককে আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তাকে স্বনামে এবং কিছু ছদ্মনামে ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় কলাম লিখতে দিলেন। সনাতন পাঠক, নীললোহিত, নীল উপাধ্যায়Ñ এসব ছদ্মনামে তিনি অবিশ্রান্ত লিখতে শুরু করলেন।
তার আত্মজীবনী ‘অর্ধেক জীবন’-এ এসব কথা খোলাখুলি লিখেছেন। তিনি জীবন ধারণের প্রয়োজনে গদ্য লিখেছেন, উপন্যাস লিখেছেন।
তার রক্তের সাথে গভীরভাবে মিশে ছিল ভ্রমণ। যখনই কিছু টাকা হাতে আসত, দু-তিনজন বন্ধু মিলে চলে যেতেন কলকাতার বাইরে। নতুন জনপদ দেখতেন, বিচিত্র সব মানুষ দেখতেন, দেশকে বুঝতে চেষ্টা করতেন। তার ‘যুবক যুবতীরা’ উপন্যাসটি এই ভ্রমণের ফসল। জ্যাক কেরুয়াক, বিটলসদের আর এক খ্যাতিমান লেখক, ‘অফ দ্য রোড’ লিখেছিলেন তিন সপ্তাহে একটি ভ্রমণকে পুঁজি করে, তেমনি সুনীলও পশ্চিমবঙ্গ ও ভারতের বিশাল ও বিচিত্রসব জনপদ, সংস্কৃতি ও মানুষের কথা তার অসংখ্য উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।
তার সহধর্মিণী স্বাতীর সাথে বিয়েটাও উপন্যাসের মতো চমকপ্রদ। তখন সুনীল কবি ও গদ্যকার হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। হঠাৎ একদিন এক নারী তাকে টেলিফোন করে দেখা করতে চাইলেন। সুনীল রাজি হলেন। নারীটি কবির সাথে দেখা করলেন এবং সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন।
সুনীলের তখন চালচুলো কিছু নেই। স্থায়ী কোনো চাকরিও নেই। আছে শুধু চমৎকার গদ্যের একটি হাত। রিস্ক নিলেন উভয়ে, হয়ে গেল বিয়ে। সুনীল এসব কথা তার আত্মজীবনীতে চমৎকার গদ্যে লিখেছেন।
বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদ ও প্রয়াত ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল সুনীলের। কবি রফিক আজাদ ‘কোনো খেদ নাই’ আত্মজীবনীতে অনেক অকথিত গল্প বলেছেন এই কবি সম্পর্কে।
‘কেন লিখি’ প্রবন্ধে সুনীল লিখেছেন : কেন লিখি, এই প্রশ্ন যদি আমার চব্বিশ-পঁচিশ বছরে করা হতো, তাহলে উত্তর একরকম হতো। চল্লিশ-বেয়াল্লিশ বছরে অন্যরকম। এখন হয়তো আরেক রকম। এ ব্যাপারে কোনো স্থির সত্য নেই।
সুনীল চলে গেলেন।
৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ সালে বাংলাদেশের ফরিদপুরে যার জন্ম, ২৩ অক্টোবর ২০১২ সালে কলকাতায় তার মৃত্যু। শিক্ষা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ করেছেন।
জীবনে একাধিক পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৮৩ সালে পান বঙ্কিম পুরস্কার। ভারতের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার আকাদেমি পুরস্কার পান ১৯৮৫ সালে।
তার লেখা, বিশেষত উপন্যাস ও কবিতা, ইংরেজিসহ একাধিক বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
তার মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্যের যে অপূরণীয় ক্ষতি হলো, তা সহজে পূরণ হবে বলে মনে হয় না। তিনি বিদেশী কবিতাও অনুবাদ করেছেন বিস্তর। তার ‘কবিতা কার জন্য’, ‘কবিতার জন্য সারা পৃথিবী’, ‘সাহিত্যের কোনো শর্ত নেই’ বাঙালি পাঠকদের কাছে অসম্ভব পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে। তিনি একজন ভালো বক্তাও ছিলেন। তার লেখায় যেমন, কথাতেও হাস্যরস থাকত, ব্যঙ্গ থাকত।
‘সেইসময়’, ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘প্রথম আলো’, ‘জীবন যে রকম’ বাংলা সাহিত্যের ব্যতিক্রমী উপন্যাস। জনপ্রিয় ধারার লেখক হয়েও কয়েকটি অবিস্মরণীয় উপন্যাসও আমাদের জন্য তিনি রেখে গেছেন।

বড় মনের মানুষ

রা ম শ ং ক র দে ব না থ
এই সেদিন, ২৩ অক্টোবর ২০১২ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চলে গেছেন অনেক দূর। সবে প্রকাশনা (বিভাস) প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরু করেছি, প্রকাশনা সংশ্লিষ্ট লেখক-সম্পাদক সবার যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছি পূর্বপরিচয়ের সূত্রে। প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ দাদার আন্তরিক সহযোগিতা ও পরামর্শ ঢাকা শহরের নিষ্করুণ লড়াইয়ের ময়দানে আমার মনোবল ধরে রাখতে সহায়ক হয়েছে। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির ১ম দিনে টাঙ্গাইলে কবি মাহমুদ কামাল ভাইয়ের কবিতা উত্সবে যোগ দিতে আসছেন বাংলা সাহিত্যের কলম জাদুকর, বিশ্ব-পর্যটক কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ধ্রুব-দার কাছে একদিন গেলাম। বললাম, “আগামী সপ্তাহে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বাংলাদেশে আসছেন।” এই নামটাই আমার জন্য এমন গভীর সংবেদনশীল যে, আমি ভেতরে ভেতরে যেন কেমন আবেগাপ্লুত হয়ে উঠলাম। আমার বুকশেলফ ভর্তি প্রিয় কবি-লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্র, অর্ধেক জীবন, জীবন যে রকম, সেই সময়, ছবির দেশে কবিতার দেশে, প্রথম আলো, অর্জুন, পূর্ব-পশ্চিম, কবিতার জন্য সারা পৃথিবী’র কলকাতার সংস্করণ। ধ্রুব-দাই বললেন, “দেখা করেন, খুব ভালো মানুষ, অনেক মহান মনের মানুষ, টাকা-পয়সা অবস্থান এসব দেখে তিনি মানুষের সঙ্গে মেশেন না, যেমন বড় লেখক, তেমনি বড় মনের মানুষ।”
কথাটায় ভরসা পেলাম। আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম, “আমার সঙ্গে দেখা কী করবেন?”
“নিশ্চয়ই করবেন, দাঁড়ান, যোগাযোগের ব্যবস্থা করিয়ে দিচ্ছি।”
ধ্রুব-দা সুনীলদার ভ্রাতৃসম কবি শ্যামলকান্তি দাশের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিলেন।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় দিন। অন্য আর দশজন সাধারণ প্রকাশকের মত আমারও ব্যস্ততা তুঙ্গে। ছয়জনের কাজ একাকীই করতে হয়। বেলা ১১টায় মেলা শুরু। তার আগে সকাল ৮টার সময় কাকরাইলস্থ রাজমণি ঈশা খাঁ হোটেলের রিসেপশনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখানেই আমার স্বপ্নের মানুষটি ঘর নিয়েছেন থাকার জন্য। অবশেষে তাঁর সঙ্গে দেখা হলো। হোটেলভর্তি পশ্চিম বাংলার কবি-লেখকরা সাত সকালেই টাঙ্গাইল যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছেন, শুধু সুনীলদার অপেক্ষায়। পরিচয় হলো কবি নবনীতা দেব সেনসহ আরো কয়েকজন কবির সঙ্গে। কবি শ্যামলকান্তি দাশ আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ক’মিনিট কথা বলা যায় কি-না সন্দেহ। উনি এত ব্যস্ত মানুষ। এরই মধ্যে এসে গেলেন বাংলা প্রকাশের কবি, লেখক হুমায়ূন কবীর ঢালী ভাই ও আরো কয়েক জন।
সুনীলদা নাস্তা খাবার ফাঁকে মোবাইলে কবি বিপাশা মনডলের সঙ্গে নতুনদের কবিতা নিয়ে আলোচনা করলেন।
আমার বই প্রকাশের তালিকা নিয়ে দেখে ‘অর্ধেক জীবন’ নিয়ে কবি শ্যামলকান্তি দাশ একটু অমত করলেন। সুনীলদা শ্যামলকান্তিকে বললেন, আমি আনন্দ পাবলিশার্সকে কপিরাইট দিয়ে দিয়েছি না-কি!
সুনীলদা এমনভাবে কথা বললেন যেন আমি তার অনেক দিনের চেনা। আমাকে সহযোগিতা করার জন্য তাঁর লেখা বই প্রকাশের অনুমতি দিলেন। আমাকে নিয়ে সঙ্গে নাস্তা করলেন। সম্মানীর অর্থ দিতে গেলে নিতে চাইলেন না।
জিজ্ঞেস করলেন, “প্রকাশনা ছাড়া আর কি কর?”
আমি বললাম, “আর কিছুই করি না।”
“স্ত্রী কিছু করে?”
“আগে শিক্ষকতা করত, এখন বাচ্চা নিয়ে করতে পারে না।”
“টাকা এখন দিতে হবে না, আগে বই প্রকাশিত হোক, কিছু মুনাফা কর, তারপর দেবে।”
আমি ইতস্তত স্বরে বললাম, “সেটা ঠিক আছে, কিন্তু শিল্পীর তো একটা সম্মান আছে, আর আপনি যত বড় মহান শিল্পী, আপনাকে সম্মানিত না করে আমি বই প্রকাশ করতে পারি না।”
অত বড় মানুষটাও আমার আকুলতার কাছে হার মানলেন। সম্মানীর অর্থ গ্রহণ করলেন। বললেন, “কলকাতায় গেলে যেন তাঁর বাসায় উঠি।”
প্রথম সাক্ষাতেই আমাকে লিখিত অনুমতি দিয়ে দিলেন। হুমায়ূন কবীর ঢালী ভাই তার ক্যামেরায় কয়েক প্রস্থ ছবি ওঠালেন। হোটেল রাজমণির দক্ষিণ পাশের বড় বড় জানালায় সকালের সূর্যের আলো ঠিকরে পড়ছিল। কালো কাচের পাল্লা দু’টি লাগিয়ে হোটেল রুমের বৈদ্যুতিক বাতিতে আবার ক্যামেরায় ক্লিক... ক্লিক...
একদিন ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ বইয়ের প্রুফ সংশোধন করতে গিয়ে একটু দ্বিধায় পড়লাম। কিছুতেই সুনীলদার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। তখন আমাদের শ্রদ্ধেয় কবি বেলাল চৌধুরীর শরণাপন্ন হয়েছি। উনি যোগাযোগের ব্যবস্থা করিয়ে দিলেন।
এরপর আর কখনো কোনো বিষয় নিয়ে আমাকে দাদার সঙ্গে দু’বার কথা বলতে হয়নি। যখনই কোনো অসুবিধায় পড়েছি, ফোন দিলেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি রিসিভ করেছেন। পরামর্শ দিয়েছেন। অত বড় একজন মানুষ, সাহিত্য আকাদেমীর প্রধান, কত ব্যস্ততা, তারপরও তিনি কখনো বিরক্ত হননি।
২০১১ সালের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আমার শ্বশুরমশায় কলকাতা গেছেন আরও বই প্রকাশের অনুমতিপত্র নিয়ে। যোগাযোগ করে জানতে পারলাম, তিনি কবিতার আমন্ত্রণে আফ্রিকা গেছেন। তিনি আগামী সপ্তাহে কলকাতায় আসবেন তাও বলেছেন। শ্বশুরমশায় বিভাস-এর চিঠি ও প্রকাশিত বইগুলো নিয়ে সাক্ষাত্ করতে গেলে তিনি চিঠিতে (অনুমতিপত্র) স্বাক্ষর করে দিয়েছেন।
পুজোর আগের সপ্তাহে কথা বললাম সুনীলদার সঙ্গে। শারীরিক অবস্থা নিয়ে কথা হলো দীর্ঘক্ষণ। সবশেষে নতুন কয়েকটি বই প্রকাশের অনুমতি দেয়ার অনুরোধ জানালাম। কিছু সম্মানী-দক্ষিণা পাঠানোর মাধ্যম জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, এবার কেউ এলে (কলকাতায় গেলে) তার হাতেই পাঠিয়ে দিও। সঙ্গে নতুন বইগুলোর নামসহ চিঠিটাও।
ফোনেই জিজ্ঞেস করি, খুব শীঘ্র ঢাকা আসছেন কি?
উত্তরে বললেন, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না (আসবেন বলে ঠিক নেই)।
আজ আমার মনে হয় এই যে এতবড় মানুষটার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, এত সহযোগিতা করেছেন, সেসব সত্যি নয়, যেন স্বপ্ন, মানুষ যে এত দয়াশীল হতে পারে, এত সহযোগিতামূলক মনের মানুষ হতে পারে তাঁকে না জানলে, না দেখলে আমার জানা-দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যেত।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পরপারে চলে গেছেন। তাঁর পরিবারবর্গ ছাড়া আর কার (ব্যক্তি) কি ক্ষতি হয়েছে জানি না, কিন্তু বাংলা সাহিত্যের যে ক্ষতি হয়েছে তা কখনো পূরণ হবে না। ছেলেবেলা থেকে তাঁর বই পড়ে মুগ্ধ হয়েছি। মানুষের ভালো-মন্দকে বুঝতে শিখেছি, আধুনিকতা সম্পর্কে জেনেছি, তার সরাসরি সংস্পর্শে আসার সৌভাগ্য তাঁর স্নেহ-আনুকূল্য পাওয়া সবার কপালে জোটে না। আমি বাংলাদেশে বসবাস করেও তাঁর যে ভালোবাসা, পিতার স্নেহ পেয়েছি তাতে এমন আমার মনে হয় আমার জন্ম অন্তত এই একটা কারণে হলেও অনেকটা সার্থক।
আমাদের প্রকাশনা সংস্থা বিভাস প্রকাশিত/প্রকাশিতব্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যয়ের বই গুলো হচ্ছে : *নির্বাচিত ২০০ কবিতা *অর্ধেক জীবন *রাণু ও ভানু *আমি কেউ না *যুবক যুবতীরা *তিনটি উপন্যাস *জীবন যে রকম *ভয়ংকর সুন্দর *শিশু-কিশোর গল্প *ভালোবাসা, প্রেম নয় *ভয় পেয়ো না নীল মানুষ *পাঁচটি প্রেমের উপন্যাস *কবিতার জন্য সারা পৃথিবী *ছবির দেশে কবিতার দেশে *একটি মেয়ে অনেক পাখি *বরণীয় মানুষ স্মরণীয় বিচার *রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার এবং পুনরাবিষ্কার *অর্জুন *শ্রেষ্ঠ গল্প *সুনীল স্মরণে (হাসান হাফিজ সম্পাদিত)।
 
 সূত্র ঃ আমার দেশ, সাহিত্য সাময়িকী।